শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
বত্রিশ নম্বরে খানিকক্ষণ: প্রথম মৃত্যু অবিনশ্বর জন্ম
তপন দেবনাথ
প্রকাশ: সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৬:২২ PM
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি দেশে যাই। যাওয়ার আগে পরিকল্পনা ছিল কোথায় কোথায় ভ্রমণে যাব। সেই তালিকার মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর পরিদর্শনের নামও ছিল। দূর দূরান্তে সব জায়গায় যাওয়া হলেও ৩২ নম্বরে যাওয়া হচ্ছিল না। বাসা থেকে ৩২ নম্বর খুব দূরে নয়। আজ যাব, কাল যাব করতে করতে সময় যে কখন চলে গেল টেরই পেলাম না। অবশেষে লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে আসার সময় হয়ে গেল। ৩২ নম্বরে যেতে পারিনি এই অতৃপ্তি তাড়া করছিল।

২১ অক্টোবর লস অ্যাঞ্জেলেস রওয়ানা দেওয়ার ঠিক আগের দিন বড় ভাইকে নিয়ে বাজার সওদা করতে কারওরান বাজার গেলাম। সওদা শেষে দেখি হাতে প্রচুর সময় আছে। বলতে গেলে পুরো দিনটাই পড়ে আছে। ভাইকে রিকশায় তুলে দিয়ে বললাম, ‘আপনি বাসায় যান, আমি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরটা একটু দেখে আসি।’
তিনি আমার হাতে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, ‘নিয়ে যাও।’ আমি বললাম, ‘টাকা দিয়ে সেখানে কী করবো?’ ভাই বললেন, ‘যদি কোনো বই পছন্দ হয়!’

বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার দুর্বলতা এবং তার ওপর লেখা বই সংগ্রহের ব্যাপারটা তার জানা আছে। ভাইকে বিদায় দিয়ে একটা রিকশা ডেকে নিলাম। সকাল তখন ১১টা। প্রচণ্ড গরম আমাকে কাবু করে তুলেছে। দীনহীন বেশভূষা আমার। আমি কিনা ছুটে চলছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে।

এক টানেই পৌঁছে গেলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে। দুপাশে ব্যারিকেড দিয়ে পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। ফুটপাত ধরে পৌঁছে গেলাম মূল প্রবেশ পথের কাছে। বাড়ির সামনে বড় বড় গাছ এবং রাস্তায় কোনো যান চলাচল না করায় সুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। মুহূর্তে আমার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গেল। এই অসহনীয় গরমের মধ্যে এখানে এমন শীতলতা বিরাজ করছে ভাবা যায় না। সেলফোনসহ সবকিছু পুলিশ বক্সে জমা দিয়ে যাদুঘরে প্রবেশ করতে হবে। একটি পাকা বেঞ্চিতে বসে বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া ফলটুকু খেয়ে নিলাম। আমি কী খাচ্ছি তা দেখার জন্য একজন পুলিশ এগিয়ে এলেন। আমাকে দেখে পুলিশ বললেন, ‘কি ভাই সকালের নাস্তা করছেন?’

পেয়ারা চিবোতে চিবোতে জবাব দিলাম, ‘জ্বী ভাই।’ তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আমি বোমা চিবোচ্ছি। এর আগে ফুটপাতে বসে বহুবার চা, বিস্কুট, কলা, কেক যেখানে যা পাওয়া যায়- খেয়েছি। শুধু মনে রেখেছি আমি আলাদা কেউ নই। এই শহরেরই একজন। সৌভাগ্য না বলে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে-রুটি রুজির ধান্দা আমাকে দূরে রেখেছে।

শুধু মানিব্যাগ পকেটে রেখে অন্য সবকিছু জমা দিয়ে যাদুঘরে প্রবেশ করলাম। ৯০ দশকে ঢাকা থাকতে একবার গিয়েছিলাম। তখন বাড়িটি এতটা আধুনিকায়ন করা হয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১২ জুন পর্যন্ত এই বাড়ি সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্যকেই এমনকি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ১৭ মে তারিখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনও এই বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ায় বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে মিলাদ পড়তে বাধ্য হন। হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের ঋণে নির্মিত ভবনটির ওই সময় প্রায় ১২ হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় নিলামে চড়ানো হয়। ১৯৮১ সালের জুন মাসের ১২ তারিখে বাড়িটি বুঝে নেওয়ার পর দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘোষণা করেছিলেন ঐতিহাসিক এই বাড়ি হবে জনগণের।

