![](https://ajkalerkhobor.net:443/2023/12/10/ak_1702213326.JPG)
ইতোমধ্যে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করেছি। এই অর্ধ শতাব্দীতে অনেক দিকেই আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। তবে জাতির মেরুদণ্ড আমরা সঠিকভাবে মেরামত করতে পারিনি। অর্থাৎ শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারিনি, বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আর তা পারিনি বলেই অবকাঠামোগত উন্নতি সত্ত্বেও আমরা উন্নত দেশের সাথে তাল মেলাতে পারছি না, অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছি।
বেশ কয়েকবার আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। মুখস্থ বিদ্যা, নকল প্রবণতা, নোট-গাইড বই ঠেকানোর জন্যই আনা হয়েছিল সৃজনশীল পদ্ধতি। কিন্তু আমরা কী দেখতে পেলাম? বাস্তবে আমরা দেখছি, নোটবই, গাইড বই লুপ্ত তো হয়ইনি; বরং যে নোটবই ছিল ২৫ ফর্মার, এখন তা হয়েছে ৫০ ফর্মার। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে কোচিং সেন্টার। আর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে গৃহশিক্ষকের রুটিন হয়েছে ক্লাস রুটিনের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকার খবরে দেখলাম, বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা কোচিং বাণিজ্যে লেনদেন হয়। এ পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতির মূল চেতনাটি শিক্ষার্থীদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। না পারার দায় কেবল এই পদ্ধতির নয়, এ দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সমাজের, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের এবং অতি উৎসাহী, অতি যত্নবান অভিভাবকদেরও।
সৃজনশীল পদ্ধতি সফল বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড অন্তরায় সৃজনশীল শিক্ষকের অভাব। সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষকের একটি গুরুদায়িত্ব সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা। যথার্থ সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষকের সৃজনের সামর্থ্যরে ঘাটতি আছে। অধিকাংশ শিক্ষকই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন নোট ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভর করে। কেউ কেউ কম্পিউটার ফাইলে সংরক্ষিত আগের প্রশ্ন কিছুটা পরিমার্জন ও পরিশোধন করে দায়িত্ব সমাধান করেন। এ ছাড়া নোট ও গাইড যারা লেখেন, তারাও তো সবাই যথার্থ সৃজনশীল নন। ফলে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের পর থেকে গতানুগতিকতারই চর্বিতচর্বণ চলছে। অতএব, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছিল তা ব্যর্থ হয়েছে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো মাথায় রেখে শিক্ষা কারিকুলাম-২০২৩ চালু করা হয়েছে। তবে এটা এখনই সব ক্লাশে কার্যকর হবে না। ধাপে ধাপে কার্যকর করা হবে।
অনেকের মতো আমিও মনে করি, বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম একটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত কারিকুলাম, কেরানী হওয়ার শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসার কারিকুলাম, লেখাপড়া শেষ করে আমার সন্তান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অফিসার হয়ে টাকা কামানোর মেশিন হবে এ ধরনের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার কারিকুলাম, নকল ও মুখস্ত বিদ্যাকে ‘না’ বলার কারিকুলাম। এখন যে শিশু, তার কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে কম করে হলেও ২০-২২ বছর লাগবে। বর্তমান বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব। প্রতিনিয়ত অনেক পেশা ও কর্মপদ্ধতি বাতিল হয়ে যাচ্ছে, যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পেশা ও কর্মপদ্ধতি। আমরা যারা এই শতকের শুরুর দিকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলাম এখন দেখতে পাচ্ছি তখনকার অনেক পদ-পদবি নেই। নতুন পদ-পদবি সৃষ্টি করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় সেক্টরেই এটা হচ্ছে। আজ আমরা চিকিৎসা বা প্রকৌশল পেশাকে যেভাবে দেখি ২৫ বছর পর এইসব পেশা যে সেরকমই থাকবে, কর্মপদ্ধতি যে সেরকমই থাকবে তা বলার কোনো সুযোগ নেই। এসব দিক বিবেচনা করে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম ঠিকই আছে। কর্তৃপক্ষ দূরদর্শিতার পরিচয় রাখতে পেরেছেন।
