শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ক্ষুদিরাম বসু: এক অসম সাহসী বিপ্লবী
এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৬:২০ PM
ক্ষুদিরাম বসু সম্পর্কে হেমচন্দ্র কানুনগো লিখেছেন, ‘ক্ষুদিরামের সহজ প্রবৃত্তি ছিল মৃত্যুর আশঙ্কা তুচ্ছ করে দুঃসাধ্য কাজ করা। তার স্বভাবে নেশার মতো অত্যন্ত প্রবল ছিল সাহস।’ ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান তাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত ক্ষুদিরাম বসু। যার ফাঁসি গোটা ভারতকে আলোড়িত করেছিল। ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলার মৌবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু, মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। ক্ষুদিরামের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তিনি তার মাকে হারান। এক বছর পর তার বাবারও মৃত্যু হয়। তিনি তার বড়দিদি অপরূপার কাছে মানুষ হন।  ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে তার পিতা  ত্রৈলোক্যনাথ বসু এবং মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর মৃত্যু হয়। এই সময় থেকে তাকে প্রতিপালন করেন তার বড় বোন  অপরূপা। গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর তমলুকের হ্যামিল্টন স্কুলে লেখপড়া করেন। তিন কন্যার পর যখন তার জন্ম হয়, তখন পরিবার-পরিজনের কথা শুনে, তিনি এই পুত্রকে তার বড় বোনের কাছে তিন মুঠি খুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত শিশুটির নাম পরবর্তীতে ক্ষুদিরাম রাখা হয়।

১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত দলে যুগান্তরে যোগদান করেন। ১৯০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে যখন বিপ্লবী নেতা শ্রীঅরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করে জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন। তখন তাদের এই বক্তব্য শুনে ক্ষুদিরাম বিপ্লবে যোগ দিতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ঋষি রাজনারায়ণ বসুর  ভাইয়ের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন।  উল্লেখ্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন তার শিক্ষক। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেদিনীপুরের কলেজিয়েট ভর্তি হন এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি শিক্ষা লাভ করেন।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের দ্বারা ক্ষুদিরাম প্রভাবিত হন এবং পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সত্যেন বসুর গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেন। এই সমিতিতে তিনি আরো কয়েকজনের সাথে শরীরচর্চা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। এই সময় সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য নিজেকে তৈরি করার জন্য, পিস্তল চালনা শেখেন। স্বদেশি আন্দোলনের অংশ হিসেবে, তিনি ইংল্যাণ্ডে উৎপাদিত কাপড় পোড়ানো ও ইংল্যাণ্ড থেকে আমদানিকৃত লবণ বোঝাই নৌকা ডোবানোর কাজে ক্ষুদিরাম অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মেদিনীপুরের এক কৃষি ও শিল্পমেলায় বিপ্লবী পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’ বিলি করার সময়, ক্ষুদিরাম প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, কিন্তু পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন। পরবর্তী মাসে একই কাজ করার জন্য তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন। কিন্তু অল্প বয়সের জন্য তিনি মুক্তি পান। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবীদের গোপন সংস্থায় অর্থের প্রয়োজনে, হাটগাছায় বিপ্লবীরা ডাকের থলি লুট করেন। ধারণা করা হয় ক্ষুদিরাম এই দলের সাথে ছিলেন। এই বছরের ৬ ডিসেম্বর নারায়ণগড় রেল স্টেশনের কাছে বঙ্গের ছোটলাটের বিশেষ রেলগাড়িতে বোমা আক্রমণের ঘটনার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন বলেও ধারণা করা হয়। ক্ষুদিরামের স্বদেশি আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার জন্য, তার জামাইবাবু সরকারি চাকরিতে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। তাই তিনি ক্ষুদিরামকে অন্য আশ্রয়ে যেতে বলেন। এই সময় তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মেদেনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন। এই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে, কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। বিশেষ করে, আলিপুর আদালত প্রাঙ্গনে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড, সুশীল সেন নামক ১৬ বছরের এক কিশোরকে প্রকাশ্য স্থানে বেত মারার আদেশ দেন।