১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়ি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে শুভ উদ্বোধন করা হয়। ৩২ নম্বরের বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ট্রাস্টের অধীনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ছাড়াও শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজ পরিচালিত হয়।

৩২ নম্বরের এই বাড়ি (আসলে ৩২ নম্বর হলো রোড নম্বর, বাড়ি নম্বর ৬৭৭) ইতিহাসে এমন এক জায়গা করে নিয়েছে যে, বাড়ি নম্বরকে ছাপিয়ে একটি বাড়িই রোড নম্বরকে ম্লান করে দিয়েছে। কিছু ঐতিহাসিক বাড়ির খবরাখবর আমরা জানি। যেমন ঢাকার নবাবদের বাড়ি। কিন্তু ইতিহাসে এই বাড়ি এমন এক স্থান দখল করে আছে যে ৩২ নম্বর বাড়িটি বাদ দিয়ে কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাবেন না। এই বাড়ি ঘিরে যত সাহিত্য রচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছেÑ বিশে^র আর কারো বাড়ি বা ভবন এতটা মর্যাদা লাভ করেনি।

বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে বাস করতেন বলেই আন্দোলনের সকল পরিকল্পনা এই বাড়িতেই হতো। স্বাধীনতার ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধু এই বাড়ি থেকেই দিয়েছিলেন। সর্বশেষ পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে এই বাড়িতেই নিহত হন। এই বাড়ি একটি বাড়ি বা স্বাধীনতার সূতিকাগার বললেও কম বলা হবে। আর দশটি বাড়ির মতোই সাদামাটা ৩২ নম্বরের এই বাড়ি। কিন্তু এই বাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গায় ছোঁয়া লেগে আছে সেই মহা মানবের, যার জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেই আমার কেমন যেন গা ছমছম করছিল। এটি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, এটি তার শয়নকক্ষ, মৃত্যুকালে সাদা এই চেক লুঙ্গিটি তার পরনে ছিল, এটি বেগম মুজিবের শাড়ি, ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতের সময় এই শাড়ি তার পরনে ছিল, এটি ছোটছেলে শেখ রাসেলের সাইকেল, এই বৈঠকখানায় বসে বঙ্গবন্ধু যত শলা-পরামর্শ করতেন। সবই আছে, শুধু মানুষগুলো নেই। নরপিশাচেরা স্বাধীনতার স্থপতি ও পরিবারের একেবারে নির্দোষ ও অবোধ শিশু এমনকি গর্ভবতী মহিলাকেও বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। ইতিহাসে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। অভিশপ্ত কাপুরুষই কেবল কোনো অস্ত্রহীন অবোধ শিশু বা অবলা গর্ভবতী নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। পনেরই আগস্টের হত্যাকারীদের চেয়ে কাপুরুষতা পৃথিবীতে বিরল।

দুর্নীতির বরপূত্র, সন্ত্রাসের আইকনরা কোনো কাজ না করেও আলাদিনের চেরাগ ঘষে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। অথচ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী করে ৩২ নম্বরের এই বাড়ির মালিক হলেন এই নিয়ে কিছু সংখ্যক লোক প্রশ্ন তুলেছিলেন। এমনকি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ৩২ নম্বরের বাড়ি গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে জিয়া জাদুঘর বানানোর ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখিয়েছে। জিয়াউর রহমান তো নিজেই একজন জাদুকর ছিলেন। তাকে জাদুঘর বানানোর কী আছে? তিনি যদি জাদুকর না হলে সাধারণ সৈনিক থেকে কী করে দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেন? ছল চাতুরী মিথ্যাচার আর মুক্তিযোদ্ধা নিধন ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন ছাড়া তিনি বাংলাদেশকে কী দিতে পেরেছেন? তার উত্তরসুরীদের মুখে এ কথা বলা বা এ কাজ করা একেবারেই বেমানান নয়। এর বহু নজির রয়েছে।

