প্রকাশ: শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৩, ৩:৫৮ PM
দেয়াল লিখন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত একজন লেখকের লেখা খুব সহজে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম অবলম্বন হয়ে আসছে। অগনিত লেখার মধ্যে থেকে ভালো লেখাটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া শুধু লেখকের দায়িত্ব নয়, এ দায়িত্ব মননশীল সাহিত্য সম্পাদকেরও বটে। একটি ভালো লেখা খুঁজে বের করার জন্য একজন মননশীল সাহিত্য সম্পাদককে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় এবং লেখককে ভালো লেখাটিই লিখতে হয়। লেখালেখিতে টিকে থাকতে হলে ভালো লেখার কোনো বিকল্প নেই। একজন লেখককে ভালো লেখা দিয়েই টিকে থাকতে হবে। ভার্চুয়াল বিপ্লবের ফলে পাঠকরা খুব সহজেই তাদের প্রিয় লেখকদের লেখা হাতের মুঠোয় নিয়ে পড়তে পারছেন। বিষয়টি পাঠকদের জন্য খুবই আনন্দের ও একবিংশ শতাব্দির বড় অর্জনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
ভার্চুয়াল বিপ্লবের ফলে শহর-নগর-গ্রাম থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের লেখকরাও ইমেইলের মাধ্যমে মুহূর্তেই পত্রিকায় লেখা পাঠাতে পারছেন এবং তা প্রকাশও হচ্ছে। তা ছাড়াও সোস্যাল মিডিয়া সম্পাদক, লেখক ও পাঠকের মাঝে যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। যার সুফল আমরা ভোগ করছি। লেখালেখির ক্ষেত্রে এখন আর শহর-নগর- গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। লেখা প্রকাশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে দৈনিক পত্রিকা। লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে যুগযুগ ধরে পত্রিকার কদর ও গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছেই ছিলো, আছে এবং থাকবে।
একটি সময় ছিলো যখন লেখা প্রকাশ হওয়ার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হতো। অনেক সময় লেখা প্রকাশ হলেও লেখক জানতে পারতেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পাদকের চিঠি লেখকের হাতে না পৌঁছাতো। এগুলো এখন অতীত! স্মৃতির পাতা থেকে অতীত মুছে বর্তমানকে বরণ করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিছুকিছু অতীত ভুলে যেতে হয় আবার কিছুকিছু আকঁড়ে ধরতে হয়। আমাদের দেশে এত পত্রিকা, এত ওয়েব পোর্টাল, এত ম্যাগাজিন এত ইপেপার তারপরও প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে পত্রিকার সংখ্যা। পত্রিকার সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি লেখকের সংখ্যাও বাড়ছে। এত এত লেখকের মধ্যে থেকে একটি ভালো লেখা খুঁজে বের করা সাহিত্য সম্পাদকের জন্য খুবই কঠিন কাজ। কারণ- প্রতিটি লেখাই সাহিত্য সম্পাদককে পড়তে হয়। তারপর কোন লেখাটির মান কেমন বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করতে হয়। সাহিত্য পাতার সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে।
সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ফোন দিয়ে লেখক জানতে চান তার লেখা প্রকাশ হবে কিনা। যদি বলা হয় বিশেষ কারণে- লেখাটি এ সংখ্যায় প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না তখন সাহিত্য সম্পাদককে শুনতে হয় কটুকথা। উপরের মহল থেকে কিছু চাপ তো থাকেই। লেখা প্রকাশ হওয়ার পর শুরু হয় আরেক সমস্যা। কিছু সিনিয়র লেখক জানতে চায় অমুকের লেখা আমার লেখার ওপরে কেন? সে কি আমার সিনিয়র? নাকি আমার থেকে সে ভালো লিখে! পদ-পদবি দিয়েও তো সে আমার সমকক্ষ নয়। তাহলে তার লেখা আমার লেখার উপরে দিলেন কেনো? উপরে ওঠা ও নিচে নামা নিয়ে লেখক সাহিত্য সম্পাদককে দু’চার কথা শুনায়। লেখকের লেখায় ইলাস্ট্রেশন কেন সুন্দর হল না, রঙিন বাদ দিয়ে সাদা-কালো করা হলো কেন? তার লেখাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কেন? আরও কত কী!
এসব চাপ সামলে একজন সাহিত্য সম্পাদককে পথ চলতে হয়। অনেক পত্রিকা আছে একজন সাহিত্য সম্পাদককে দিয়ে বিভিন্ন বিভাগের কাজ করানো হয় যার কারণে তিনি প্রচুর ব্যস্ত সময় পার করেন। লেখালেখি করতে এসে আমরা যখন সঠিক গাইডলাইনের অভাবে হতাশায় ভুগি তখন দুচারজন সম্পাদক সোস্যাল মিডিয়ায় গাইডলাইন দিয়ে থাকে। এখানেও কিছুকিছু লেখক নেতিবাচক মন্তব্য করতে ছাড় দেয় না। একজন লেখক তার লেখার মাধ্যমে কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত, সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, কামনা, বাসনা ইত্যাদি লিখে সম্পাদকের কাছে পাঠান যেন তা প্রকাশ হয়। কখনো কখনো লেখা প্রকাশ হয় কখনো কখনো হয় না। এ নিয়ে লেখকদের আফসোসের শেষ নেই। মনে রাখা উচিৎ- আমার লেখাটি যেমন আমার কাছে সেরা- তেমনি একজন সাহিত্য সম্পাদকের কাছে তার সাহিত্য পাতাটি সেরা। তাই একজন সাহিত্য সম্পাদক সবসময় অপ্রকাশিত ও মানসম্মত লেখাটিই প্রকাশ করতে সাচ্ছন্দবোধ করেন। সুতরাং একজন লেখককে অপ্রকাশিত লেখাটিই পত্রিকায় পাঠানো উচিৎ। একদিনে কতটি পত্রিকায় একজন লেখকের লেখা প্রকাশ হলো তার ওপর কখনোই লেখকের লেখালেখির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না।
ভবিষ্যৎ নির্ভর করে লেখার গুণগত মানের ওপর। আমার আজকাল প্রায়ই- বাংলা সাহিত্যের অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কথা মনে পড়ে। ওই সময়ের একদল কবি ও গায়ক ছিল যাদের শিক্ষাদীক্ষা-পড়াশোনা না থাকলেও কবিতা ও গান রচনা করে তাৎক্ষণাৎ গাইতেন কিন্তু মাইকেল আর্বিভাবের পর ক্রমেই তাদের সংখ্যা লোপ পেতে থাকে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা কবিতা-গান রচনা করে কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা না করেই তাৎক্ষণাৎ পোস্ট দিয়ে পাঠকদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়াই- প্রশংসায় ভাসি। অনেকেই সাহিত্যের শিকড় খোঁজাকে পন্ডশ্রম মনে করে। একজন লেখককে তার নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই লেখালেখির পাশাপাশি সাহিত্যের ইতিহাস চর্চার খুব প্রয়োজন। সাহিত্যের ইতিহাস চর্চা শুধু নিজেকেই সমৃদ্ধ করে না দূর করে দেয়- রাগ-অভিমান-অভিযোগ। সেতুবন্ধন তৈরি করে পূর্ববর্তী লেখকদের আত্মার সাথে। একজন লেখককে- বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, ঐতিহ্য ও বাংলা সাহিত্যের পরিচয় জানা খুব প্রয়োজন।
আজকালের খবর/আরইউ