রবিবার ১৯ মে ২০২৪
বৈশাখী জামার বায়না
ফারুক আহম্মেদ জীবন
প্রকাশ: শনিবার, ৪ মে, ২০২৪, ৩:৩৭ PM
কালু দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে গা-গোসল দিয়ে খেতে বসলে তার ছয়-সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে ময়না কেঁদে কেঁদে বায়না ধরেছে তার কাছে। সে এবার ঈদের পর তাদের গাঁয়ের বৈশাখী মেলায় যাবে। তাই তাকে একটা ঘাগরগাঁথা লাল টুকটুকে কুচি দেওয়া বৈশাখী ফ্রক জামা কিনে দিতে হবে।
আর সেই সঙ্গে একটা লাল পাজামা আর জুতা।
যে জামা-কাপড় পরে সে এবার ঈদ করবে। আর বৈশাখী মেলাতে গিয়ে নাগর-দোলনায় চড়বে।
কালু একজন হতদরিদ্র ভ্যানওয়ালা। যার নিত্য দিন আনা দিন খাওয়ায় জীবন। বলা যায় যে, সে একেবারে ছা-পোষা নিঃস্ব অভাবী গরীব মানুষ। প্রতিদিনের আয়-রোজগারের ওপর যার দাঁড়ির মুখে বেঁচে থাকার মতো, দু’বেলা দু’মুঠো পেটের অন্ন জোটে। কালু সে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে রাতদিন কলুর বলদের মতো খাটে।
কিন্তু খেটে সে কী করবে? দুর্ভাগা যে, তার জীবনে কি আর কখনো দুরাশার অন্ধকার ঘুচে আশার আলো ফোটে?
তবু কালু যে বড় আশাতে বুক বেঁধে নিত্যদিন হাড়ভাঙ্গা ঘাম ঝরানো কঠিন খাটুনি খাটে। এভাবে দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন আসে।
আর কালু সময় গুণতে থাকে। হয়তো কালকের প্রত্যুষে সুভাগ্য আপনা হতে তার ভাগ্যের দুয়ারে এসে ধরা দিবে। সেই আশাতে আবারো প্রতীক্ষা তার একটি নতুন প্রভাতের।
তার নিরাশায় ঘেরা জীবনে আশার বাহক হয়ে যদি কাল প্রভাতে নতুন সূর্য ওঠে সেজন্য।
কিন্তু কালু জানে না, কোনো দুঃখীর কপালে কখনো সুখ নাহি জেটে।
আর তাইতো ময়নার জন্মের পরপরই কালুর স্ত্রী অর্থাৎ ময়নার মা- আয়না বেগমও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লো। জরায়ু আর মূত্রনালীর ইনফেকশনে ভুগছে সে। প্রতিদিন তার জন্য ওষুধ কিনতে হয়
কালুকে।
যাহোক, যেটা বলছিলাম ময়না বৈশাখী জামার জন্য বায়না করেই চলেছে। ময়নার মা- আয়না বললো, মা ময়না বিরক্ত করো না তোমার বাবাকে।
একটু ধীরস্থিরভাবে তোমার বাবাকে খেতে দাও।
ময়না বললো, না আমার জামা কিনে দেবে কিনা বলুক। আবার ময়না কাঁদতে কাঁদতে চোখের নাকের জলে একাকার হয়ে বলতে লাগলো ও বাবা...বাবা...বলো না...আমার জন্য লাল বৈশাখী জামা কিনে দেবে তো?