আমি দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের সূতিকাগারে- যেখান থেকে ইপিআর-এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এই বাড়ির উৎস খোঁজা আমার বিবেচনায় স্বাধীনতাকে এক ধরনের হেয় প্রতিপন্ন করা। যদিও যেহেতু বাড়ির সঠিক ও বৈধ তথ্য আছে, সেহেতু এখানে সামান্য আলোকপাত করা গেল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, বাড়ি-ঘর সংসারের কোন খবরা-খবরই তিনি তেমন রাখতেন না। এ দিকটি সামলাতেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবই। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মাথাগোজার কোনো ঠাঁই ছিল না। কয়েক দফায় সরকারের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সরকারি বাসভবনেই তিনি থাকতেন। ১৯৫৪ সাল বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মন্ত্রী হন। কিন্তু সে সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ কংগ্রেস, তফসিলি ফেডারেশন ও গণতন্ত্রী পার্টি সরকার গঠন করলে সে সরকারের চিফ মিনিস্টার নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান, আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই মন্ত্রীসভার বাণিজ্য, শ্রম, শিল্প ও দুনীর্তিদমনমন্ত্রী। তখন বঙ্গবন্ধুর পিএস ছিলেন নুরুজ্জামান। সেই সময় তিনি মন্ত্রী হিসেবে সপরিবারে থাকতেন আব্দুল গণি রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে। তখনই পিডব্লিউডি থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ব্যক্তিদের প্লট বরাদ্ধ দেওয়া হচ্ছিল। একদিন বঙ্গবন্ধুর সে পিএস পিডব্লিওডি থেকে একটি আবেদন ফরম সংগ্রহ করে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের হাতে এনে তুলে দেন। ফরমটি যথাযথভাবে পূরণের পর দাখিল করেন। আবেদনের পর ১৯৫৭ সালের শুরুতে বেগম মুজিবের নামে এক বিঘার একটি প্লট বরাদ্ধ দেওয়া হয়। যার মূল্য ধরা হয় ছয় হাজার টাকা। নিয়ম মোতাবেক দুই হাজার টাকা পরিশোধ করার পর বাকি থাকে চার হাজার টাকা। বাকি চার হাজার টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু টিবোর্ডের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সেগুন বাগিচায় একটি বাসা তার নামে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারির করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে সেগুন বাগিচার বাড়িটি তিন দিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে বলা হয়। ১৯৫৮ সালের ১৫ অক্টোবর বাড়িটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। টি বোর্ড থেকে প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর জিপটি এবং বাড়ির কিস্তি পরিশোধের জন্য রাখা দুই হাজার টাকা ও বেশকিছু মালামাল রেখে দেওয়া হয়। এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বেগম মুজিব তার সন্তানদের নিয়ে এক অনিশ্চিত ও সমস্যাসঙ্কুল অবস্থার মধ্যে পড়েন। কেননা, তাদেরকে আর তখন কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা তদবীরের পর সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশে মাসিক ২০০ টাকা ভাড়ায় একটি বাড়িতে ওঠেন। কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবের পরিবার যে এ বাড়িতে থাকে তা জানাজানি হয়ে গেল। বাড়ির মালিক বেগম মুজিবকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বললেন। এ বাড়ি ছেড়ে বাধ্য হয়ে তিনি সন্তান সন্ততিদের নিয়ে আবার এসে ওঠেন সেগুনবাগিচার একটি বাসার দোতলায়। ১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্ত হয়ে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কন্ট্রোলার অব এজন্সিস পদে চাকরি নেন। তখনই বেগম মুজিব বুঝেছিলেন, যে কোনভাবেই হোক তাকে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পরই বেগম মুজিবের নামে বরাদ্ধ পাওয়া জায়গাটিতে বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৬০-৬১ সাল থেকেই ধার-কর্জ ও বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতা এবং হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

