বুধবার ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
কৃষিতে বিষ্ময়কর সাফল্যের টেকসই ব্যবস্থা দরকার
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ: শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৮:১৬ PM
সরকারের কৃষিবান্ধব নানামুখী কর্মসূচির কারণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই অসামান্য অবদানের  পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শি এবং সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে কৃষিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সমূহ যথাযথ বাস্তবায়নে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে তার মন্ত্রণালয়ের দফতর সমূহ মাঠ পর্যায়ে কৃষিকাজে জড়িতদের নিরন্তর প্রয়োজনীয় পরামর্শ, তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা দেওয়ায় কৃষিতে এই অসামান্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি উপকরণ, কৃষিতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার, আর্থিক প্রণোদনা, বীজ, সার, কীটনাশক প্রদান, সুবিধাবঞ্চিত বর্গাচাষিদের দোরগোড়ায় সময়মত স্বল্পসুদে জামানতবিহীন কৃষি ঋণ কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের রুপান্তরের কৃষিতে অসামান্য অর্জন বিশ^কে পথ দেখাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে বিদ্যমান খাদ্য সংকট মোকাবিলায়।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি পর্যায়ে ঋণ সুবিধা পৌঁছে দিতে সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে ‘বর্গাচাষিদের জন্য কৃষিঋণ’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ‘কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা’র আওতায় কৃষকদের ঋণ প্রদান করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ২৯ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে চার হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ২৭ দশমিক ৩৬ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। একই ভাবে করোনা কালে চার শতাংশ রেয়াতি সুদে নয় হাজার ১৭৫ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা কৃষি ঋণ দেওয়া হয় নয় লাখ গ্রাহককে। তা ছাড়া  বন্যা, খরা, শিলা বৃষ্টি, অতি বৃষ্টি, ঘুর্ণিঝড়, উজানের ঢল, পাহাড়ী ঢল ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে গক ১৪ বছরে এক হাজার ৯৩৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়। এর ফলে দুই কোটি ২৩ লাখ ২১ হাজার জন কৃষক উপকৃত হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ৪৭ কোটি ৮১ লাখ টাকার প্রণোদনা ছয় লাখ ৪৩ হাজার কৃষককে প্রদান করা। এতে উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি।

খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরও উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে  খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল তিন কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা বেড়ে চার কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। ২০০৮-০৯      অর্থবছরে  চাল ৩১৩ দশমিক ১৭ টন এবং  ২০২২-২০২ বছরে ৪০১ দশমিক ৭৬ টন। একই সময় গম, ভুট্টা, আলু, ডাল, তেলবীজ, সবজির উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ।  বিগত ১৫ বছরে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় নয় গুণ, আলু দুই গুণ, ডাল চার গুণ, তেলবীজ দুই দশমিক পাঁচ গুণ ও সবজি আট গুণ। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের কৃষির সাফল্য বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। দেশের ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি এবং দেশে বিদেশে বিজ্ঞানীদের উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কারণে এ অর্জন সম্ভব হয়। এ  ১৫ বছরে বৈরি পরিবেশ সহনশীল জাতসহ মোট ৬৯৯টি উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন ও ৭০৮ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসময় ধানের ৮০টি জাত উদ্ভাবন করা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের নেতৃত্বে তার সংস্থার কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৬১টি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। বিশেষ করে লবণাক্ত সহনীয় জাত নয়, জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা এবং খরা সহনীয় তিন, জোয়ার-ভাটা সহনীয় দুটি, প্রিমিয়ার কোয়ালিটি সাত, জিংক সমৃদ্ধ সাতটি জাত রয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) বিগত ১৫ বছরে ১৯টি ধানের জাতসহ বিভিন্ন ফসলের মোট ৮৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে। বিনা উদ্ভাবিত ধানের জাত হচ্ছে, স্বল্প জীবনকালীন ধান, লবণ সহিষ্ণু বোরো ধানের দুইটি, জলমগ্নতা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের বিনাধান। এ ছাড়া বিনা গম-একটি, সরিষা, তিল, চিনাবাদাম  ও সয়াবিন রয়েছে। মসুর, মুগ, ছোলা, মাষকলাই, খেসারী, টমেটো’র  বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করা হয়। 

জেনম সিকুয়েন্সিং আবিস্কারের মাধ্যমে বিশ্বে সর্বপ্রথম তোষা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করেন দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা। পরবর্তীতে পাটসহ পাঁচ শতাধিক উদ্ভিদের বিধ্বংসী রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের ও দেশি পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন হয়। ২০১৮ সালে ধইঞ্চার জীবন রহস্যর উন্মোচন করা হয়েছে। উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাত ও সংরক্ষণে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার কাজও চলছে। এরমধ্যে চার তলা বিশিষ্ট ১৪ হাজার বর্গফুট করে পাঁচ জেলায় পাঁচটি অফিস কাম ট্রেনিং অ্যান্ড প্রসেসিং সেন্টার স্থাপন করা হয়। গাবতলীতে একটি সেন্ট্রাল মার্কেট, ২১টি পাইকারী বাজার, ৭২টি কৃষকের বাজার, ২৩টি এসেম্বল সেন্টার ও গৃহ পর্যায়ে ৪০টি আলু সংরক্ষণাগার। এ ছাড়া, শাক-সবজি ফলমূল গৃহ পর্যায়ে দীর্ঘদিন সতেজ রাখার নিমিত্ত সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় ৩০টি জিরো এনার্জি কুল চেম্বার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’। এ লক্ষ্যে ৪৩৮ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০২৩-এর জুন পর্যন্ত সময়ে  বাগানের সংখ্যা দুই লাখ ৫২ হাজার ৯৬টি।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) কর্তৃক ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ২০৯টি ফসলের উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিকূল পরিবেশ সহিষ্ণু ও হাইব্রিডসহ ৩৪৭টি জাত এবং ৪০৩টি ফসল উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।  দুর্যোগ, ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন বা খাপ খাওয়ানোর নিমিত্ত আধুনিক লাগসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় ব্রিধান-৪৭, ব্রিধান-৫৩, ব্রিধান-৫৪, ব্রিধান-৬১, বিনা ধান-৮ ও বিনা ধান-১০ সম্প্রসারণ, বন্যাপ্রবণ এলাকায় ব্রিধান-৫১, ব্রিধান-৫২ এবং খরা এলাকায় বিনা ধান-৭ ও ব্রিধান-৩৩, ব্রিধান-৩৯, ব্রিধান-৫৬, ব্রিধান-৫৭, কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয়করণ ও সফলভাবে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। গমের তাপ সহিষ্ণু জাত বারি গম-২৬, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮, বারি গম-৩০ এবং লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাত বারি গম-২৫ সম্প্রসারণের ফলে গমের একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে কারণেও কৃষি সেবাকে সহজে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য  সম্ভব হয়েছে। এ জন্য ‘কৃষি বাতায়ন’ তৈরি করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করা হয়। যে কোনো ফোন থেকে কৃষি কল সেন্টারের ১৬ হাজার ১২৩ নম্বরে যোগাযোগ করে কৃষকগণ কৃষিতথ্য সেবা গ্রহণ করে। এ ছাড়া, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, রাইস নলেজ ব্যাংক, কৃষি প্রযুক্তি ভান্ডার, ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষিতথ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, ফসল উৎপাদনের এলাকা উপযোগী জায়গা নির্বাচনপূর্বক শস্য আবাদের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক অনলাইন ও জিআইএস ভিত্তিক ‘Crop Zoning Website’ এবং ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৫৫টি উপজেলায় মোট ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।
তা ছাড়া রূপান্তরের কৃষিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংক্রান্ত কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় কৃষিতে অসামান্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে অন্তর্ভুক্ত করে ডিপ্লোমা কৃষি শিক্ষার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিখাত উন্নয়নে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৫ বছরে দেশের কৃষিতে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আবার করোনার অভিঘাত মোকাবিলায়ও কৃষিখাত অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা জরুরি। একই সঙ্গে সরকারের ধারাবাহিকতা, শেখ হাসিনার সরকারের ভিশন ২০৪১, এসডিজি, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি-২০১৮, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও ডেল্টাপ্লান-২১০০ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া উচিত। এসব করার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। একই সঙ্গে কৃষিতে অসামান্য অর্জনের নেপথ্যে সত্যিকারের বীর দেশের কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের অবদানেরও যথাযথ মূল্যায়ন দরকার। দরকার কৃষি পণ্যের যথাযথ বাজার মূল্য নিশ্চিত করা।

মোতাহার হোসেন : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

আজকালের খবর/আরইউ