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করছেন। সমালোচনাটা হচ্ছে মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সমালোচনা মন্দ কিছু না। আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমেই অনেক কিছুর ভুল-ত্রুটি বের হয়ে আসে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার চাইতে গুজবই বেশি রটে। অনেকে নিজ স্বার্থের দিক বিবেচনা করে গুজব রটায়। শিক্ষকদের ট্রেনিং বিষয়ক কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেগুলো নিয়ে ট্রল হচ্ছে। সেগুলো সত্য, না মিথ্যা, সেসব ভিডিও কারা বানিয়েছেন, কেন বানিয়েছেন এসব না ভেবেই ট্রল হচ্ছে। গুজবের প্রেক্ষিতে আমি যা বলবো-
ক. ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে মোট বিষয় ১০টি। এর মধ্যে একটি হল ‘জীবন ও জীবিকা’। এই বিষয়ের ৩৬৫ দিনের ক্লাশের মধ্যে মাত্র একদিন রান্না শেখানোর বিষয় রয়েছে। শিক্ষাবিদগণ দেখেছেন যে, একজন মানুষ যদি অন্তত ভাত, ডাল, সবজি, আলুভর্তা, মাছ বা মাংস রান্না করতে পারেন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাস্তব জীবনে তিনি কোনো সমস্যায় পড়বেন না। শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে একদিন একজন বা দুইজনের খাবার রান্না করতে শিখবে। তবে কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বড় আকারে রান্নার আয়োজন করছে। এর সাথে কারিকুলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর এই ভিডিওগুলো অতিরঞ্জিত ক্যাপসন দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে।
খ. যতদূর জানি, কারিকুলাম নিয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার আগে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী প্রশিক্ষণ ৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা। প্রশিক্ষণের কোথাও বা কোনো বইয়ে সাইকেল চালানো, ব্যাঙের মতো লাফানো এসব ছিল না। প্রশিক্ষণকালীন একঘেয়েমি দূর করার জন্য ১০-১৫ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়। এই সময়ে শিক্ষকদের কেউ কেউ গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে, কৌতুক করে মজা করতে পারেন। আর এসব ভিডিও ধারণ করে কোনো অসৎ ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে কারিকুলামের অংশ হিসেবে দেখিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।
গ. ডিজিটাল ডিভাইস শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়ার কোনো নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের নেই। ডিজিটাল ডিভাইস থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করার বিষয় রয়েছে। যেমন আবহাওয়ার পূর্বাভাস শিক্ষার্থীরা গুগল থেকে জানতে পারে। তবে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা নেই। আর এসব অভিভাবকের পূর্ণ তত্ত্বাবধানে থাকবে। মনে রাখতে হবে, অভিভাবগণও এই কারিকুলামের একজন অংশীদার। কেউ কেউ বিদেশি ছেলেমেয়েদের এ্যাপস বা ড্রোন বানানোর গল্প করেন। হ্যাঁ, অনেকে অল্প বয়সে এসব বানিয়ে টাকা-নাম দুটোই কামিয়েছে। আমি যদি আমার সন্তানকে ডিজিটাল ডিভাইসের ইতিবাচক ব্যবহার না শেখাই তো তারা পিছিয়ে পড়বে।
অনেকেই জীবন ও জীবিকা বিষয়টির সমালোচনা করছেন। আমার মনে হয়, তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়টি। শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, খেলাধুলা এসব আছে। স্কুলে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, বন্ধুত্ব, শারীরিক শিক্ষা গ্রহণ করবে এটি তারা কল্পনাই করতে পারে না। এই দেশের অনেকেই এগুলোকে শিক্ষার মধ্যে ফেলে না। অনেকে এসবকে খারাপ শিক্ষা মনে করে। আসলে দীর্ঘদিন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মুখস্থ, গাইড-নোট, কোচিং নির্ভর হওয়ার কারণে প্রজন্ম অনেকটা সংকীর্ণমনা হয়ে গেছে। যতটা সংস্কৃতবান প্রজন্ম আমাদের পাওয়ার কথা ছিল তা আমরা পাইনি। নাচ, গান, অভিনয় তো পরের কথা, আমি অনেক পরিবারেই দেখেছি পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়াকে ভালো চোখে দেখে না। মনে করে, গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়লে ছেলে-মেয়ে খারাপ হয়ে যাবে।