বঙ্গবন্ধুর এ বাড়িটির নির্মাণকাজ তদারকী করেছিলেন তৎকালীন পিডবি¬উডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও পরবর্তীকালে পূর্ত সচিব মাইনূল ইসলাম। এ বাড়ি নির্মাণের কাজে আর্থিকভাবে ও নানাভাবে সহযোগিতা করেছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও দাপ্তরিক সহকর্মীরা। সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করেছেন বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের নির্বাহী কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের নূরুল ইসলাম। এই নূরুল ইসলাম ‘ক্রস ওয়ার্ড’ লটারি খেলতেন। আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একজন কর্মকর্তা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল তার আত্মীক ও পারিবারিক সম্পর্ক। সে অফিসে ক্রস ওয়ার্ড লটারি খেলা সবার জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। একদিন লটারিতে ব্যবহার করেছিলেন শেখ রেহানার নাম। সেইদিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। এই টাকা তিনি গচ্ছিত রাখেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। বাড়ির নির্মাণ কাজে টাকার সংকট দেখা দিলে নূরুল ইসলাম এই গচ্ছিত টাকা কাজে লাগানোর জন্য অনুরোধ করেন। তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে এ টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তীতে তা যথাযথ পরিশোধও করা হয়। নূরুল ইসলাম যেহেতু এখনো জীবিত আছেন, তিনিই এ ইতিহাসের বাড়ি নির্মাণের সাক্ষী। বাড়ি নির্মাণকালীন কেয়ার টেকার ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার আরজ আলী। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের ঝাউগাছটি এনে দিয়েছিলেন বদরুন্নেছা আহমেদের স্বামী নুরুদ্দিন আহমেদ। বাড়ির জানালার গ্রিল সরবরাহ করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা রংপুরের মতিউর রহমান। কোনোমতে বাড়িটি নির্মাণ কাজ শেষ করে পরিবার পরিজন নিয়ে বঙ্গবন্ধু এ বাড়িতে ওঠেন ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর। একতলা এ বাড়িটিতে তখন ছিল দুইটি বেডরুম। এক রুমে থাকতেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব। অন্য রুমে থাকতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তার পাশে ছিল আর একটি কক্ষ। সে কক্ষটি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই রান্নাঘরেরই এক পাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল একটি ছোট রুম। এ রুমটিকে ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই রুমের আসবাব বলতে ছিল একসেট বেতের সোফা মাত্র।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে টেলিফোনটি প্রথম সংযোগ দেওয়া হয় সেটির নম্বর ছিল ২৫৬১। টেলিফোনটি নিয়ে বেশ মজার গল্প আছে। আইয়ুবের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রায়ই এ টেলিফোনটিতে আড়িপাততো। তাই, শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চাইলে নিজের নাম গোপন করে ‘বালিওয়ালা’ বলে নিজের পরিচয় দিত। আর সিরাজুল আলম খান নিজের পরিচয় দিত ‘ইটাওয়ালা’ বলে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটি তখন তৈরী হচ্ছিল সেহেতু পাকি সামরিক জান্তাকেও এ পরিচয়টি বিশ্বাস করতে হয়েছিল। কেননা বাড়িটি যেহেতু তৈরী হচ্ছে ‘বালিওয়ালা’ বা ‘ইটাওয়ালা’তো পাওনা টাকার জন্য তাগাদা দিতে ফোন করতেই পারে। তাই তারা এই নামে ফোন এলে তেমন আমলে নিত না। একজন স্বল্প আয়ের মানুষ যে ভাবে তিলে তিলে নিজের জন্য একটি মাথা গোজার ঠাঁই তৈরী করে থাকে; তেমনি ভাবে বঙ্গবন্ধু ও তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ৩২ নম্বরের এ বাড়িটিকে তিলে তিলে গড়ে তোলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ বাড়িটি একটা সময়ে এসে হয়ে যায় বাঙালিদের আশা-আকাক্সক্ষা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার বাড়ি। ১৯৭১ একাত্তর সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে হয়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের বীজ রোপন করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণে প্রাণে।

কিন্তু ১৯৭৫ সালে জিয়া ও খুনি ফারুক রশিদদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে এ বাড়িটি আবার চলে যায় জিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে নির্বাসন থেকে ফিরে এলে এই বাড়িটি তিনি ফিরে পান। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যে শেখ হাসিনা সংবাদপত্রে একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের সে নিলাম বিজ্ঞপ্তির তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ছিল। শেখ হাসিনা কাল বিলম্ব না করে ছুটে যান হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের অফিসে। ১২ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধের পর বাড়িটির দখল শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু শেখ হাসিনা তার পৈতৃক এ বাড়িটিকে নিজে বা তার পরিবারের অন্য কেউ ভোগ দখল না করে বাড়িটিকে দান করে দেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের জন্য। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এ বাড়িটির মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন করা হয়।

কমবেশি কয়েকটি জাদুঘরে গিয়েছি। সে হিসেবে ৩২ নম্বরের জাদুঘরকে জাদুঘর না বলে জাতির জনকের দীর্ঘশ্বাসের গুদামঘর বলাই শ্রেয়। হ্যাঁ, যে বাড়িটি হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার বাতিঘর এবং যে বাড়ি থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল, সে স্বাধীনতার স্থপতিকে এ বাড়িতেই তার পরিবার পরিজনসহ ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। কোনো পাষণ্ড পারলো স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির বুকে বুলেট ছুঁড়তে? প্রথম পাষণ্ড নাকি গুলি ছুঁড়তে পারেনি, তার হাত কাঁপছিল। পাশ থেকে আর এক পাষণ্ড গুলি ছুঁড়ে ঝাঁঝরা করে দেয় বাংলাদেশকে। সিঁড়ির উপর লুটে পড়েন গোটা বাংলাদেশ। এরপর তার সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুনন্নেছা মুজিব, বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার সহধর্মিনী সুলতানা কামাল খুকু, ছোট ছেলে শেখ কামাল ও তার নববিবাহিতা সহধর্মিনী পারভীন সুলতানা রোজী যার বিয়ে হয়েছিল মাত্র এক মাস আগে। তখনো তার হাতে মেহেদির রঙ লেগে ছিল। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাই শেখ নাসের, যিনি পাঁচদিন আগে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তা, গৃহকর্মে নিয়োজিত আয়া, বুয়া কেউ রক্ষা পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে।

আমার কাছে সঠিক কোনো তথ্য নেই তবে অনুমান করি সেই প্রত্যুষে সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান, বাড়ির সকলের নয়নের মণি, যে বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে রাখত, বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ সব জায়গায় কাঁপন ধরাতে পারলেও আদরের শেখ রাসেলের কাছে তার বজ্রকণ্ঠ নিচু করতে হতো এবং তার দাবী বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে হতো। যেটা তার বড় চার সন্তানরাও পারতেন না। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সময় শেখ রাসেলের বয়স ছিল এগারো বছর। আমার বয়সের মাত্র কয়েক মাসের বড় শেখ রাসেল। বাড়ির কেয়ারটেকার তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এবং ঘাতকদের চোখের আড়াল করে রাখতেও সক্ষম হন, এক সময় রাসেল আকুতি জানায় ‘আমাকে আপাদের কাছে পাঠিয়ে দিন’। এই আকুতির মর্মার্থ বাংলাদেশ বোঝে কিন্তু দিনের প্রত্যুষেও বাংলাদেশ ছিল গভীর ঘুমে বিভোর। এরপর সে কেয়ারটেকারের কাছে কান্না করে, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো’। একজন নরপিশাচ হত্যাকারী আর একজন নরপিশাচ হত্যাকারীকে নির্দেশ দেয় রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে। অবুঝ রাসেল তখনও জানে না এ বাড়িতে তার আপনজন বলতে আর কেউ বেঁচে নেই। ঘাতকরা কেয়ারটেকারদের কাছ থেকে রাসেলকে ছিনিয়ে নিয়ে লাশের উপর দিয়ে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। এবং মৃত মায়ের কাছেই তাকে হত্যা করে। এই নির্মমতায় কে সেদিন কেঁদেছিল জানি না, তবে বাংলাদেশ কাঁদেনি। নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ।

আমি রাজা বাদশার সন্তান নই। গ্রামের অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু শেখ রাসেল আমার সমবয়সী হওয়ায় কোথায় যেন তার সঙ্গে আমার দূরত্বটা আর থাকে না। আজ থেকে আটচল্লিশ বছর আগে বা আজও যখন ১০-১১ বছরের কোনো দুরন্ত শিশুকে দেখি তখন মনে হয় মানুষ কতটা পাষণ্ড হলে এমন অবুঝ নির্দোষ শিশুর বুকে গুলি চালাতে পারে। তখন নিজের বুকটাই কেমন যেন গুলিবিদ্ধ মনে হয়। আর তখন আরো বেশি গুলিবিদ্ধ হই যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাফাই গায় এবং একে কোনো ঘটনা বলেই পাত্তা দেয় না।

তপন দেবনাথ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।   

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
মার্কিন শ্রমনীতি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করতে পারে: পররাষ্ট্র সচিব
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা-হয়রানি
একদিনে দশটি পথসভা, উঠান বৈঠক ও একটি জনসভা করেন সাজ্জাদুল হাসান এমপি
নতুন বছরে সুদহার বাড়ছে
শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেই আজকের উন্নত বাংলাদেশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রাজপথের আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: মুরাদ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকায় ইসলামী ব্যাংক
ইতিহাসের মহানায়ক: একটি অনন্য প্রকাশনা
নতুন বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
এক দিনে সারাদেশে ২১ নেতাকে বহিষ্কার করল বিএনপি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft