বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক ধারায় চলছে না, এটি একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসী পার্টিগুলোর মতো অজ্ঞাত স্থান থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে। আর দলের কতিপয় নেতার নির্দেশে আন্দোলনের নামে দলীয় কিংবা ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা বাস, ট্রেনে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে। এটিই তাদের একমাত্র আন্দোলনের নমুনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার একযুগ ধরে সংবিধান স্বীকৃত নয়। মহামান্য আদালত এটি বাতিল করে দেন। তারপর দুইটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটিতে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও সর্বশেষ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করেছে। বিএনপির কাছে নির্বাচন যাওয়া মানে বিজয়ের গ্যারান্টি দিতে হবে। এটা তো কেউ ভোটের আগে দিতে পারে না। গণতন্ত্রে ভোট তো দিবে জনগণ, একমাত্র জনগণই পারে ক্ষমতায় বসাতে কিংবা ক্ষমতাচ্যুত করতে।
বিএনপির প্রথম দিকের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল, জনসভাগুলোতে দলীয় কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে যখন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন কর্মীরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের নামে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশসহ একাধিক মানুষ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানে আগুন, এমনকি হাসপাতালেও হামলা ভাংচুর করে বিএনপির সন্ত্রাসীরা। এরপর থেকে বিএনপি নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছে, এখন আন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা হামলা করে বাস ট্রেনে আগুন দিচ্ছে। তারপর থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অজ্ঞাত স্থান থেকে রুটিন করে হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করে যাচ্ছে।
বিএনপির হরতাল ও অবরোধে জনজীবনে কোনো প্রভাব ফেলছে না। জনগণ তাদের হরতাল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এজন্য বিএনপি তাদের পুরনো চেহারায় আবার ফিরে এসেছে। বাস, ট্রেন সহ গণপরিবহনে আগুন দেওয়ার কৌশল বেছে নিয়েছে। গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন লাগিয়ে মা-শিশু সহ চারহনকে হত্যা করেছে। মৃত মায়ের বুকে তিন বছরের শিশুর জড়িয়ে ধরার ছবি প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। এর এক সপ্তাহ আগে গাজীপুরের শ্রীপুরের বনখড়িয়া রেললাইন কেটে রাখার কারণে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে একজন নিহত ও দশজন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় দেখা গেছে, গ্রেফতারকৃতরা সকলেই বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। গ্রেফতারকৃতরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, দলের উচ্চপদস্থ নেতৃবৃন্দের নির্দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে রেললাইন কাটা হয়েছিল।
বিএনপি আগুন সন্ত্রাসের মধ্যেই অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। অসহযোগ ও আগুন সন্ত্রাস তো একসঙ্গে চলতে পারে না। বিএনপির কর্মসূচি নির্ধারণে দলের সিনিয়র নেতাদের কোনো ভূমিকা নেই। অনেক ক্ষেত্রে কর্মসূচি ঘোষণার আগে তারা জানেনও না। লন্ডনে পলাতক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কর্মসূচি আসে আর সেটি অজ্ঞাত স্থান থেকে পাঠ করেন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তারেক রহমানের কর্মসূচি পাঠ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘৭ জানুয়ারি ডামি ভোটের খেলা বন্ধ করুন। ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ দায়িত্ব পালনে বিরত থাকুন। সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত রাখুন। ব্যাংকের লেনদেন যথা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় অভিযুক্তগণ মামলায় হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।’
বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করলে জনগণ তো দূরের কথা তাদের নেতাকর্মীরাও এসব উদ্ভট কর্মসূচি আমলে নেয় না। যদি কোনো সরকারি কর্মচারী আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর কোনো কারণে ক্ষুব্ধ হয়েও থাকে তারপরও কি একজন পলাতক আসামির কথায় অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে? যিনি রাজনীতি করবেন না বলে মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন তার কথায় মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে, এমন বোকা মানুষ কি দেশে আছে?
উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারতব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল। বিহারে ক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করলে বহু পুলিশ নিহত হলে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ইতি টানেন। সহিংসতার কারণে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেনি। এরপর ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও পাকিস্তানি শাসক চক্র ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। পার্লামেন্ট অধিবেশন বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিল এবং পহেলা মার্চ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পুরো বাংলাদেশ অসহযোগ আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। পুরো দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল। জনতা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা এক কাতারে এসে রাজপথে শামিল হয়েছিল। পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা মধ্য দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশেও দুইটি অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল। সেসব অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে ডা. মিলন পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সরকারি কর্মকর্তারা অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়, পত্রিকাগুলো ছাপানো বন্ধ করে দেয়। জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে আসে। এবং এরশাদ সরকারের পতন হয়। ১৯৯৬ সালে আরেকটি অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল। খালেদা জিয়ার একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উত্তাল গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সরকারি কর্মকর্তারা রাজপথে নেমে এসে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করেছিল। ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ হয় সরকারি কর্মকর্তারা, সকলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন।
অসহযোগ আন্দোলন ছেলের হাতের মোয়া নয়, ঘোষণা দিলেই বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। একটি অসহযোগ আন্দোলন তখনই সম্ভব হয় যখন সরকারের বিরুদ্ধে সকল শ্রেণী-পেশার ঐক্যবদ্ধ হয়। একজন নেতাকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হয় যিনি জনগণের মধ্যে নিজেকে আস্থাশীল করতে পেরেছেন। বিএনপিতে এমন নেতা কে? যাকে জনগণ বিশ্বাস করবে। একজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আদর্শহীন রাজনৈতিক নেতার কথায় জনগণ রাজপথে নেমে আসবে, এমনটি যারা ভাবেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন।
বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেক আগেই দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাদের একের পর এক অপরিনামদর্শী রাজনৈতিক কর্মসূচি দেশের মানুষের কাছে কোনো আবেদন তৈরি করে না। বিএনপির হরতাল, অবরোধ কিংবা অসহযোগ আন্দোলন যে নামে কর্মসূচি দেওয়া হোক না কেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য জনজীবন বিঘ্নিত করা, মানুষ হত্যা করা। বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু নয়। যাদের স্বাভাবিক আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই, তাদের কথায় সরকারি কর্মকর্তারা সহ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে, এমন প্রত্যাশা শুধু অবাস্তবই নয়, হাস্যকরও বটে। নিজেরা আন্ডারগ্রাউন্ডে পালিয়ে থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া জনগণের কাছে রাজনৈতিক কৌতুক ছাড়া কিছু নয়।
তাপস হালদার : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ। haldertapas80@gmail.com
আজকালের খবর/এসএইচ/আরইউ