শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪
নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা ও আমাদের বাস্তবতা
রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রকাশ: সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৭:৪৯ PM
যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম ও পূর্বশর্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। তবে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার কিছু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে। কিছু সর্বজনীন নীতি এবং নির্দেশিকার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রটোকল, ঘোষণা, চুক্তি এবং নানা ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির আলোকে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি তৈরি হবে জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে। নির্ধারিত সময় পরপর এবং প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হবে।

১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই জাতিসংঘের কমিটি মানবাধিকার, ভোটাধিকার এবং নির্বাচন সংক্রান্ত একটি ঘোষণা গ্রহণ করেছে। নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেখানে অনেকগুলো বিষয় গ্রহণ করা হয়েছে। ‘দ্য রাইট টু পার্টিসিপেট ইন পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, ভোটিং রাইটস অ্যান্ড দ্য রাইট টু ইকুয়াল একসেস টু পাবলিক সার্ভিস’- শিরোনামের ঘোষণায় নির্বাচন ও ভোটাধিকার সংক্রান্ত নানা বিষয় উল্লেখ করা আছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য কার্টার সেন্টার ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই-কমিশনারের অফিস একটি কনফারেন্সের আয়োজন করে। সেখানে মূল বিষয় ছিল মানবাধিকার এবং নির্বাচনের মানদণ্ড নিয়ে আলোচনা করা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য কার্টার সেন্টার’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত করার জন্য কাজ করে।

২০১৭ সালে তাদের প্রকাশিত যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন জরুরি, কারণ এর মাধ্যমে সরকারগুলো বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাতে মানবাধিকার রক্ষা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনন্সিটিটিউট (এনডিআই) তাদের এক রিপোর্টে বলছে- এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার যৌথভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং নির্বাচন সংক্রান্ত নানা ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে। এগুলো সম্মান করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বাধ্য। পৃথিবীর নানা দেশে নির্বাচনের নানা পদ্ধতি রয়েছে। এনডিআই বলছে, কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া শতভাগ সঠিক নয়। সব জায়গায় উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তারপরেও কিছু সর্বজনীন বিষয় আছে যার মাধ্যমে বোঝা যায় নির্বাচন কতটা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। যেমন- অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, নির্বিঘ্ন প্রচারণা, স্বাধীন পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যমে সমান সুযোগ, স্বাধীন সংস্থা এবং অন্যান্য বিষয়। নির্বাচন ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের এনডিআই-এর মতে, একটি হচ্ছে ভোটাররা যাতে ঠিকমতো অংশ নিতে পারে। অন্যটি হচ্ছে, যারা নির্বাচিত হতে চায় তাদের অধিকার যাতে ঠিকমতো রক্ষা করা হয়। প্রার্থীদের জড়ো হওয়া কিংবা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে। যুক্তরাষ্ট্রের কার্টার সেন্টার বলছে, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল হচ্ছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে বলা হয়েছে, প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দল ভোটারদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রার্থীরা যাতে ভোটারদের কাছে প্রচারণার জন্য ঠিকমতো পৌঁছাতে পারে সে সুযোগ তাদের দিতে হবে। এজন্য একটি নির্বাচনী পরিবেশ দরকার যেখানে রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা তাদের বার্তা জনগণের কাছে ঠিকমতো পৌঁছে দিতে পারে সেজন্য তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে।

জনগণের সমর্থন পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা যাতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার স্বাধীনতা থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সর্বসম্মত ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রচারণার জন্য দেশজুড়ে প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে যেতে পারে সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। নির্বাচনের প্রতিটি দিক পর্যবেক্ষণের জন্য নাগরিক সংগঠনগুলো যাতে অংশ নিতে পারে সেজন্য অবশ্যই তাদের সুযোগ দিতে হবে। এটি এক অর্থে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস প্রিন্সিপাল অনুযায়ী রাষ্ট্রের সুশাসন এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে অংশ নেওয়া নাগরিকদের অধিকার রয়েছে। হিউম্যান রাইটস পিন্সিপালের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষকদের গুরুত্বের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। ভোট দান এবং গণনার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেটি স্বাধীনভাবে নিরীক্ষা করা উচিত। ব্যালটের নিরাপত্তা এবং ভোট গণনার পদ্ধতির ওপর মানুষের যাতে আস্থা থাকে সেজন্য স্বাধীন পর্যবেক্ষকের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নির্দলীয় পর্যবেক্ষকদের বিষয়টি আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক সনদে উল্লেখ করা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের এনডিআই বলছে, পর্যবেক্ষকরা যাতে নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে যেতে পারেন এবং নির্বাচনের আগে ও পরে তাদের সংশ্লিষ্ট কাজ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। পর্যবেক্ষকরা যাতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে এবং আর্থিক সহায়তা নিতে পারে সেটির অনুমতি দিতে হবে। তবে পর্যবেক্ষকদের হতে হবে স্বাধীন ও নির্দলীয়। সরকার-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যাতে কথা বলতে পারে এবং তাদের সমানভাবে সুযোগ দেওয়া জরুরি।

