শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪
মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলাদের অবদান
এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৩:৪১ PM
একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূ-খণ্ডের জন্য, লাল সবুজের পতাকার জন্য এদেশের আপামর জনতা নেমেছিল মরণপণ যুদ্ধে। সে যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও রেখেছে অসামান্য অবদান।

এ দেশের নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে  নারীরা  সংবাদ  আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, খাদ্য ও আশ্রয়দান  করেই ক্ষান্ত হয়নি, নারীরা গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করে  মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে। যুদ্ধে জয়ে নারীর অবদান যুগে দেশে দেশে বিদ্যমান।  এর ব্যতিক্রম ছিল না আমাদের  মহান মুক্তিযুদ্ধেও। নারীরা  নেপথ্যে যেমন  শক্তি-সাহস যুগিয়েছে  তেমনি সন্মুখ সমরেও অংশ নিয়েছে। আমাদের মহান    মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান। এ দেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল। ছিনিয়ে এনেছিল পরম আরাধ্য কাক্সিক্ষত  স্বাধীনতা।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্ব থেকেই নারীর অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যুদ্ধের  শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অকুতোভয়  সাহস আর দৃঢ় মনোবল  নিয়ে তারাকাজ করেছিল দেশমাতৃকার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের  গেরিলা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা সংগ্রামী নারী সমাজে    যুগে যুগে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাসে।
মুক্তিযুদ্ধের একজন গেরিলা নারী বীরপ্রতীক তারামন বিবি। কুড়িগ্রামে তারামন বিবির যুদ্ধজয়ের গল্পগাথা আজও শিহরিত করে এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে এবং এ প্রজন্মের মানুষদের।

মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা নারী যোদ্ধা তারামন বিবি বীরপ্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রাঁধুনি হিসেবে যোগ দেন। রাজীবপুর ওয়ার ফিল্ডে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করেন এ গেরিলা। একের পর এক অ্যাসাইনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানস্থল কোদালকাঠি ইউনিয়নে ঢুকে যেতেন। রাতের বেলা পাকিস্তানি সেনা শিবিরের কাছাকাছি ঢুঁ মেরে বের করে আনতেন সব হাঁড়ির খবর। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকিস্তানি সেনা শিবিরে হামলা চালায়। এ ছাড়া ওই রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরুর আগে তারামন বিবি অসংখ্য বাঙালি পরিবারকে পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে নিরাপদ স্থানে আনার অ্যাসাইনমেন্টেও অংশ নেন।

তারামন বিবির মতো স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন আরো অনেক নারী।  কাঁকন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা, বেগম  ফোরকান, আলমতাজ বেগম ছবি, আলেয়া বেগম, বীথিকা বিশ্বাস, শিশির কণা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নারী গেরিলাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে বেগম ফোরকানের কথা । তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রথম গেরিলা স্কোয়াড। তার নেতৃত্বে প্রথম দলে ছিলেন আটজন। তারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। নারীদের গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে শতাধিক নারীকে নির্বাচিত করা হয়। প্রথমে তাদের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয় এবং তাদের মধ্যে সুইসাইড স্কোয়াডের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুদ্ধে যান আমাদের আরেক নারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আশালতা বৈদ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গেরিলা দলকে। ৩৫০ নারীকে নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বেও ছিলেন এই সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানায় সাব- সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। হেমায়েত বাহিনীতে মহিলা বাহিনী নামে আলাদা একটি বাহিনী গঠন করা হয়। এ মহিলা বাহিনীতে মোট ৩৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বিশাল নারী মুক্তিযোদ্ধার বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য। পূর্বাঞ্চলীয় হাইকমান্ড শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আ স ম আবদুর রব কিশোর-তরুণ নেত্রীদের গেরিলা ও সুইসাইড স্কোয়াডের আধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন লেম্বুচোরা ক্যাম্প, আগরতলায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আরেক মহীয়সী নারী  সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গোবরা ক্যাম্প’ চালু হয়েছিল। সেই ক্যাম্পে নারীরা অস্ত্র চালনা শিখতেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ৩০০ তরুণী ও কিশোরী সংগঠক গোবরা ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। ‘গোবরা ক্যাম্প’-এ মেয়েদের দেওয়া হতো তিন ধরনের ট্রেনিং- ১. সিভিল ডিফেন্স, ২. নার্সিং, ৩. অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। জানা যায়, নারী যোদ্ধাদের জন্য অনুরূপ আরও তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে।

বরিশালের মুলাদী উপজেলার কুতুব বাহিনীতে করুনা বেগম অন্য মহিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন। এ বাহিনীর অধীনে ৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ছদ্মবেশে শত্রু ছাউনির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অপারেশন চালিয়েছেন। এ ছাড়াও স্টেনগান, রাইফেল চালানো এবং যে কোনো ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এক সময় পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলেছিল ওই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। সাত-আট দিন অবরুদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। পিরোজপুর জেলার অপারেশন স্বরূপকাঠি বাহিনীর অকুতোভয় দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস এবং শিশির কণা গ্রেনেড চার্জ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গানবোট। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতরে কচুরিপানায় মিশে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছিলেন লঞ্চের গায়ে। ছুড়ে মেরেছিলেন গ্রেনেড। পিরোজপুরে অখ্যাত গ্রামের নারীরা হয়ে উঠেছিলেন একেকজন দুর্ধর্ষ গেরিলা। বীথিকা গেরিলা ও গুপ্তচরবৃত্তির ট্রেনিং দেওয়ার জন্য নারীদের সংগ্রহ করে আনতেন। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ নারীকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডের ইউনিট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাইফেল, বন্দুক, এসএমজি, এসএলআর সবকিছু চালানোতেই সমান পারদর্শী ছিলেন আলেয়া। শত্রুপক্ষের শক্তি ও অবস্থান বুঝে তাদের মোকাবিলা করার জন্য এসব সমরাস্ত্র হাতে নিয়ে ছুটতেন তিনি। তিনি ভারতের চাপড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে যুদ্ধ কৌশল ও সমরাস্ত্র চালানো শেখেন। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে দাঁড়িয়েও বীর  বিক্রমে লড়েছেন  আমাদের নারীরা। কিন্তু  মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের প্রাপ্য মূল্যায়ন হয়নি আমাদের দেশে। ১৯৭১ সালে এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় দুই দশকজুড়ে এ দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান এখনো পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন হয়নি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে শত শত নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি এবং গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিলেও এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছেন খুব কম সংখ্যক  নারী।

আজকালের খবর/আরইউ