ফারহান আর তার বউ বিপাশা গেছে একটা বিয়ের দাওয়াতে। সেখানে গিয়ে তারা দুজনেই জ্বলছে।
বিপাশা জ্বলছে অন্যের শাড়ি দেখে, ফারহান জ্বলছে অন্যের বউ দেখে। বিপাশা যারই শাড়ি দেখে, সুন্দর লাগে। ফারহান যারই বউ দেখি, হেভি লাগে!
এখন দুজনেই ফারহানার কাজিন জিসানের বউ লামিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহান দেখছে লামিয়ার সৌন্দর্য, বিপাশা দেখছে শাড়ি।
বিপাশা রাগে ফোঁসফোঁস করছে, এমন শাড়ি কিনতে না পারার যন্ত্রণায়।
ফারহান অবশ্য ফোঁসফোঁস করছে না, তবে মাথার চুল ছিঁড়ছে। হায়! এতো আগে তার বিয়ে করার কী দরকার ছিল! সে বিয়ে করেছে ভুটকি, অথচ তার ইচ্ছা ছিল শুটকি বিয়ে করার! আহা! জিসানের বউ লামিয়া কী সুন্দর আর কিউট! একেবারে জিরো ফিগার।
বিয়েতে এসে দু’জনেই উপলব্ধি করছে, তারা ভুল মানুষকে বিয়ে করেছে!
খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর দেখা হয়ে ফারহানের বন্ধু রিফাতের সাথে। বিপাশা অবাক হয়ে দেখলো, রিফাত এখনো যথেষ্ট হ্যান্ডসাম, আর ফারহানের ভুঁড়ি থলথল করছে, যেন ভুঁড়ি নয়, সামনে একটা কলসি নিয়ে হাঁটছে।
রিফাত চলে যাওয়ার পর ফারহান বলল, আগের বউ চলে যাওয়ার পর রিফাত আরেকটা বিয়ে করেছে।
বিপাশা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, আগের বউ গেল কেন?
ওদের মধ্যে এডজাস্ট হচ্ছিল না তাই।
বিপাশা বিরক্ত গলায় বলল, এডজাস্ট না হলেই ছেড়ে যেতে হবে কেন? তোমার সাথেও তো আমার এডজাস্ট হয় না, কই আমি তো ছেড়ে যাই নাই। আমি তোমার মতো ফালতুকে নিয়ে সংসার করছি না?
আমি ফালতু?
অবশ্যই ফালতু। ফালতু দা গ্রেট।
ফারহান আর কথা বলতে সাহস পেল না। দুজনেই মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলো।
বাড়ি ফিরে ফারহানের মনে হলো, এক বনে দুই বাঘ থাকা উচিত না। শত্রুর সাথে সমঝোতা করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ, যেহেতু সারাজীবন একসাথে কাটাতে হবে। আগুনে কেরাসিন ঢেলে ফায়দা কী? বউয়ের সাথে কবে, কে, কোথায় তর্কে জিতেছে!
অতএব আপোষ রফা হয়ে যাক।
কাপড় ছাড়তে ছাড়তে ফারহান বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?
বিপাশা অন্যমনস্ক গলায় বলল, যা খুশি বলো।
ফারহান সাবধান হয়ে গেল। সে বুঝে গেছে, যা খুশি বল মানে হচ্ছে, একবার খালি উল্টাপাল্টা বলে দেখ, খুন্তি নিয়ে এসে এমন দৌড়ানি দিবো না! বউ হচ্ছে দুই প্রকার, কাছের বউ আর গাছের বউ। তার বউ হচ্ছে গাছের বউ। সাধারণ কথার মানে বের করেও জটিল ডালপালা বের করতে পারে, এই বিষয়ে তার পিএইচডি করা আছে। বউয়ের সব কথা বুঝবার মতো বুদ্ধি তার হয় নাই। সে লেখাপড়ায় মেধাবী ছিল না। এমনভাবে সে লেখাপড়া করেছে, জীবনেও কাউকে মিষ্টি খাওয়াতে হয় নাই।
কী হলো? কী যেন বলতে চাইছিলে? বিপাশা তাড়া দিল।
ফারহান বউয়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, না বলছিলাম তোমার কাজিন জিসানের বউয়ের কথা। লামিয়ার কথা বলছো? কী করেছে সে?
শুনেছিলাম তোমার কাজিন নাকি হেভি সুন্দরী বউ পেয়েছে। কই, আমার কাছে তো তেমন সুন্দরী মনে হলো না। কেমন যেন ময়দা সুন্দরী। মুখের ছিড়ি ছাঁদও আহামরি নয়। কী দেখে তোমার কাজিন এমন মেয়ে বিয়ে করলো?
বিপাশা অবাক হয়ে বলল, লামিয়া সুন্দরী নয়?
আমার কাছে তো সুন্দরী মনে হলো না, এরচেয়ে তুমি হাজার গুণ বেশি সুন্দরী। তোমার সাথে ওর যায়? কই রাজরানি আর কই ঘুঁটে কুড়ানি!
