শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
এভাবে চলে যেতে নেই
রোকন রেজা
প্রকাশ: শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৩:১৯ PM আপডেট: ৩১.১২.২০২২ ৩:২৯ PM
মিলনের কথা বলার সময় নেই। মমতা ফোন দিয়েই যাচ্ছে। বাম হাত দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে রাখে মিলন। 
ফোন বন্ধ করলেও নানান ঝামেলা। নানান কৈয়িফত। ফোন কেন বন্ধ। চার্জ দাওনি কেন। কী এত ব্যস্ততা! আরো কত কী!
মিলন মতিঝিলের একটা ফুড কোম্পানির এসআর। বিএ পাশ করে যখন অন্য চাকরি-বাকরি আর জুটল না তখন ‘সেফ ফুড’ নামক এই কোম্পানিতে সেলস রিপ্রেজেনটিটিভ হিসেবে যোগদান করল সে।
ফুড কোম্পানি বেতন যা দেয় চাপে রাখে তার দ্বিগুণ। তাই মাঝে মাঝে মিলনের মনে হয় চাকরিটা ছেড়ে দিই। কিন্তু অন্য কিছু না জুটিয়ে হুট করে চাকরিটা ছাড়াও যায় না।
মিলন বেতনের অর্ধেক টাকা বাড়ি পাঠায়। ছোট দুটো বোন রিতা মিতা স্কুলে পড়ে। বাবার সামান্য যা জমিজমা তাতে দুর্মূল্যের এই বাজারে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ।
রাত তখন ১১টা পনেরোর মতো বাজে। সোওরাওর্য়াদী হাসপাতালের পেছনে রেলিঙ-এর পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মিলন চেন খুলে দাঁড়াতেই কাপড়ের একটা ব্যাগ তার চোখে পড়ে। মিলন ভাবে দিনের বেলায় নিশ্চয় মানুষ এদিক দিয়ে যাওয়া-আসা করে। কাজ শেষ করে ব্যাগটা তুলে নেয় মিলন। কিছু ওষুধ, দুটো ইনজেকশনের প্যাকেট, একটা পাউরুটি আর একটা প্রেসক্রিপশন। 
প্রেসক্রিপশন ধরেই মিলন খুঁজে বের করে মমতার মাকে। ওখানেই পরিচয় হয় মমতার সাথে। 
তারপর মিলন বেশ কয়েকবার গিয়েছে মমতাদের বাসায়। কখনো সখনো এটা সেটা সাহায্যও করেছে ওদের। কোম্পানির নতুন বিস্কুট তৈরি হলে দিয়ে এসেছে। মমতার ছোট বোন মায়ার সাথে গল্প করেছে। মায়ার প্র্যাকটিক্যালের খাতা মেচে নিয়ে এসে রাত জেগে ছবি এঁকে দিয়েছে। মমতার মা কিছু আনতে বললে বিনা পয়সায় এনে দিয়েছে। এক শুক্রবারে মিলন প্লাস্টিকের দুটো চেয়ার কিনে আনল। মমতার মা বলল, তুমি খামাখা এতগুলো টাকা নষ্ট করলি।
মিলন বোকার মতো হেসে বলল, না আন্টি কি বলেন! আমিই তো মাঝে মাঝে এসে বসব। গল্প করব আপনাদের সাথে।
মমতার মা কৃতজ্ঞতার চোখে মিলনের দিকে তাকাল। এই দুঃসময়ে আল্লাহই নিশ্চয় ছেলেটাকে পাঠিয়েছে। মায়া লাল চেয়ারটাই এসে বসল। বসে বলল, বাহ, সুন্দর তো!
মিলন একদিন মাটির তৈরি দুটো ফুলের টব নিয়ে এলো। মায়া বলল, মিলন ভাই-টব কেন?
মিলন বলল, তোমাদের এই বাসায় কোনো গাছ-গাছালি নেই। কেমন রুক্ষ রুক্ষ লাগে। টবে ফুলের গাছ লাগাও। ফুল ফুটলে দেখবে কত সুন্দর!
