জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে অতিমাত্রায় গরম, অতিবৃষ্টি, বিলম্বিত- প্রলম্বিত বৃষ্টি, শীত প্রভৃতির কারণও এ জন্য দায়ি। এমনি অবস্থায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুবাইতে আসন্ন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮) বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য বাস্তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি বা ঝুঁকি নিরসনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রত্যক্ষ হয়নি বিগত কপ সম্মেলনগুলোতে। বরং এ নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ভূমিকায় হতাশ বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ। অথচ উন্নত বিশ্ব অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে জলবায়ু ঝুঁকি তৈরি করলেও ঝুঁকি নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং কার্বন নিঃসরন হ্রাস, ক্ষতি নিরসনে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রতিশ্রুতিও মিথ্যা ফানুসে পরিণত হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছর জাতিসংঘের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’ ( কপ ) এ বিশে^র শিল্প উন্নত দেশ সমূহের সরকার প্রধানরা এসে কার্বন নিঃসরন এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সমূহের ক্ষতি পূরণে প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। অন্যান্যবারের মতো এবারো সংযুক্ত আবর আমিরাতের দুবাইতে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কপ- ২৮ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এমনি অবস্থায় প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রিতে সম্ভব হলে এক দশমিক চার ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখা এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য পৃথক তহবিল গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে জোরালো অবস্থান নেওয়ার দাবি অধিকার ভিত্তিক নাগরিক সমাজের। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তারা এ দাবি জানান। কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলন: সরকার ও নাগরিক সমাজের অভিমত শীর্ষক সেমিনার যৌথভাবে আয়োজন করে ৩১টি সংগঠন ।
সেমিনারে বলা হয়, এই সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি সংগ্রহ ও যাচাই করা হবে, আর এতে সেই চুক্তির অনেক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যর্থতার চিত্র উঠে আসবে। বৈশি^ক উষ্ণতার লক্ষ্যমাত্র এক দশমিক পাঁচের ভেতর রাখা এবং জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ধনী দেশগুলোর সমালোচনা করা হয় সেমিনারে। লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমালোচনা করা হয়। জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলের কাছে সম্মেলনে কয়েক বিষয়ে কিছু সুপারিশ করেন। তা হলো১ ১. কার্বন উৎগীরণকারী বড় দেশগুলোকে ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য উদগীরনের লক্ষ্য নিয়ে তাদের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা পুননির্ধারণ করতে হবে, ২. একটি স্বতন্ত্র লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠন করা, ৩. জলবায়ু অর্থায়নের একটি নতুন ব্যবস্থা যা হবে অনুদান নির্ভর, ঋণ নির্ভর নয় এবং অতি বিপদাপন্ন দেশগুলোকে রক্ষায় বিশেষ সহায়তা দিতে হবে।
সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ দূত সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ইউএনএফসিসিসি’র বর্তমান প্রক্রিয়ার বেশ কয়েকটি ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বলেন, কোথাও কোনো বিষয়ে কোনো একটি দেশ সম্মতি না দিলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এ প্রক্রিয়া সংস্কারের সুপারিশ তার। কারণ বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশ্বকে একটি গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং অর্জিত সাফল্য হ্রাস করছে। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রিতে রাখার লক্ষ্য পূরণের সাম্প্রতিক অবস্থার ওপর বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তথ্য সংগ্রহ খুব জরুরি। সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনাকে বিশাল লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে সীমিত অর্জনসমৃদ্ধ একটি ডুবন্ত জাহাজ হিসেবে উল্লেখ করেন। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই সম্মেলনে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে খুব দায়সারাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা সবাই গ্রহণ করবে।
মনে রাখা উচিত কার্বন নির্গমন হ্রাসকে সামনে রেখেই আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক বিকল্পগুলির ওপর ভিত্তি করে জাতীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু তহবিলের নামে অনেক ঋণ আসছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ঋণের ফাঁদ তৈরি করছে। এমনি অস্থায় জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে কার্বন নির্গমনকারী বড় দেশগুলোর বিরুদ্ধে জলবায়ু কূটনৈতিক লড়াইয়ের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে জন্য একটি কাঠামোগত আইনী ব্যবস্থা দরকার। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বকে বাঁচাতে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে ২০২৫ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানীভিত্তিক শক্তিতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত জলবায়ু বিষয়ক আসন্ন বৈশ্বিক সম্মেলন কনফারেন্স অব পার্টিস ২৮ তে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ দুদিন ব্যাপী ‘মাল্টি স্টেকহোল্ডার কপ-২৮’ প্রস্তুতি কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানেও নানা সুপরিশ ওঠে আসে। তাতে বলা হয়, ‘ফসিল ফুয়েল ফেজ আউট করে পৃথিবীর বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বাতিল করতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানীভিত্তিক শক্তিতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। এ নিয়ে যদি ঐক্যমত হতে পার তাহলে আমাদের জলবায়ু অভিযোজনের ওপর বিশাল প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে এক দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক তাপমাত্রাতে জলবায়ুজনিত কী প্রভাব পড়ছে তা ভাবতে হবে।’ ‘প্রতি বছরই আমাদের অভিযোজন খরচ বাড়ছে। গত বছর তিন দশমিক চার মিলিয়ন ডলার নিজেদের থেকে দেয়া হচ্ছে। এবং এই খরচ প্রতি বছর বাড়ছে। এ ছাড়া জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলারের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো পাবে। কিন্তু এই সংখ্যাটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, এটাকে বিজ্ঞান সম্মতভাবে নির্ধারণ করা জরুরি।’
জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের আবাসিক সমন্বয়কারি গোয়েন লুইস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য বিদ্যমান যে বরাদ্দ রয়েছে, বাংলাদেশের তা অপেক্ষা অনেক বেশি অর্থায়ন প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে খাপ খাওয়ানো ও ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। অবশ্য উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জীবন ও জীবিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে এবং এই কাঠামো প্রণয়ন করা ও একে কার্যপোযোগী করার ক্ষেত্রে জলবায়ু সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় বিদ্যমান বিভিন্ন সম্পদ কাজে লাগানোর পাশাপাশি আরো ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে সরকারকে সহায়তার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে কর্মশালায় চারটি সেশনে কার্বন ট্যাক্স, জলবায়ু অর্থনীতি; জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন; বৈশ্বিক স্টকটেকিং; জীবাশ্ম জ্বালানী যুগ বাতিল করা, বিকল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানীর সম্ভাবনা (জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন), চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি কপ-২৮ এ কীভাবে সিভিল সোসাইটি সরকারের সহায়ক হিসেবে এ প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে পারে সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
আসন্ন কপ-২৮ এ বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, প্যারিস এগ্রিমেন্টে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের রূপরেখা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে বেগবান করার লক্ষ্যে আসন্ন কপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় নেওয়া পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিষ্পত্তিতে আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথম গ্লোবাল স্টকটেক অবশ্যই এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কার্যক্রমের অগ্রগতি মূল্যায়ন, ভবিষ্যৎ উচ্চাকাক্সক্ষা এবং কংক্রিট মাইলফলকসহ সুস্পষ্ট পদক্ষেপ প্রদানের পাশাপাশি অধিক বিপদাপন্ন উন্নয়নশীল দেশসমূহে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এড্রেস করার লক্ষ্যে কপ-২৮ এ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড অপারেশনালাইজ করা’ এবং এর ‘ডিটেইল এরেঞ্জমেন্ট’ ঠিক করার ওপর জোর দেবে বাংলাদেশ। অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য ‘গ্লোবাল গোল অন এডাপটেশন’ এর কাঠামো ঠিক করা এবং ২০২৫ পরবর্তী সময়ে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল অন ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের প্রত্যাশা তার।
অবশ্য প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী প্রতিশ্রুত অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দেওয়ার দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। এই পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের সফলতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই ভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা জরুরি। পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রাপ্ত অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং এ জন্য প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ঢাকায় ইতোমধ্যে সরকারি ও এনজিও সংস্থা সমূহের উদ্যোগে আসন্ন কপ নিয়ে বাংলাদেশের করণীয় এবং বৈশি^ক ফ্ল্যাটফরমে কি ভূমিকা হওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অনেক কিছু পাস কাটানো হয়। ঠিক এবারো হয়তো এর ব্যতিক্রম হবে না। বাংলাদেশ সর্বাধিক জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদেশ হিসেবে কীভাবে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলা করবে, অর্থের জোগান কে দেবে, পরিবেশ ক্ষতির জন্য বেশি দায়ী দেশগুলোর করণীয় কী, এর স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ঠিক করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কার্যক্রমে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ ও প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অর্জনে জ্ঞান, গবেষণা, সক্ষমতা তৈরি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বাড়ানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে আসন্ন কপে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদেশ সমূহের জন্য ইতিবাচক অর্জন বয়ে আনবে।
মোতাহার হোসেন : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
আজকালের খবর/আরইউ