জীবন মানেই এখন এক অন্তহীন মাঠে দৌঁড় প্রতিযোগিতা, টিকে থাকার লড়াই।জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে আমরা কতভাবে সময় পার করি, দেখতে দেখতে আরও একটা পুজো চলে গেল। আচ্ছা ; কেন আমরা মানে এই বাঙালিরা বছর ভর অপেক্ষায় থাকি এই কাঙ্খিত শারদীয়া উতসবের জন্য? এই কটা দিনের অপেক্ষায় কেন আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি? কারণ উতসব আমাদের ভালো লাগে। কত রঙ, ঢাকের বাদ্যি, ধূপের গন্ধ, আলোর রোশনাই, অঞ্জলি, সবাই একসঙ্গে প্রার্থনা, - সবই তো পুজোর অঙ্গ। সবকিছুই তো নিজের পরিবার স্বজন বন্ধুর মঙ্গল কামনার জন্য।
আমার এই পজিটিভ পরিবেশ টা খুব উপভোগ করি। ঘোর আস্তিক না হয়েও এই প্রশান্তি মন লে বড় আরাম দেয়। ছোটোবেলার পুজোর উন্মাদনা অন্য রকম ছিল এক্কেবারে। নতুন পাটভাঙা শাড়ি - কপালে টিপ- খোলা চুল বা আলগা খোঁপায় শাঁখা পলা গয়নার রিন রিন শব্দ। ছোটোবেলায় আমাদের স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ত পঞ্চমীর দিন স্কুল হয়ে। সেদিন আর স্কুলে বিশাল পড়াশুনা হতো না। সবাই খুবই অন্যরকম মেজাজে থাকত। আমার আর ভাইয়ের মায়ের সঙ্গে চুক্তি হত যে যতক্ষন পর্যন্ত বাড়ির কাছের প্যান্ডেলে ঠাকুর না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পড়াশুনো করতে হবে।
প্যান্ডেলে ঠাকুর পদার্পণ করলে আমাদের পড়াশুনা দশমী অবধি স্থগিত থাকবে। প্রতিমা জলে পড়লে মানে বিসর্জন হয়ে গেলে মায়ের গলায় কড়া আদেশ শুনতে পেতাম, "পুজো শেষ, এবার পড়তে বসতে হবে"। তখন মনে মনে প্রচন্ড রাগ হত। আরে পুজোর রেশ বলেও তো একটা ব্যাপার হয় নাকি? শেষ বললেই হল? আরেকটু বড় হওয়ার পরে যে যে কোচিং এ পড়তে যেতাম, সেখানেও তুমুল বিজয়ার খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হত। তারপরে ও যখন কাগজের অফিসে চাকরি করা শুরু করেছি, সেখানকার কলিগরা ও বন্ধুবান্ধব্রা মিলে বিজয়ার অনুষ্ঠা করেছি। তারপরে ২০২১ সালে বিবাহ সূত্রে প্রবাসে এসেছি। প্রবাসের পুজোটা কলকাতার থেকে এক্কেবারে আলাদা। তবে কলকাতা থেকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে বসে থাকা আমি বিদেশের পুজো প্রথম কাটানো বলতেই মনে পড়ে বার্লিনের কথা।
বিদশের পুজো একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা। শরতকাল এখানে খুবই ক্ষণস্থায়ী, পেঁজা তুলোর মত মেঘেরা এখানে ভেসে বেড়ায় ঠিকই ; কিন্তু সেই মেঘের দল একটু ভালো করে ও ভাসার সুযোগ পায় না। কারণ, তার আগেই শীত আর হেমন্ত এসে দরজায় জানান দিচ্ছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে একমুঠো আগুন রঙ। কারণ প্রবাসে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই ঠান্ডা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাছের পাতার রঙ পরিবর্তন করতে থাকে। পুজো আসার আগের ব্যস্ততা, উন্মাদনা এই আবেশটা উপভোগ করতেই ভালো লাগে বেশ। আর পুজো যদি উইকএন্ডে পড়ে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
শুক্রবার অফিস সেরে সন্ধ্যেয় ঠাকুর দেখতে যাওয়া। আমি এবছর পুজো কাটিয়েছি ফ্রাঙ্কফুর্ট আর কোলন মিলিয়ে। ফ্রাঙ্কফুর্টে এবছর প্রায় পাঁচটা পুজো একসংগে হয়েছে। পাশ্ববর্তী দেশ ও শহর থেকে অনেকে আসেন পুজো দেখতে। বিদেশে এটাই আমাদের কাছে ”প্যান্ডেল হপিং"। অনেকে কোলন যান বা কোলনের লোকেরা আসেন ডুসেলডর্ফ বা ফ্রাঙ্কফুর্টের পুজো দেখতে। ষষ্ঠী আর সপ্তমী কাটালাম ফ্রাঙ্কফুর্টের সর্বাপেক্ষা পুরোনো পুজোতে। ।এত পুরোনো পুজো জার্মানি কেন গোটা ইউরোপে কমই আছে বলে মনে হয়।এবার বলব, প্রবাসের পুজো কিকরে হয় সেটা নিয়ে অনেকেরই দেশে অনেকেরই আগ্রহ থাকে।
