মঙ্গলবার ১২ নভেম্বর ২০২৪
নীরব ঘাতক শব্দ দূষণ
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:২১ PM
শব্দ দূষণ বাংলাদেশের শহরগুলোর জন্য একটি বড় স্বাস্থ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের মানুষ বেশিরভাগই শব্দ দূষণের প্রভাবের শিকার। শহরের রাস্তায় যানজট শব্দ দূষণের কারণ। বেশিরভাগ মোটরযান বাস, মিনি বাস, অ্যাম্বুলেন্স, প্রশাসনের গাড়ি এবং ট্রাকের হাইড্রোলিক হর্ন বা উচ্চ শব্দ যুক্ত হর্ন যথেচ্ছাচার ব্যবহার করে, যা বিপজ্জনক। কিছু চালকের কাছে অকারণে হর্ন বাজানোর নেশায় পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ওভারটেকিংয়ের জন্যও হাইড্রোলিক হর্ন যথেচ্ছাচার ব্যবহার হয়। রাস্তায় যানবাহনের হর্ন, নির্মাণ কার্যক্রম, কারখানা এবং লাউড স্পিকারের কারণে শব্দ দূষণ হয়। শব্দ দূষণের কারণে শহর থেকে উপশহরে মানুষ বধিরতা, হার্ট অ্যাটাকসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন। শব্দদূষণে মানুষের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তিন বছরের কম বয়সী কোনো শিশু যদি কাছাকাছি যদি একশ ডেসিবেল শব্দের হর্ন বাজে, তবে শিশুটি শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। রেডিও, টেলিভিশন, লাউড স্পিকার, কল-কারখানার শব্দ এবং বিকট শব্দের কারণেও শিশুর শ্রবণ স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। হাসপাতালের কাছে হর্ন দেওয়া বেআইনি হলেও হাসপাতালের চারপাশে উচ্চ শব্দের হর্ন বাজে।

বাংলাদেশে শব্দ দূষণ বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত। শব্দ দূষণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে শ্রবণশক্তি হ্রাস করে। ব্যক্তি এবং সমাজ স্বীকার করতে চায় না যে শব্দ দূষণ আধুনিকতার উপজাত। শব্দ দূষণ শ্রবণশক্তি নষ্ট করে এবং মানসিক ভারসাম্য হারাতে ভূমিকা রাখে, উচ্ছৃঙ্খল মেজাজ, ফুসফুসকে প্রভাবিত করে, শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিকে বাধাগ্রস্ত করে, পড়াশোনায় উদাসীন করে তোলে, মানসিক চাপ ও রক্তচাপ বাড়ায়, ঘুমাতে এবং মনোযোগ দিতে সমস্যা সৃষ্টি করে, শ্রবণ ক্লান্তি, শ্রবণহীন প্রভাব, কাজের দক্ষতা হ্রাস করে। শব্দ দূষণ শুধু একটি দূষণ নয়, মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি।

শব্দ দূষণের দুটি প্রধান প্রভাব রয়েছে- শ্রবণ এবং অ-শ্রুতি। কানের গুরুতর ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত কেউ সন্দেহ বা অস্বস্তি অনুভব করতে পারে না। শরীরের ওপর শব্দ দূষণের শ্রবণীয় প্রভাব ধীরে ধীরে এবং নীরবে মানুষকে হত্যা করে। উচ্চ শব্দের শারীরিক অন্যান্য প্রভাবের মধ্যে রয়েছে পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া, রক্তনালীর সংকোচন, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি। এটি আমাদের সিস্টেমে অ্যাড্রেনালিন এবং স্ট্রেস হরমোন, কর্টিসল বৃদ্ধির কারণে ঘটে। ধ্রুবক চাপ মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে প্রভাবিত করতে পারে, কারণ সংবেদনশীলতা পরিবর্তিত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি অসুস্থতার প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি। বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ইত্যাদি জীবনকে দুর্বল করে দেয়। বিশেষ করে ২০-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এর প্রভাব বেশী। প্রায় ছয় জনের মধ্যে এক জন একটি সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। যেকোনো ধরনের শব্দ দূষণ গর্ভবতী মায়েদের মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। বড় বিমানবন্দরের কাছাকাছি বসবাসকারী গর্ভবতী মায়েরা অন্যান্য স্থানে বসবাসকারীদের তুলনায় বেশি পঙ্গু, বিকৃত এবং অপরিণত শিশুর জন্ম দেন।