কালু তার ছোট্ট মেয়েটাকে কী করে বুঝাবে যে, গরীবের কোনো শখ আহ্লাদ থাকতে নেই।
এই পৃথিবীতে গরীবের জন্মই হয়েছে শুধু বুকভরা আশা নিয়ে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে অপূর্ণ স্বপ্নের জন্য দীর্ঘ শ্বাসে হা-হুতাশ করার জন্য।
সে মনের কষ্ট মনেই চেঁপে মেয়ে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দু’চোখের জল মুছে দিয়ে বললো
ঠিক আছে মা, ময়না। তোমার জন্য একটা লাল টুকটুকে কুচি দেওয়া ঘাগর গাঁথা বৈশাখী ফ্রক জামা কিনে আনবো। এবার তুমি খুশি তো? এবার চোখের জল মুছে একটু হাসো দেখি। ময়নার কেবল দাঁত পড়ে দাঁত উঠছে। আবার কিছু দাঁত এখনো ওঠেনি। সে দু’হাত দিয়ে চোখের জল মুছে তার ফোকলা দাঁত বের করে চান্দের আলোঝরা বিশ্বজয়ী হাসি হাসতে লাগলো। আর দু’হাত এক করে তালি দিতে দিতে বলতে লাগলো আহা কী মজা...কী মজা...আমার আব্বু আমার জন্য নতুন লাল বৈশাখী জামা কিনে দেবে।
ময়নার ছোট্ট সে কচি মুখের হাসির কাছে শুধু সাত রাজার ধন কেনো...পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ এক করলেও সে হাসির সমতুল্য হবে না।
কোনোকিছু পাওয়ার আনন্দে অভাবী কোনো পিতার সন্তানের মুখের মুক্তা ঝরানো হাসি কতোটা যে সুখের, কতোটা আনন্দের, কতোটা তৃপ্তিদ্বায়ক তা-কেবল সেই পিতাই জানে।
কালুর স্ত্রী আয়না বললো, মেয়েকে জামা কিনে দিবে তো বললে। কী করে কিনবে? একে-তো নিজেদের খাওয়া জুটছে না। এই অভাবের মধ্যে...
কালু বললো ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা ময়নার মা। দেখবে ঠিক এক উপায় হয়ে যাবে।
মেয়ে ময়না বললো, আব্বু তুমি না খুব ভালো। আর মা আয়নার দিকে ময়না তাকিয়ে বললো মা তুমি খুব পচা। কালু বললো না মা ময়না, ও কথা বলতে নেই। তোমার আম্মুও অনেক ভালো।
ময়না বললো, তাই?  আচ্ছা ঠিক আছে আম্মু তুমিও খুব ভালো। ময়না খেলতে চলে গেলো।
কালু গুছিয়ে সে তার ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সে মনে মনে ভাবছে আজ থেকে তাকে আরো একটু বেশি রাত পর্যন্ত ভ্যান চালাতে হবে। তাহলে তার মেয়ের শখ পূরণ করতে পারবে। এবারের মতো প্রতি বছর তাদের গাঁয়ে বৈশাখী মেলা বসে।
সে দুই তিন দিন দুপুরে বাড়ি না এসে বাড়তি আয়ের জন্য গাঁয়ের পার্শ্ববর্তী মফস্বল শহরে ভ্যান চালাতে লাগলো।
বাড়িতে বউকেও বলে দিয়েছে দুপুরের জন্য তার খাবার রান্না না করতে। দুপুরে কোনো হোটেলেও সে খায় না। খুব বেশি তৃষ্ণার্ত আর ক্ষিদে পেলে একটু জল খেয়ে নেয়। এভাবে সে না খেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে গভীর রাত অবধি ভান চালায় টাকা জমায় তার মেয়ে ময়নার জামা জুতার জন্য। রাত পোহালেই ঈদ। আর ঈদের তিন দিন পরেই বৈশাখী মেলা। আর তাই অনেক রাত পর্যন্ত আজ বাজারের দোকানপাট খোলা।
কালু গভীর রাত পর্যন্ত ভান চালায় শেষে মেয়ে ময়নার জন্য একটা লাল টুকটুকে ঘাগর গাঁথা কুচি দেওয়া ফ্রক লাল পাজামা আর জুতা কিনে বাড়ি ফিরছে। না খেয়ে না দুয়ে শরীরটাও বেশ ক্লান্ত। মাথাটা কেমন যেনো ঘুরছে। চোখে মুখে যেনো অন্ধকার দেখছে সে। দুজন লোক বললো ভাই সামনের মোড়ে নামবো যাবেন? কালু ভাবলো এ পথ দিয়েই তো আমি বাড়ি ফিরবো। যাওয়ার পথে যদি কয়টা টাকা হয় অসুবিধে কী?
সে বললো যাবো উঠেন। মফস্বল শহর ছাড়ায় গাঁয়ের অন্ধকার রোড। ভানের সামনে হারিকেন রাখা। তাতে কোনো রকম পথ দেখার মতো টিপটিপ করে আলো জ্বলছে। হঠাৎ মাঠের মধ্যে আসলে পিছন থেকে যাত্রী বেশে ছিনতাইকারী দুজন চাকু বের করে বললো এই শালা ভ্যান রাখ। দে- তোর কাছে যাকিছু আছে বের কর। কালু তো হতভম্ব। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়ার অবস্থা তার। কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। কালু বললো কে...আপনারা? কী করছেন কী? ওরা বললো আমরা কে বুঝতে পারছিস না? চাকু পেটে ঠেকিয়ে বললো আমরা ছিনতাইকারী শালা। দে- টাকা পয়সা আর যাকিছু আছে দে। কালুর পকেট হাতড়িয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকা পেলো। আর একটা পলিথিনে কিছু ওষুধ আর মেয়ের জন্য কেনা জামাকাপড় জুতা। কালু বললো, এগুলো নেবেন না। এগুলো আমার মেয়ের জন্য কিনা। আর এই টাকাটা আমি দেবো না। আমার মেয়ে ঈদে মিষ্টি কিনে খাবে। ছিনতাইকারীরা বললো, দে, দে, শালা বলছি দে। না হলে কিন্তু একেবারে জীবনে মেরে ফেলবো।
এভাবে ধস্তাধস্তি করতে করতে একজন হঠাৎ চাকু বসিয়ে দিলো কালুর বুকে। কালু চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু মেয়ের লাল বৈশাখী জামা, পাজামা, জুতা ছাড়লো না। কীসের একটা শব্দ আসতে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে গেলো। কালুর নিথর দেহ পড়ে থাকলো পথে।
সকালে লোকমুখে সংবাদ আসতে কালুর স্ত্রী আয়না মেয়ে ময়নাকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হলো। অনেক লোকের সমাগম। পুলিশও আছে। কালুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো স্ত্রী আয়না। তখনো কালুর দু’হাতে বুকের সাথে ধরে রাখা রক্তমাখা মেয়ে ময়নার বৈশাখী লাল জামাকাপড়ের ব্যাগ। ময়না কালুর লাশের উপর আঁচড়া পিচড়ে খেয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো আমি লাল বৈশাখী জামা চাইনে বাবা। তুমি কথা বলো বাবা। কথা বলো বাবা...কথা বলো তুমি। ময়নার অমন আহাজারি করে করে কাঁদতে দেখে তখন উপস্থিত অন্যদের চোখেও জল চলে এলো...।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
ভয়ংকর মিশনে নেমেছে ন্যাটো-সিআইএ
মোবাইলফোন ফেরত নিতে ডিবিতে এসেছিলেন মামুনুল হক
বিএনপির ২০ নেতাকে সতর্ক বার্তা
যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত পুলিশ: আইজিপি
মালয়েশিয়ায় প্রতারণার শিকার বাংলাদেশি শ্রমিকরা পাচ্ছেন আড়াই কোটি টাকা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শাবানার ‘হালচাল’ নওশাদের আফসোস!
দেশজুড়ে বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস, কমবে তাপমাত্রা
২৬ কোম্পানির বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
‘মাগো তুমি চইলা গেলা’ শিরোনামে কবির বাঙালি গান
সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাচনে নিরব বিএনপি, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft