গত ঈদে মেয়েকে কিছুই কিনে দাওনি। সামনে ঈদ আসছে মেয়েকে জামা-কাপড় কিনে দিতে হবে। তুমি ঘরে বসে আছো কোন কাজ নেই। কিছু ভাবছো?
আমার কথা বাদ দাও, সংসারও ঠিকমতো চলছে না। এভাবে আর কতদিন চলবে?
কথাগুলো নমিতা তার স্বামীকে বলছে। স্বামী হোসেন আলী একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে নমিতাকে বললো।
—কী করবো বউ! সাগরেও ঠিকমতো মাছ পাচ্ছি না। মহাজন বললো, মাছ যখন বেশী ধরা পড়বে আমাকে নেবে। সাগরে মাছও উঠছে না মহাজনও ডাকছে না।
—মাছ ধরা বাদ দাও! অন্য চিন্তা কর। মাছের আশায় বসে থাকলে সংসার চলবে না। সেই বিয়ে হবার পর থেকে দেখে আসছি সংসারে অভাব। আর পারছি না। মেয়েকে ঠিকমতো খাবার দিতে পারছি না। এগুলো ছেড়ে বিকল্প চিন্তা করো।
—কী করবো বুদ্ধি দাও, বউ। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
—শহরে যাও! শহরে কাজের অভাব নেই। সেখানে যেয়ে কিছু একটা কর। ঈদ আসতে আরো দুই মাস বাকি। মেয়েটাকে কিছু কিনে দিতে হবে। সংসারও চালাতে হবে। মেয়েকে আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করাতে হবে।
—ঠিকই বলেছো, বউ। এভাবে আর চলছে না। শহরে আমার বন্ধু ফয়সল থাকে তার বাড়িতে যেয়ে তার মোবাইল নম্বরটা এনে কথা বলবো। ফয়সলকে বললে কিছু একটা ব্যাবস্থা হবে।
বিকেলে হোসেন আলী ফয়সলের বাড়িতে গিয়ে ফয়সলের বউয়ের কাছে থেকে ফয়সলের মোবাইল নম্বর নিলো। বাড়িতে এসে ফয়সলের সাথে মোবাইলে কথা বললো।
ফয়সল হোসেন আলীকে দুইদিনের মধ্যে ঢাকায় যেতে বললো। হোসেন আলী ফয়সলের কথায় রাজি হয়ে গেল।
—বউ, ফয়সল বললো, ঢাকায় যেতে। দুই দিনের মধ্যে যেতে বললো।
—কী, কাজ দেবে বলেছে কিছু?
—না, বললো, দুই দিনের মধ্যে যেতে। একটা কাজের ব্যাবস্থা করে দেবে। আর আপাতত আমাকে ফয়সলের কাছেই রাখবে।
—তাহলে যাও। বসে থাকলে চলবে না। আমি এদিক সামাল দেব। তুমি আমাদের নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। ঘরে যা আছে আমরা মা-মেয়ে আপাত চলতে পারবো। আমার কাছে জমানো ৫০০ টাকা আছে তোমার যাওয়ার গাড়িভাড়া হয়ে যাবে।
—তাহলে আমি সকালেই চলে যাব।
—হ্যা, ঠিক আছে। যেতে যেহেতু হবে সকালেই চলে যাও।
সকলে ঘুম থেকে ওঠে হোসেন আলী ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। বিকালে ঢাকায় পৌঁছে নমিতাকে জানালো সে ঢাকায় পৌঁছেছে। রাতে দুই বন্ধু তাদের কিছু অতীত স্মৃতি রোমন্থন করলো। তারপর কাজের ব্যাপারে কথা হলো। আগামীকাল থেকে ফয়সলের সাথে কাজে যাবে। একটি বিল্ডিংয়ের কাজে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করবে। দৈনিক পাচশত টাকা করে মজুরি পাবে। দুই বন্ধু একসাথে কাজ করলো। আপতত হোসেন আলী ফয়সের সাথেই থাকবে। একটি বস্তিতে ফয়সল একটি রুমে থাকে।