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের পর  পরে কলকাতাস্থ মানিকতলায় মুরারীপুকুরে বারীনকুমার ঘোষের বাগান বাড়িতে একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দলটি গঠিত হয়েছিল। এই দলটি পরবর্তী সময়ে ‘যুগান্তর বিপ্লবী দল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। যুগান্তর বিপ্লবী দলের পক্ষ থেকে ‘কিংসফোর্ড’কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তার কারণে কিংসফোর্ডকে বিহারের মজফফরপুরে বদলি করা হয়। ফলে কিংসফোর্ড’কে হত্যা করার দায়িত্ব পড়ে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের ওপর। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল রাত ৮টার সময় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী রাতের অন্ধকারে, স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়াল থেকে কিংসফোর্ডের গাড়ি ভেবে, একটি ঘোড়ার গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে এই গাড়িতে বসা নিরপরাধ মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা মৃত্যুবরণ করেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে, পুলিশ সমগ্র অঞ্চল জুড়ে তল্লাশি চালাতে থাকে। ক্ষুদিরাম বসু হত্যাকাণ্ডের স্থল থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে ওয়েইনি ১ মে স্টেশনে ধরা পড়েন। এই সময় অপর বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকেও ধরার চেষ্টা করা হলে, তিনি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মঘাতী হন। তিনি বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে নেন। কিন্তু অপর কোনো সহযোগীর পরিচয় দিতে বা কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হননি। ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা অনুসারে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। 

ফাঁসির আদেশ শুনে ক্ষুদিরাম বসু হাসিমুখে বলেন যে, মৃত্যুতে তার কিছুমাত্র ভয় নাই। ফাঁসী কার্যকর করার আগে তার শেষ ইচ্ছা কী জানতে চাওয়া হলে- তিনি বলেন যে, তিনি বোমা বানাতে পারেন। অনুমতি দিলে তিনি তা সকলকে শিখিয়ে দিতে পারেন। বলাই বাহুল্য এই ইচ্ছা ব্রিটিশ কর্মকর্তারা গ্রহণ করেননি। এরপর এর পরিবর্তে দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণের কথা বলা হলে- তিনি তার বোন অরূপাদেবীর সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু তার জামাইবাবুর বাধায় সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। তবে মেদেনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন (নাম জানা যায়নি), তাকে বোনের স্নেহে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি বিপদ মাথায় নিয়ে ক্ষুদিরামের সাথে দেখা করেছিলেন। মজফফরপুর জেলেই ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এই সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর সাত মাস ১১ দিন। ফাঁসির হুকুমের পর জজ ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞাসা করিলেন; তোমার প্রতি যে দণ্ডের আদেশ হইল তাহা বুঝিতে পারিয়াছ? ক্ষুদিরাম হাস্যমুখে মাথা নাড়িয়া জানাইল, বুঝিয়াছি। মজফফরপুর, ১১ আগস্ট ভোর ৬টার সময় ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়।  ক্ষুদিরাম দৃঢ় পদক্ষেপে প্রফুল্ল চিত্তে ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়। এমন কি তাহার মাথার উপর যখন টুপি টানিয়া দেওয়া হইল, তখনও সে হাসিতেছিল। কথিত আছে, হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান অগ্নিযুগের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম বসু। তার নির্ভীক দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ বাংলার যুবসমাজকে বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তার স্মরণে বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস রচনা করেন, ‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।’  অবশ্য কারো কারো মতে এ গানের রচয়িতা চারনকবি মুকন্দ দাস ।  ভারতের স্বাধীনতার পরে এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন লতা মুঙ্গেশকর। ফাঁসি হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ১০ অগাস্ট মেদিনীপুরের নির্ভীক সন্তান ক্ষুদিরাম বসু আইনজীবী সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহর ব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।’ এরপর ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত হলে তার গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্রই জল্লাদকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’- এটাই তার শেষ কথা, যা শুনে চমকে গিয়েছিল জল্লাদও। এমনকি ফাঁসির ঠিক আগে শেষ ইচ্ছা হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি পেলে তিনি তার বোমা বানানোর শিক্ষা ভারতবর্ষের অন্যান্য যুবকদেরও শিখিয়ে যেতে চান।

এস ডি সুব্রত : প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।

আজকালের খবর/আরইউ