আমাদের শিল্প, সাংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র বিলীন হয়েছে, পাঠাগার বিলীন হয়েছে, শহরাঞ্চলে খেলার মাঠ হতাশাজনকভাবে কমে গেছে, সাহিত্য চর্চা, লিটলম্যাগ আন্দোলন সবই স্তিমিত। এই অবস্থায় মানুষের মনে সংকীর্ণতা বাসা বাধবে সেটিই স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘদিন একটা বৃত্তের মধ্যে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সহজে সেই বৃত্তের বাইরে যেতে চায় না। কিন্তু বৃত্ত থেকে বের হতেই হবে। জাতির পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে।
পরীক্ষায় মান নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমি বলবো, মান নির্ধারণের মান নির্ধারণীটা যেন বিশ্ব মানের হয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট যেন বিশ্বের যে কোনো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্ম প্রতিষ্ঠান বুঝতে পারে।
একটি উন্নত, আধুনিক, বিশ্বমানের শিক্ষা কারিকুলাম তৈরী করা যত কঠিন বাস্তবায়ন করা তার চেয়ে অধিক কঠিন। প্রথমত পর্যান্ত মানসম্মত শিক্ষক থাকতে হবে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টা বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশের অনেক শিক্ষকই দীর্ঘদিন ধরে প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিংমুখি। তাদেরকে এদিক থেকে মুখ ফেরাতে হলে কিছু ব্যবস্থা তো গ্রহণ করতেই হবে। আমি প্রথমেরই বলবো তাদের চাকরির গ্রেডে উচ্চ ও আলাদা বেতন স্কেল তৈরী করার কথা। এতে তাদের সামাজিক মর্যাদাও বাড়বে। সামাজিক মর্যাদা বাড়লে মেধাবিরাও শিক্ষকতা পেশায় আসতে ইচ্ছুক হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্লাশ রুমকে আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ম্যাগাজিন ও দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকতে হবে বিজ্ঞান ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, সমৃদ্ধ পাঠাগার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য একটা হলরুম, ইনডোর খেলার ব্যবস্থা, আউটডোর খেলাধুলার জন্য উপযুক্ত মাঠ ইত্যাদি। প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে হবে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার সাথে। বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখও পালন করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরে অন্তত একবার বইমেলার আয়োজন থাকত হবে। প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত গাইতে হবে যথাযথ ভাবগাম্ভির্য ও সম্মানের সাথে। বিজ্ঞানমেলা, বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হবে। শিক্ষার্থীর রাখতে হবে একটা আনন্দমুখর হাসিখুশি পরিবেশে। কোনো মানসিক চাপ থাকবে না।
ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষকদের পরামর্শ দিতে পারবেন, কিন্তু তাদের ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারবেন না। বিশেষ করে আমাদের গ্রামাঞ্চলে অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত গ্রাম্য মোড়লগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে ঢুকে গিয়ে তাদের মতামত জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন। অনেক সময় রাজনৈতিক শক্তি দেখিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এসব থেকে মুক্ত করতে হবে।
সবশেষে বলবো, কোনো কারিকুলামই শতভাগ শুদ্ধ নয়, চর্চার মাধ্যমে শুদ্ধ করতে হবে। চর্চার জন্য উপযুক্ত উপকরণ ও পরিবেশের ব্যবস্থা করতে না পারলে এই কারিকুলামও ব্যর্থ হবে, যেমন ব্যর্থ হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতি।
আবুল কালাম আজাদ : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