জামাইয়ের প্রশংসা শুনে মেয়েরা গলে যায়, বিপাশা গললো না, বরং আরো শক্ত হয়ে গেল। আগে ছিল পানি, এখন হয়ে গেল বরফ। কারণ সে ভালো করেই জানে, স্বামী নামক প্রাণীগুলো মহা ধড়িবাজ। এরা অন্তরে কুমিল্লা, মুখে বরিশাল। এদের কথায় গললেই সোয়া সর্বনাশ। এরা একেকটা বিশ্ব হারামি।
ফারহানা তীক্ষè গলায় বলল, লামিয়াকে তোমার সুন্দরী মনে হয় না? তুমি কী বলছো বুঝতে পারছো? ঠিক আছো তো ব্রো!
ব্রো! স্বামীকে বলছো ব্রো!
অবশ্যই বলছি, আগে জানতাম তোমার বুদ্ধি কম। তোমার যে রুচিও কম এটা আগে তোমাকে কখনো কেউ বলেছে?
না তো!
আমি বলছি শোনো, তোমার রুচি বলতে কিছু নাই। সুন্দর কী জিনিস তুমি জানো-ই না। আমি কী বলছি বুঝতে পারছো তো?
ফারহান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, বুঝতে পারছি। আমার রুচি খারাপ বলেই তো তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করলাম। নইলে কী আর...
ফারহান কথা শেষ করার আগেই দেখে, বউ তার মুখের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। সে ভয়ে বাকি কথা হজম করে ফেললো।
বিপাশা তীক্ষè গলায় বলল, তুমি যে একজন খারাপ মানুষ তা জানতাম এতোটা খারাপ তা জানতাম না। তোমার অন্তরে সদরঘাট, ভেতরে লালমনিরহাট। তুমি আমাকে খুশি করার জন্য এসব বলছো, তাই না?
ফারহান আবাররো মাথা চুলকাতে চুলকাতে চোখ টিপে বলল, আমি খারাপ সেজন্যই তো তোমাকে বিয়ে করলাম, যাতে তুমি টের পাও আমি কতোটা খারাপ। বিয়ে না করলে টের পেতে কীভাবে? খারাপ মানুষ চিনতে হলে তাকে বিয়ে করতে হয়। আর ভালো মানুষ চিনতে হলে তার ফেসবুক পোস্ট ফলো করতে হয়।
বিপাশা রাগী গলায় বলল, একটা কথা মনে রেখো, হঠাৎ বড়লোক হওয়া গেলেও হঠাৎ কিন্তু ভদ্রলোক হওয়া যায় না। এর জন্য পারিবারিক শিক্ষা লাগে। তোমার এমন পারিবারিক শিক্ষা আছে?
ফারহান হাসতে হাসতে বলল, থাকলেও বলে লাভ নাই, কেননা কোনো বউ-ই মনে করে না, তার জামাইয়ের পারিবারিক শিক্ষা আছে।
বিপাশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমাকে নিয়ে এতো বছর যাবৎ কীভাবে সংসার করতেছি আল্লাহই ভালো জানে...
ফারহান এবারও হেসে ফেলল, হাসতে হাসতেই বলল, ভালো জিনিস বেশিদিন টিকবে, এটাই কি স্বাভাবিক না?
কে ভালো জিনিস? তুমি? কাক যদি নিজেকে ময়ূর ভাবতে শুরু করে, তাহলে এটা কাকের মানসিক সমস্যা। সেজন্য সে ময়ূর হয়ে যায় না, বুঝেছো?
এখন কাক বলছো? অথচ, বিয়ের আগে আমাকে তুমি তোমার কলিজা, ফ্যাপসা, গুরদা আর কী কী জানি মনে করতা? তখন তো জান পাখি ময়না পাখি বলতে ডাকতে। হঠাৎ কাক হয়ে গেলাম!
সেটাই তো ছিল মহা ভুল। ভুল মানুষ চয়েজ করেছি।
সংশোধন করতে চাও? নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে চাও?
আরে নাহ! বাঘের গুহায় মানুষ ভুল করে কয়বার ঢুকে? ন্যাড়া কি বেল তলায় বারবার যায়?
সংসার জীবনকে তুমি বাঘের গুহা ভাবছো,তাই না?
সত্যি করে বলো তো, তুমিও কি তাই ভাবছো না?
ফারহান জবাব দিল না।
বিপাশা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আসলে আমরা সংসার জীবনে কেউ সুখী নই কিন্তু সবাই অন্যদেরকে সুখী ভাবি। জিসানও লামিয়াকে নিয়ে সুখী নয়। সেদিন শুনলাম, লামিয়া নাকি জিসানকে পাত্তা দেয় না। অথচ, দেখ, এই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য জিসান কী না করেছে! মনে হয় না, ওদের সংসারটা টিকবে।
ফারহান অবাক হয়ে বলল, বল কী!
বিপাশা আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমরা কেউ নিজেকে নিয়ে সুখী নই, অথচ চাইলেই সুখী হতে পারি। আমাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার চর্চা নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা একে অপরকে সম্মান করছি না। আমরা জীবে শ্রেষ্ঠ না হয়ে জিভে শ্রেষ্ঠ হতে চাইছি। এটাই অনেকের সংসার ভাঙার অন্যতম কারণ।
ফারহানও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ঠিকই বলছো,বউ!