শব্দ দূষণ ঘুম নষ্ট করে কারণ মানুষ চোখ বন্ধ করতে পারে কিন্তু কান না। যদি কেউ হালকা ঘুমান, তবে শব্দ তার জন্য আরো বেশি বিপজ্জনক হতে পারে কারণ এটি কেবল তার স্বাস্থ্যের সমস্যাই করে না বরং তার ঘুমকেও ব্যাহত করে। সঠিকভাবে এবং পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় এবং গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আজকের বর্তমান প্রজন্ম উচ্চ শব্দে আসক্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু তারা শব্দের স্বাস্থ্যের প্রভাব সম্পর্কে অসচেতন। জোরে হর্ন এবং উচ্চ শব্দের মিউজিক তাদের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু এই শব্দ দূষণ তাদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটাতে পারে- ক্রমাগত শব্দের কারণে তারা আরও খিটখিটে, হিংস্র এবং রাগান্বিত হয়ে ওঠে। তারা ফোকাস করতে এবং মনোনিবেশ করতে অক্ষম হয়ে উঠে। তারা ভুল করতে বা ভুলে যেতে শুরু করে। এটি কেবল দৈনন্দিন জীবনেই বিপর্যয় সৃষ্টি করে না বরং মানসিক চাপের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতে পারে, যার ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। গুরুতর বিষণ্নতা সর্বাধিক প্রচলিত কারণ- আত্মহত্যা এবং ইস্কেমিক হৃদরোগ। শব্দ দূষণ মানসিক জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন, খাদ্য নালী এবং পাকস্থলীকেও প্রভাবিত করে।

মানুষ সাধারণত ১৫ থেকে ২০ কিলোহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি শব্দ শুনতে পায়। শব্দের তীব্রতা ডেসিবেল ইউনিটে পরিমাপ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সাধারণত ৬০ ডেসিবেল শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করতে পারে এবং একশ ডেসিবেল শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। দুঃখজনক হলো,  ঢাকার যেকোন ব্যস্ত রাস্তার আনুমানিক ৬০-৮০ ডেসিবেল, গাড়ির শব্দ ৯৫ ডেসিবেল, লাউডস্পিকার ৯০ থেকে একশ ডেসিবেল, কল-কারখানা ৮০-৯০ ডেসিবেল, রেস্টুরেন্ট ও সিনেমা হল ৭৫-৯০ ডেসিবেল, উৎসব ৮৫-৯০ ডেসিবেল, স্কুটার বা মোটরবাইক ৮৭-৯২ ডেসিবেল ট্রাক, বাস ৯২-৯৪ ডেসিবেল । উচ্চ শব্দের অন্যান্য উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে সঙ্গীত কনসার্ট একশ ১০ ডেসিবেল, মাথার উপরে উড়ন্ত বিমান একশ পাঁচ ডেসিবেল, কোলাহলপূর্ণ শহুরে এলাকার সাধারণ গুঞ্জন ৮০ ডেসিবেল, একটি ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা ৬৫ ডেসিবেল । বায়ু ও পানি দূষণের সমস্যা মিডিয়াতে যেভাবে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায় শব্দ দূষণ সেভাবে প্রকাশ পায় না এবং মানুষের মধ্যেও সচেতনতার অভাব। পরিবেশবাদীরা বা এনজিওগুলোও শব্দ দূষণের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে যথেষ্ট সোচ্চার নয়। শোবার ঘরে ২৫ ডেসিবেল, ডাইনিং বা ড্রয়িং রুমে ৪০ ডেসিবেল, অফিসে ৩৫-৪০ ডেসিবেল, ক্লাস রুমে ৩০-৪০ ডেসিবেল, লাইব্রেরিতে ৩৫-৪০ ডেসিবেল, হাসপাতালে ২০-৩৫ ডেসিবেল, ৪০-৬০ ডেসিবেল রাতে একটি রেস্টুরেন্ট এবং ৪৫ ডেসিবেল শহরে শব্দ এই সীমা ছাড়িয়ে গেলে শব্দ দূষণ হয়। ৪৫ ডেসিবেল শব্দের সাপেক্ষে, গড় ব্যক্তি ঘুমাতে পারে না। একশ ২০ ডেসিবেলে কানে ব্যথা হয় যখন শ্রবণ ক্ষতি হয়।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) এক প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দ্বারা নির্ধারিত ৫৫ ডেসিবলের অনুমতিযোগ্য সীমার বিপরীতে, ঢাকায় শব্দের মাত্রা কমপক্ষে দ্বিগুণ, একশ ১০ থেকে একশ ৩২ ডেসিবেল। এটা বলা বিচিত্র নয় যে যারা গ্রামাঞ্চলে বাস করেন তারা শহরের বাসিন্দাদের তুলনায় বেশিদিন বাঁচার প্রবণতা রাখেন কারণ গ্রামে শব্দ কম হয়। শব্দ দূষণের ধ্রুবক এক্সপোজারের কারণে আয়ু কম হয় এবং শহরাঞ্চলে দীর্ঘায়ু নিশ্চিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ লোকেরা তাদের বৃদ্ধকালে গ্রামে অবসর নিতে পছন্দ করে। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা কেবল দীর্ঘজীবী হয় না, তারা স্পষ্ট শুনতে পায় কারণ তাদের কান শব্দ থেকে দূরে থাকে। এটি একটি নির্দেশক যে একটি কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ নেতিবাচকভাবে জীবনকালকে প্রভাবিত করে। একটি কোলাহলহীন বা শান্ত পরিবেশ কর্মক্ষেত্রে বর্ধিত উৎপাদনশীলতা, চাপ থেকে মুক্তি, সুস্বাস্থ্য, সুখ, উন্নত বুদ্ধিমত্তা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে পূর্ণ একাগ্রতা নিয়ে আসে।

একটু সচেতনতা অবলম্বন করলেই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা যদি নিজেদের সম্পর্কে একটু সচেতন হই, তাহলে আমরা ভুক্তভোগী হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি; বাড়িতে ব্যবহৃত টিভি এবং মিউজিক সিস্টেমের ভলিউম নিয়ন্ত্রণ করুন। অপ্রয়োজনে অস্বাভাবিকভাবে গাড়ির হর্ন বাজাবেন না। লাউডস্পিকার ব্যবহার করবেন না। বিয়ের মিছিলে ব্যান্ড বাজানো বন্ধ করুন, পটকা ফাটা বন্ধ করুন। সমস্ত শব্দ দূষণ আইন মেনে চলার বিষয়ে কথা বলুন। যতদিন মানুষ অতিরিক্ত হর্ন ব্যবহার করার অভ্যাস ধরে রাখবে, ততদিন পরিস্থিতি বদলাবে না। আমরা যদি হাসপাতাল, আদালত এবং স্কুলের কাছে কম শব্দের মাত্রা বাধ্যতামূলক করে এমন আইন প্রয়োগ করি, তাহলে শব্দ দূষণের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে। একটি সংস্কৃতি যা আমাদের অনুশীলন করা দরকার। ক্রমাগত প্রচারণা এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচীই একমাত্র উপায়।

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক। 
আজকালের খবর/আরইউ