এক বছর আগের থেকে পুজোর জন্যে বড় হল সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। এক বছর আগে থেকে পুজোর কর্মকর্তারা এই পাঁচটা দিনের জন্য আগে থেকে ছুটি চেয়ে রাখেন। আমাদের পাঁচ চালা প্রতিমা ষষ্ঠীর দিন সকালে গুদাম ঘরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে পৌঁছায় অনুষ্ঠানের মূল জায়গায় , তারপর পরিষ্কার করে সাজগোজ করিয়ে তাকে তোলা হয় মূল মঞ্চে। অষ্টমীর দিন আমি আর আমার হাসবেন্ড কাটিয়েছি কোলনে।
কোলনের পুজো এবছর ৩২ বছরের পুজো। জার্মানির সবথেকে বড় পুজোগুলো র মধ্যে একটা। কোলনের পুজোর ঘরোয়া পরিবেশ মানুষের মন কাড়তে বাধ্য। প্রায় আড়াই বছর বিদেশের মাটিতে পুজো দেখছি, আর একটা অদ্ভুত জিনিস মনে মনে ভেবেছি, বলা যায় অনুধাবন করেছি, সত্যি কথা বলতে এত নিষ্ঠা ভরে পুজো করতে যে কি উদ্যম উতসাহ,আনন্দ ও পরিশ্রম লাগে, তা এখানে না থাকলে বোঝা খুবই কঠিন।
তবে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জার্মানরা আমাদের অনেক কাজে সাহায্য করে থাকেন।আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কলকাতার সেই পুরোনো সাদামাটা, সাবেকি পুজো কোথাও গিয়ে হারিয়ে গেছে। কোথাও গিয়ে থিম ও কারিগরি এর দৌড়ে হারিয়ে ফেলেছি আমরা সেই আন্তরিকতাকে। সেই আন্তরিকতার টানেই প্রবাসের বাঙালিরা শুধু নয়, সব ভারতীয়রা এই চারটি দিনের জন্য ছুটে আসেন পুজো মন্ডপে। পুজোর চারটি দিন তিথি নির্ঘন্ট মেনেই পুজো হয়।
সন্ধি পুজো, অঞ্জলি, চন্ডীপাঠ কিছুই থেমে থাকে না। বিকেলের কোণে দেখা আলোয় পুজোর প্রাঙ্গন জুড়ে চলে স্বর্ণযুগের গান, কচিকাঁচাদের দৌড়,সবার খোশ মেজাজে আড্ডা, রাঙাহাসি রাশি রাশি ক্যামেরার দিকে তাকানো মুখ কিংবা যুবক যুবতীদের মায়ের সঙ্গে সেলফি তুলতে ভিড় জমে মূল মন্চের ওপর। এ ইকর্মজীবনের ব্যস্ততায় যোগাযোগ হারিয়ে ফেলা অনেক মানুষ হঠাৎই তাঁদের পুরানো প্রিয়জনকে খুঁজে পায় পুজোর আঙিনায়।
আড্ডা আর অঞ্জলির ফাঁকে, পুজোর কাজে হাত মিলিয়ে তৈরী হয় নতুন পরিচিতি আর বন্ধুত্ব। সন্ধ্যে থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জার্মানির পুজো মন্ডপে বসেই সবাই একসঙ্গে গলা মেলাই মান্না দে থেকে সেই যে হলুদ পাখি। দশমীর দিনে সিঁদুর মেখে চোখের জলে মা কে বিদায় জানানোর পালা। তারপরে সবাইমিলে মি ষ্টি মুখ ও বিরিয়ানির আর অবশ্যই কোলাকুলি তে সবার ম নের মধ্যে একটাই কথা চলে "আবার এসেো মা"। জীবনের চরম ব্যস্ততায় এই চারটে দিন ঝড়ের মত চলে যায়। তা সত্ত্বেও প্রবাসের বাঙালিরা প্রতি এই পুজো তঁাদের শিকড়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
এদেশে বড় হতে থাকা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই পুজো বহন করে নিয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি পরিচয়ের মহিমা। আমাদের স্বাতন্ত্রতা ও আঞ্চলিক জার্মান ভাষার সাথে সামঞ্জস্য রেখেও আমরা আমাদের স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখে এগিয়ে যেতে পারছি। এ যেন একটি সংহতির প্রতীক।
আজকালের খবর/আরই