এ ছাড়া নির্বাচন সংক্রান্ত কাভারেজ সঠিকভাবে দেওয়ার জন্য বেসরকারি গণমাধ্যম যাতে নৈতিকভাবে এবং নির্বাচনের বিধি-বিধান অনুসারে কাজ করে সেজন্য তাদের উৎসাহিত করতে হবে। ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রতিটি প্রার্থী এবং প্রতিটি দল যেন প্রচারণার জন্য গণমাধ্যমে সমান সুযোগ পায় সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জাতিসংঘ কমিটির গৃহীত ঘোষণায় বলা হয়েছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করার জন্য একটি স্বাধীন নির্বাচনী সংস্থা থাকতে হবে এবং নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। গোপন ব্যালটে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভোটাররা যাতে তাদের অধিকার ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। এখানে কোনো ধরণের বিধি-নিষেধ কিংবা বৈষম্য থাকা যাবে না। এবং ভোটাররা যাতে স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে সেটির নিশ্চয়তা থাকতে হবে। কোনো ধরণের ভয়ভীতি, অর্থের প্রলোভন কিংবা কোনো অযাচিত প্রভাব যাতে ভোটারদের ওপর না থাকে। এ ছাড়া ভোট দেওয়ার বার পর ভোটাররা যেন কোনো প্রতিহিংসার শিকার না হয়। নির্বাচনে যেসব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তাদের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য যাতে ভোটারদের কাছে থাকে। যাতে ভোটাররা বুঝতে পারে তারা কাকে ভোট দিচ্ছে। ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। জাতিসংঘ কমিটির ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রার্থীদের এজেন্টের সামনে ভোট গণনা করতে হবে ইত্যাদি অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়েই একটি নির্বাচন পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়-পরাজয়টা বর্তমানে জীবন-মরণ সমস্যা এবং বৈরিতামূলক গোত্রীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে দুটি দলের জন্যই। এদিকে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র চায়। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব দিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করার মতো কোনো দল মাঠে নেই।

সরকারি দল যে অনেক উন্নয়ন করেছে এবং মানুষ তাদের দলে দলে আবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে বলে দাবি করে, সেটিও কতটুকু সঠিক, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা হয়তো কমেছে। এর পরও দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ ধরলেও ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটির বেশি দরিদ্র। তিন কোটি মানুষের অসন্তুষ্টি কম বড় বিষয় নয়। তাই আগামী নির্বাচন ভালোভাবে করার জন্য চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি একটি শক্তিশালী ফ্যাক্টর বটে। কারণ আমাদের উদীয়মান পোশাকশিল্প, সেনাসদস্যদের বিদেশি মিশনে যোগদান এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে ডলার প্রাপ্তি, সিভিল সোসাইটির সমর্থন-এ সবকিছুতেই আমেরিকার প্রভাব রয়েছে। ফলে সেটি ব্যবহার করে ‘সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন’-এর জন্য তারা যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে নির্বাচন ভালোভাবে করার অর্থ কী? এমন অনেক প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ধরা যাক এভাবে একটি কৃত্রিম প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করল। এখন প্রশ্ন-এ ধরনের কৃত্রিম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তখন কোনো ধরনের গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখা দেবে কিনা। অথবা অভ্যন্তরীণ কোনো তৃতীয় শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রশাসনিক শক্তিকে নড়বড়ে করে দেবে কিনা। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত, আমেরিকা, চীন এসব বহিঃশক্তি আমাদের ওপর এ ক্ষেত্রে অনেক ক্ষমতা রাখে। আমেরিকা স্যাংশন আরোপ করলে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং জনগণের রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকলে বা সে রকম পরিস্থিতি ঘটলে হয়তো ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে। তবে সে ধরনের কোনো কিছু করার আগে আমেরিকা চিন্তা করবে এখানে তাদের লাভ কী। আমেরিকা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বা গণতন্ত্র চায়; সেটিতে তাদের খুব বেশি আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

পৃথিবীর অনেক জায়গাতে এ রকম গণতন্ত্রহীনতা চলছে, কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্র। তাদের সঙ্গে আমেরিকা ভালো সম্পর্কও রেখে চলেছে। আমেরিকা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে পারলে বাংলাদেশের জনগণ বা গণতন্ত্র নিয়ে তাদের খুব বেশি মাথাব্যথা থাকবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়-পরাজয়টা বর্তমানে জীবন-মরণ সমস্যা এবং বৈরিতামূলক গোত্রীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে দুটি দলের জন্যই। এ ক্ষেত্রে তাই সহজে কোনো মীমাংসা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে এর একটা স্থায়ী সমাধানে আসা দেশবাসীর চাওয়া। ২০১৮ সালের নির্বাচন খারাপ হলেও চীন ও ভারত সর্বপ্রথম সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তেমনি এবারো যদি একটি একদলীয় নির্বাচন হয়, যদি অন্য দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী দেখায়, তবে ভারত, চীন ও রাশিয়া সরকারকে পুনরায় স্বীকৃতি দিতে পারে বলে মনে হয়। তবে সেই ধরনের একপক্ষীয় নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সাধারণভাবে প্রহসন বলেই বিবেচিত হবে। সুতরাং ভবিষ্যতে কী হবে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে এমন পরিস্থিতিতে যদি নির্বাচন হয়েও যায় তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা সময়ই বলে দেবে।

রায়হান আহমেদ তপাদার : গবেষক ও কলাম লেখক।

আজকালের খবর/আরইউ