পরের দিন কাজ থেকে ফিরে ফয়সলের মোবাইল থেকে হোসেন আলী তার বউকে কাজের কথা জানালো। হোসেন আলী কাজে লেগেছে শুনে নমিতা খুশি হলো। তার স্বামীকে বললো, সাবধানে কাজ করো। নিজের প্রতি যত্ন নিও। প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে হোসেন আলী নমিতা আর মেয়ের সাথে কথা বলে। অবশ্য তার মেয়ের বয়স তিন বছর ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। শুধু বাবা বলতে পারে। পনের দিন পর হোসেন আলী নমিতাকে কিছু টাকা পাঠালো। নমিতা টাকা পেয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনলো। আর হোসেন আলীকে বললো, আমার এখন আর টাকা লাগবে না, সামনে ঈদ ঈদের জন্য টাকা জমা কর।
নমিতা মনে মনে স্বপ্ন দেখতে লাগলো, তার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাবে। হোসেন আলীকে আর মাছ ধরার কাজে রাতের পর রাত সমুদ্রে থাকতে হবে না। নমিতা কখনো হোসেন আলীর মাছ ধরা কাজকে সাপোর্ট করেনি। এবার নমিতার সেই স্বপ্ন বুঝি পূরণ হলো। স্বামীকে মাছ ধরা থেকে ফিরাতে পেরেছে। নমিতা সবসময় চাইতো একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ, তার ও তার মেয়ের একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভাবতো। সাগরের বৈরী পরিবেশে তার স্বামীর মাছ ধরাকে সে কখনো পছন্দ করতো না।
দেখতে দেখতে ঈদ চলে এলো। ঈদের মাত্র আর ক’দিন বাকি। হোসেন আলী আর ফয়সল একসাথে ঈদে বাড়িতে আসবে। হোসেন আলী নমিতাকে এ কথা আগেই জানিয়ে রেখেছে। নমিতাও প্রতীক্ষা করতে লাগলো তার স্বামীর জন্য। এবার তার স্বামী শহর থেকে ফিরবে। এতোদিন সাগরে কাজ করেছে, হোসেন আলীকে সবসময় দেখেছে এক নোংরা অবস্থায়। গায়ে ময়লা, নোংরা জামা আর শরীরে মাছের গন্ধ। আর এখন তার স্বামী ফিরবে শহর থেকে এক অন্যরকম পরিবেশ থেকে।
হোসেন আলী তার মেয়েও নমিতার জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনে রেখেছে। সমুদ্রে কাজ করার সময় স্ত্রী কন্যাকে কিছুই কিনে দিতে পারেনি। সবসময় টানাটানির মধ্যে কেটেছে।
বন্ধু ফয়সলকে নিয়ে নিউমার্কেট থেকে নমিতার জন্য শাড়ি মেয়ের জন্য কয়েক প্রকার জামা কিনে রেখেছে হোসেন আলী। নমিতাকে হোসেন আলী ফোনে জিজ্ঞাসা করলো।
—তোমার আর কিছু লাগবে? তোমার জন্য শাড়ি আর কিছু কসমেটিকস কিনেছি।
—আমার কিছু লাগবে না। মেয়ের জন্য কিনো।
—মেয়ের জন্যতো কিনেছি।
—তোমার জন্য কিনেছো?
—আমার তো কাপড় আছে। ঢাকায় আসার পর কিছু কিনেছিলাম।
—বাড়িতে আসবে কবে?
—আগামীকাল সকালে রওয়ানা দেব?
—ফয়সল ভাই তোমার সাথে আসবে?
—হ্যা, আমরা একসাথ আসবো।
—সাবধানে এসো। দেখেশুনে গাড়িতে ওঠ। এখন ফোন রেখে দেই। অনেক কাজ পরে আছে। লঞ্চে ওঠে ফোন দিও।
—আচ্ছা, ঠিক আছে। রেখে দেই।
পরেরদিন সকালে ফয়সল আর হোসেন রওয়ানা দিল বাড়ির উদ্দেশ্য। সদরঘাট এসে লঞ্চে ওঠলো। লঞ্চে ওঠে নমিতাকে ফোন দিল।
—হ্যালো! লঞ্চে ওঠছো?
—হ্যা, এইমাত্র ওঠলাম।
—কখন ছাড়বে?
—দশ মিনিট পর ছাড়বে।
—এখন নয়টা বাজে। তাহলে তো বারোটার মধ্যেই বাড়িতে পৌঁছতে পারবে।
—হ্যা।
—তাহলে রেখে দেই। ভালোয় ভালো এসে পৌঁছ।
—ঠিক আছে।
নমিতার মনে এক অন্যরকম আনন্দ কাজ করতে লাগলো। অনেকদিন পর স্বামীকে কাছে পাবে। মেয়েকে আদর করে বলতে লাগলো, ‘বাবা আসছে। তোমার জন্য অনেক কিছু আনবে।’
হোসেন আলী লঞ্চের জানালার পাশে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে নমিতার কথা মনে করছে। বহুদিন পর নমিতাকে কাছে পাবে। মেয়েকে দেখতে পাবে। ঘণ্টাখানেক লঞ্চ চলার পর হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার। বিকট শব্দে আকাশ ডাকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় শুরু হয়ে গেল। নদীতে উত্তাল ঢেউ। লঞ্চে চিৎকার শুরু হলো। কান্নাকাটির শব্দ। লঞ্চ কাপছে, এ কাত ও কাত হচ্ছে। বাতাসের একটা পাক এসে লঞ্চটাকে ডুবিয়ে দিলো। মাঝ নদী। দুই শতাধিক যাত্রী। ফয়সল কোনোরকম লঞ্চ থেকে বের হয়ে আসলো। ফয়সল সাঁতার কাটছে আর হোসেন আলীকে খুঁজছে। কোথাও হোসেন আলীকে দেখছে না। নদীতে মানুষের বাচাও বাচাও চিৎকার। ঝড়ের মধ্যে নদীতে উদ্ধার করার লোক নেই। একটু পরে ঝড় থামলে উদ্ধারকারি দল আসলো। নদীতে থাকা জেলেরা আসলো। ফয়সলকে এক জেলের নৌকায় তোলা হল। চারিপাশে লাশ আর লাশ। ফয়সল বন্ধুকে খুঁজছে। অনেককে জীবিত উদ্ধার করা হলো। নদীর পাড়ে লাশ জমা করা হলো। স্বজনরা খবর পেয়ে নদীর কূলে ভিড় জমালো। নমিতা চারঘণ্টা পর তার স্বামী ফিরছেনা দেখে ফোন দিল। ফোন বন্ধ। ফয়সলের ফোন নদীর জলে পরে গেছে। তাই সে বাড়িতে যোগাযোগ করতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোকের ফোন থেকে ফয়সল তার বউকে খবরটা জানালো। ফয়সলের বউ নমিতাকে লঞ্চডুবির কথা বলতেই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ফয়সলের বউকে নিয়ে ঘটনাস্থলে এল। নদীর পাড়ে শত লাশ দেখে নমিতার বুকটা ফেটে গেল। তার স্বামীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি লাশ সে দেখতে লাগলো। তার স্বামীকে জীবিত ও মৃত কোনোভাবেই পাওয়া যায়নি। ফয়সল আর নমিতা নদীর পাড়ে বসে রইলো, হয়তো হোসেনের খুঁজ পাওয়া যাবে। দিনের পর রাত এলো হোসেনকে আর পাওয়া গেল না। ফয়সল ফয়সলের বউ আর নমিতা নদীর পাড়েই রাত কাটালো। পরের দিনও হোসেনের হদিস মিললো না। এভাবে নমিতার আকাশ থেকে ঝরে পড়লো তার স্বপ্নগুলো। বুকের মধ্যে যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলো নমিতা তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। অনিশ্চিত হয়ে গেল তার ও তার মেয়ের অনাগত ভবিষ্যৎ।