সেই টবে মায়া এখন গোলাপের চারা লাগিয়েছে। তাতে গোলাপ ফুটেছে সাদা সাদা।
মিলনকে পেয়ে মমতার মা যেন একটা ভরসা পেয়েছেন। দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। সেই অস্বস্তি কিছুটা কমেছে। পাড়ার লোকের কাছে গল্প করেছেন মিলন তার ভাইয়ের ছেলে।
মমতার মা মিলনের ঘনঘন আসান কারণটা বোঝে। তাই হাসি হাসি মুখ করে তিনি একদিন বলেন, কিছু কিছু টাকা-পয়সা জমাও মিলন। বিয়ে-সাদি করে সংসার করো। সারাজীবন তো কষ্টই করলে। এবার একটু সুখ পাও কিনা দেখো।
মিলন কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসে। কথাটা মমতাকে বলতেই ঝরনার মতো খিলখিল করে হেসে ওঠে মমতা। মিলন বলে, তুমি একটা চাকরির চেষ্টা করো মমতা।
বাকি কথাটা মিলন আর বলতে পারে না। বলতে পারে না যা বেতন আমি পাই বাড়ি পাঠানোর পর মেচ খরচ দিয়ে আর কিছুই থাকে না। তাই তুমি একটা কিছু করলে...।
কথা শুনে মমতা রহস্য করে হাসে। হেসে বলে, আমার এই লেখা-পড়ায় চাকরি!
মিলন বলে, চেষ্টা তো করে দেখো।
তারপর মিলনই খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞাপন যোগাড় করে আনে। মমতা দুটো এনজিও তে আবেদন করে। 
চাকরির পরীক্ষার দিন মমতাকে মিরপুরে দিয়ে আসে মিলন। মমতা রিটেন পরীক্ষায় টিকে যায়। তারপর ভাইভাও উৎরে যায়। কিন্তু শেষে ২০ হাজার টাকা সিকিউরিটি মানি। মিলন তার অফিস থেকে ২০ হাজার টাকা লোন নেয়। পনেরো দিন পর মমতাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুড়িগ্রাম।
কুড়িগ্রামে মমতা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম ফোনে কথা হয়। দু’মাসেই মিলনের টাকা শোধ করে দেয় মমতা। তারপর মমতার ফোন ক্রমেই বিজি হতে থাকে।
মিলনের মনটা বড়ই খারাপ। আজ তার চাকরি চলে গেছে। গত দু’মাসের টার্গেট সে ফিল আপ করতে পারেনি। প্রতিযোগিতার এই মার্কেটে এই ধরনের লোক কোম্পানি রাখে না।
সকাল বেলা অফিসে আসতেই ম্যানেজার কাওসার নরম গলায় বললেন, শনিবার থেকে তুমি আর কাজে এসো না মিলন। তোমার ওখানে মালিকের একজন লোক আসবে। আর অ্যাকাউন্টসে সতেরো দিনের বেতন জমা আছে। যাবার সময় নিয়ে যেও।
এক কথাতেই চাকরি নট। সকাল বেলাতেই মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। আকস্মিক আঘাতে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিলনের মুখ। অফিস থেকে বেরিয়ে সে ভাবতে লাগল এখন কী করা যায়। রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে মিলনের মনে হলো এখন মমতার কাছে চলে যাওয়া যায়। মমতার কাছে গিয়ে বলা যায় মমতা আজ আমার চাকরি চলে গেছে। আজ আমার বড়ই দুঃখের দিন।
অনেকটা অভিমানেই দু’সপ্তাহ মমতার খোঁজ নেয়নি মিলন। মমতাও যোগাযোগ করেনি। আজ এই চরম দুঃখের দিনে ওর কথাটাই প্রথম মনে এলো মিলনের।
একটা রিকশা নিয়ে মিলন চলে এলো মমতাদের বাসায়। মমতার মা সবসময়ই বিষণ্নমুখে শুয়ে থাকেন বিছানায়। মিলন প্লাটিকের চেয়ারটা সামনে টেনে নিয়ে বসল। মমতার মা নরম ভেজা কণ্ঠে বললেন, কেমন আছো মিলন?
জি আন্টি ভালো আছি। আপনার শরীরটা এখন কেমন?
আমার আর শরীর! ছোট নিশ্বাস ফেলে মমতার তারপর মা বললেন, এখন আগের চাইতে বেশ ভালো।
মিলন দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, মায়া কি বাসায় নেই?
মায়া তো ছিল- উদ্ধিগ্ন চোখে এদিক ওদিক তাকালেন মমতার মা। তারপর কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, মায়া বোধ হয় মোড়ের দোকানে টাকা তুলতে গিয়েছে। মমতা টাকা পাঠিয়েছে।
মিলন মমতার মায়ের চোখের দিকে তাকাল। বার্ধক্যের রোগে ভোগা চোখ এমনিতেই ছলছল করে। মমতার মা স্নেহ মাখা কণ্ঠে বললেন, তুমি আমাদের অনেক উপকার করলে বাবা।
ঠিক সেইসময় মায়া কাগজের একটা ঠোঙা হাতে নিয়ে আচমকা ঘরের মধ্যে ঢুকে ঠোঙাটা পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, মিলন ভাই কেমন আছেন? অনেকদিন আর আসেন না এইদিকে!
মায়াও কেমন দিনে দিনে বড় হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু জেনেও এই রসিকতাটুকুও করলো। মিলন থেমে থেমে নিচু গলায় বলল, এই তো ভালো আছি। কাজের চাপে আর আসা হয় না।
মায়া বলল, মিলন ভাই গরম গরম পুরি এনেছি। দাঁড়ান নিয়ে আসি।
মায়া বেরুতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল-আপনাকে তো বলাই হয়নি আপুর আগের মোবাইলটা হারিয়ে গেছে। আপু বলেছে হারায়নি। বোধ হয় চুরি হয়ে গেছে। আপুর অফিসে একটা চোর আছে। চোরটার নাম কি শুনবেন?
এক নিশ^াসে কথাগুলো বলে মায়া থামল। তারপর কিচেন থেকে মেলামাইনের পিরিচ নিয়ে এলো। মিলন মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জা মাখা হাসি হাসি মুখ করে বলল, তোমার আপু কি আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে?
কাগজের ঠোঙা থেকে পুরি বের করতে করতে নির্বিকার কণ্ঠে মায়া বলল, হ্যাঁ করে। মাঝে মাঝে।
কিনে আনা সস পিরিচে ঢালতে গিয়ে কিছুটা বাইরে পড়ে গেল। হাত দিয়ে মুছে নিলো মায়া। তারপর গ্লাসের পানিতে হাত ধুতে ধুতে বলল, দাঁড়ান-আপনাকে আপুর বিয়ের ছবি দেখায়।
বিয়ে! কথাটা যেন শাবলের আঘাতের মতো বুকের মধ্যে বিঁধে গেল মিলনের। হতভম্ব হয়ে মিলন তাকিয়ে থাকলো মায়ার মুখের দিকে। যেন আচমকা তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এ রকম তো হবার কথা ছিল না। পনেরো দিনের অদেখাতেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল!
মায়া মোবাইল নিয়ে এলো- জানেন এই মোবাইলটা দুলাভাই আমাকে গিফট করেছে। তারপর মায়া ওদের ছবি দেখাল। ছবি দেখাতে দেখাতে অনেক কথা বলল মায়া। দুলাভাই ওই এনজিওরই সেকেন্ড অফিসার। এখানেও এসেছিল একদিন। রাতে থাকেনি। ছুটি নেই। আমার জন্য দুটো থ্রি-পিস, মা’র জন্য দুটো শাড়ি আর দু’মাসের ওষুধ দিয়ে গেছে।
ঘরের মধ্যে লো ভলিউমে ফ্যান চলছিল। মিলন ভেতরে ভেতরে অস্থির হচ্ছিল। ঘামছিল। মমতার মা তখনও পাশ ফিরে শুয়েছিল। 
মায়া পিরিচ ভরে পুরি নিয়ে এলো। মিলন সস দিয়ে গরম গরম পুরি খেল। পুরি খেয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। রাস্তায় তখন হাজার মানুষের ভিড়। মিলন হাজার মানুষের মধ্যে মিশে গেল।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নান্দাইল পৌর সদরে এক রাতে তিন বাসায় চুরি
শিক্ষাবিদ নূরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের ইন্তেকাল
নতুন বছরে জঙ্গি মোকাবিলায় প্রস্তুত র‌্যাব: ডিজি
বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন মারা গেছেন
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা গান
এভাবে চলে যেতে নেই
পরীমনির জীবনটা আমার জীবনের মতো: তসলিমা
নোয়াখালীতে একক আয়োজনে একসঙ্গে ১০ জুটির বিয়ে
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft