প্রকাশ: শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৮:১৮ PM
একসময় কোনো ঘটনা জানার জন্য আমরা পত্রপত্রিকা অথবা টেলিভিশনের অপেক্ষা করতাম। আজ আমরা সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মুহূর্তেই পেয়ে যাই। প্রযুক্তির সুবিধা বলি আর অসুবিধা বলি এটি কিন্তু সত্যি যে খুব দ্রুত মানুষের মধ্যে কোনো ঘটনা ছড়িয়ে পরার কাজটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলতে খুব প্রচলিত ফেসবুক বা টুইটার ইত্যাদির কথা বলছি। খুব সাধারণ ঘটনাগুলোও আমরা জানতে পারছি এখানে। একসময় যা লোক মাধ্যমে জানাতো হতো অথবা চিঠি দিয়ে জানানো হতো আজ সেটি রীতিমতো স্ট্যাটাস দিয়ে জানানো হচ্ছে। যদি কেউ মারা যায় তাহলে খুব দ্রুত আমরা জানতে পারছি কিন্তু এই মাধ্যমগুলো থেকেই। পোস্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা জানতে পারছি। ফোন করারও দরকার হচ্ছে না। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কিছু কমন সেন্সেরও অবনতি ঘটেছে। শুনতে খারাপ হলেও বাস্তবতা এমনই। এই যে আমরা ফেসবুক ব্যবহার করি সেখানে মন্তব্যের ঘরেও আজকাল তেমন কিছু না লিখে রিঅ্যাক্ট দেওয়া যায়। যেমন খুশির খবর হলে হাসিমুখের ছবি বা খারাপ খবর হলে কান্নার ছবি বা এরকম সব ধরনের সুবিধাই আছে। এই একটি ইমোজির মাধ্যমেই আমরা আমাদের মনের ভাব বলে দিতে সক্ষম হচ্ছি। সমস্যা হলো আমরা অনেকেই জানিই না কখন কোন ইমোজি রিঅ্যাক্ট দিতে হয়! অনেককে দেখেছি যে কারো মৃত্যুর সংবাদেও লাইক দিয়ে রেখেছে! আবার হাসির খবরেও কান্নার রিঅ্যাক্ট দিচ্ছেন অনেকে। প্রথমদিকে আপনাকে আপনার মনের ভাব প্রকাশ করতে হলো দু’এক লাইন লিখে। আজ শুধু লাইক বা অন্য কোনো রিঅ্যাক্ট দিলেই হচ্ছে। আমাদের সময় কম। এই কম সময়ের মধ্যেই কাজ সারতে হবে। কার পোস্টে কয়টা লাইক কমেন্ট পরছে সেটিই ইদানিং প্রেস্টিজ ইস্যু। আবার অবস্থা এমন যে আমি যদি কারো পোস্টে রিঅ্যাক্ট দেই তাহলেই সে আমার পোস্টে রিঅ্যাক্ট দিচ্ছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র গিভ-অ্যান্ড টেকের যুগ। বর্তমান যুগ আমাদের দেশ ফেসবুক নির্ভর। কোনো ঘটনার রসাত্বক বর্ণনা পাই এখানে। পত্রিকায় সে স্বাদ না পাই সেটি পাচ্ছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতিদিন যাই ঘটুক না কেন তা শেয়ার করাটাই আজকের দিনের রীতি। কী খাচ্ছি, কীভাবে খাচ্ছি, কোন পোশাক কিনেছি, কোথায় কোথায় ঘুরছি সবকিছু সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি।
আমরা অনেকেই করোনার ভেতরেও প্রতিদিন নিয়ম করে বাহারি খাবার এবং সেটি খাওয়ার ছবি পোস্ট করেছি। একবারও ভাবিনি আপনার এখানে কোনো বন্ধুর ঘরে খাবার নাও থাকতে পারে। এটি এক ধরনের অভদ্রতা। কিন্তু ওই যে রিঅ্যাক্ট পাওয়ার প্রবণতা! এসব অতি ব্যাবহারের একদিকে যেমন ভালো দিক রয়েছে অন্যদিকে কুৎসিক দিকও রয়েছে। আমরা আমাদের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা বন্ধুদের প্রতিদিনকার কার্যক্রম জানতে পারছি। খুঁজে পাচ্ছি আমাদের হারিয়ে যাওয়া অনেক বন্ধুদের। অনেক দূরে থেকেও আমরা অনেক কাছে থাকতে পারছি কেবল এই ফেসবুকের মাধ্যমে। আবার আমরা এর খারাপ দিকটারও যথাযথ অপব্যবহার করছি। ভালো-মন্দ কত খবর প্রতিদিন আমরা কেবল জানতে পারছি ফেসবুকের কল্যাণে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ‘ভাইরাল’ শব্দটি আমরা অতিমাত্রায় শুনে থাকি। ভালো বা খারাপ দু ধরনের খবরই আজকাল ভাইরাল হয়। ভাইরাল হলো প্রচুর শেয়ার হওয়া বা অনেক ব্যবহারকারীর কাছে বিষয়টি ছড়িয়ে যাওয়া। যদিও এর হাজারো ভালো ভালো দিক আছে। আমাদের পড়ালেখার কাজেও এসব সাইট ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু করছি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদেই আমরা মনের কাব্য ভাব সোজা লিখে দেখাতে পারছি। কোনো পত্রিকা প্রকাশ করুক আর নাই করুক তাতে কার কি! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি। তারপর সেখানে আপনার যারা ডিজিটাল বন্ধু আছেন তারা কেউ লাইক দিচ্ছে, কেউ অন্য কোনো রিঅ্যাক্ট দিচ্ছে আবার কেউ অতি সংক্ষেপে সুন্দর, ভালো, চমৎকার ইত্যাদি লিখে দায় সারছে। এটি কিন্তু করছে যেন আপনি অন্তত চক্ষুলজ্জায় হলেও তার পোস্টে মন্তব্য করেন এটি ভেবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মধ্য দিয়ে পৃথিবী এগিয়েছে। যত নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে ততই মানুষ মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে যন্ত্রিকতায় মগ্ন হচ্ছে। আমরা আজ যন্ত্রের দখলে। চব্বিশ ঘণ্টার একটি বড় অংশই কাটছে যন্ত্রের সঙ্গে। এই যন্ত্র ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই তরুণ। আজকাল কিশোর তরুণদের হাতে হাতে মোবাইল ট্যাব। চোখের মণি সর্বদাই সেসব ডিজিটাল প্রযুক্তির পর্দায় স্থির হয়ে আছে। বাসে, রেলে সবজায়গাই এই এক দৃশ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়েছে। ফেসবুক, টুইটার আবেগ- অনুভূতি জানানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় ফেসবুক। কেউ একজন আত্মহত্যা করছে তার আগে সে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দিচ্ছে। সেসব নিয়ে পরদিন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বলতেও কিছু নেই আজকাল। প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ের সর্বনাশ হচ্ছে এই ফেসবুকের মাধ্যমে। ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো ফেসবুকে আপলোডে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে আদায় করছে টাকা। আবার কেউ কেউ তা ছেড়েও দিচ্ছে। অনেক কিশোরী আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। আমাদের দেশের দৈনিকগুলোতে চোখ বুলালে এর সত্যতা মিলবে।
প্রযুক্তির অন্যসব দিকের মতো এরও ভালো মন্দ দিক রয়েছে। বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। মুহূর্তেই একটি সংবাদ একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করছে প্রতারক চক্র। কারণ সামাজিকভাবে হেয় করার ভয় দেখিয়ে সাধারণত এসব চক্র টাকা আদায় করে থাকে। মান-সম্মানের ভয়ে তাদের সে টাকা দিয়ে দিচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবার। বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলারবাহিনীর নজরদারির বাইরে। অথচ ভালো কাজে ব্যবহার করলে এখান থেকে অনেক কিছুই করা সম্ভব। ফেসবুক ব্যবহার যে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় প্রভাব বিস্তর করছে তা বলাই বাহুল্য। ফেসবুক এদের বই পড়ার আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। যে সময়টাতে তাদের বই নিয়ে পড়ালেখা করার কথা সে সময়টাতে তার ফেসবুকে বা ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত থাকছে অথবা কোনো ছবি আপলোড করতে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ ফেসবুকের মাধ্যমেও কিন্তু লেখাপড়া করা বা পাঠ্যবইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ শেয়ার করে বন্ধুদের সঙ্গে পড়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। তবে সেটি খুব কমই হচ্ছে। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক দিকটাই বেছে নিচ্ছে। তাদের ফেসবুক ব্যবহার কেবলমাত্র সিমাবদ্ধ রয়েছে লাইক, কমেন্ট আর পোক দেওয়াতে। ফেসবুকের কল্যাণে আজকাল আমরা সবাই বন্ধু। মা বাবা ভাই বোন সবাই বন্ধুর কাতারে। ভার্চুয়াল এ ফ্রেন্ড জগতে কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। কেবল লাইক কমেন্ট করতে পারে আর খুব বেশি হলে শেয়ার করতে পারে। ফেসবুকে আমাদের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ ব্যস্ত থাকছে। কাজেই বলা যায় তাদের চিন্তা-ভাবনার একটি বড় অংশ ফেসবুকে ব্যয় করছে।
যেখানে তাদের চিন্তুা চেতনা কোনো সৃষ্টিশীল কাজে হওয়া উচিত সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদনের কাজেই তার বেশিরভাগ ব্যয় হচ্ছে। এটি উদ্বেগজনক বলেই মনে হয়। সব বয়সী মানুষই এখন দিন-রাতের একটি বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডুবে থাকছে। কোনো প্রয়োজন নেই তবু থাকছে। এসব এখন বিনোদনের উৎকৃষ্ট মাধ্যমও। এদের মনোজগত নিয়ন্ত্রণ করাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া বিভিন্ন প্রপাগান্ডা নিউজ আজকাল যেভাবে ভাইরাল হয়ে মানুষের মনে প্রভার ফেলছে তা উদ্বেগের সৃষ্টি করে। ভুইফোড় গজিয়ে ওঠা বহু অনলাইন পত্রিকা মিডিয়ার নাম দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে। সেক্ষেত্রে তারা আশ্রয় নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর। হুট করেই একটি খবর নিজেরা শেয়ার করে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। অনেকক্ষেত্রেই তা বিশ^াসও করে নিচ্ছে। পরবর্তীতে দেখা যায় খবরটি ভুয়া। এভাবে মানুষের মনে কোনো বিষয় নিয়ে খারাপ ধারণা তৈরি করছে। সেক্ষেত্রে যেসব সংবাদ ফেক বা ভুয়া সেগুলো কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা এখন ইচ্ছা করলেই ফেসবুক থেকে দূরে থাকতে পারবো না। কারণ আমরা এতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় আমরা ফেসবুক দেখে পার করি। সুতরাং আমাদের উচিত হবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং সাবধানে থাকা। কোনোভাবেই ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
আজকালের খবর/আরইউ