রবিবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রেম-দ্রোহের বিন্যাস ‘ফিনিক্স পাখির ডানা’
রাজেশকান্তি দাশ
প্রকাশ: শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৩:৩৩ PM
কবি দ্বীপ সরকার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে অন্যতম। তার লেখা কবিতা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, ছোটোকাগজ ও ওয়েবম্যাগে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ‘ফিনিক্স পাখির ডানা’ তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। এর প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল-আমিন। প্রকাশিত হয়েছে অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে ২০২০ সালে। বইটি ৬৪ পৃষ্ঠার। এতে কবিতা রয়েছে তিপ্পান্নটি। এর শৈল্পিক ভূমিকাটি লিখেছেন এ সময়ের অগ্রজ কবি শিবলী মোকতাদির।

এর আগে ভিন্ন ভাষার গোলাপজল (২০১৮) এবং ডারউইনের মুরিদ হবো (২০১৯) নামে তার দুটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। তিনি ‘কুয়াশা’ নামে একটি ছোটোকাগজ সম্পাদনা করেন; যা বর্তমানে ওয়েব ম্যাগাজিন হিসেবে চলমান। আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করি এটি তাদের কাছে অত্যন্ত পরিশীলিত ও  নান্দনিক একটি শিল্প মাধ্যম হিসেবে পরিচিত।

কবি গভীর বোধ থেকে টেনেছেন বাস্তবতাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব কিছুই যেন একটা পরিণতির দিকে যায়। শিথিলতা দেখা দেয়। পরিমিতিবোধ হারিয়ে বলিরেখায় ন্যুব্জ হয়ে ওঠে। যা থেকে রক্ষা পায় না চুম্বনের ঠোঁট, কামভাব। আমাদের বড়ো হওয়ার স্পিরিট-আশা। কবির ভাষায়-
‘বয়স বাড়ে-কমে যায় আশা, কামভাব/চুম্বনরত ঠোঁটও বিবস হতে হতে সেকেলে হয়ে যায়-/পুরোনো হয়ে যায়’ (কবিতা : চুম্বনরত ঠোঁট বিবস হতে হতে)

তার বাস্তবতার বিবেচনা খোলাসা করে দেয় সমাজের কাঠামোতে লুকিয়ে থাকা ঘোর রহস্যগুলো। এখানে উপরি কাঠামোই যেন মৌল কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের চারপাশে অহরহ তা-ই তো ঘটতে দেখছি। এগুলো যেন আমাদের প্রতিদিনকার মনের কথা হয়ে ওঠে। দুটো লাইন তুলে ধরছি-
‘জোনাকির আলোতে পিঁপড়েরা ইঁদুরকে নিয়ে/টানে, খায়Ñ কী যে আনন্দ!’ (কবিতা : প্রাগৈতিহাসিক দেয়াল)

শিল্পের একটি দায় আছে। দায়টা হলো মানুষকে চেতনার আলোকে শানিত করে তোলা, সচেতন করা কিংবা এর বিকলাঙ্গতা ধরিয়ে দেওয়া। শিল্পী হিসেবে কবি এই দায় এড়িয়ে যাননি। শিল্পের দায় থেকে এই বিকলাঙ্গতা ধরিয়ে দেওয়ার বোধ তার কবিতায় দেখা যায়-
‘বিলবোর্ডের/পাশে/দুলছে/জীর্ণ পতাকা-/মানুষ/ বিলবোর্ড/ দেখে/পণ্য কিনছে/অথচ/পতাকা/দেখে/বাংলাদেশ/চিনছে না।’ (কবিতা : বিলবোর্ডের পাশে জীর্ণ পতাকা)

এ কবিতায় কবি আমাদের মানসিক বিকলাঙ্গতাকে তুলে ধরলেন ‘জীর্ণ পতাকা'’ প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে। একটা দ্বান্দ্বিক চিত্রের মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই বিলবোর্ডের আলোয় মানুষ পণ্য কিনছে। পণ্য শব্দটি দ্বারা পুঁজিবাদকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজের ভোগবাদীতা প্রকাশ পাচ্ছে। এই ভোগবাদিতার কাছে পতাকা-দেশ গৌণ হয়ে ওঠছে। বিলবোর্ডের পুঁজিবাদ এমনই। দেশপ্রেমের চেতনা মলিন করে দেয়। এই ছোট্ট কবিতাটির মর্মার্থ অনেক।

এছাড়া ‘একটা জীবিকা দুপুরের সন্ধানে’ কবিতায় কবির সমাজ চেতনা ধরা পড়ে। কাব্যরস কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। আমরা সাহিত্যে কতগুলো রসের সন্ধান পাই। এগুলো হলো শৃঙ্গার, হাস্য, বীভৎস, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, অদ্ভুত, শান্ত। তার বেশির ভাগ কবিতায়ই এগুলোর উপস্থিতি মেলে। অপ্রাপ্তির বেদনা আমাদেরকে ঠেলে দেয় দুঃখ-জরার উঠোনে। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে আনন্দ। তখন করুণ সুরে ভরে ওঠে মন। কবির ভাষায়-
‘আমার কোনো দুঃখ দেখাবার মানুষ নাই.../ভেতরকার ক্ষত বরং অক্ষতই থেকে যাক...।’

কাম বা যৌনক্রিয়া আমাদের জীবনের একটা স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। সহজাত প্রবৃত্তি। ফ্রয়েডীয় মনো বিশ্লেষণে দেখা যায় নর-নারীর প্রতি পারস্পরিক টান বা আসক্তি থেকে সৃষ্টি হয় শৃঙ্গার। এ নর-নারীর আসক্তি তার কবিতায় জ্বাল দেয়া দুধের মতো উথলে ওঠে-
‘তোমার দৃষ্টির গভীরতা খুঁজতে চোখের গভীরে ঢুকে গিয়েছিলাম একদিন/ওহে বগুড়ার মেয়ে, ওহে! ’(কবিতা : প্রেম)

দ্বীপ সরকার ছান্দসিক কবি। ‘এক জোড়া অতীত’ কবিতায় তার ছন্দপ্রেম ধরা পড়ে। কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি-
‘এ্যাশট্রেতে জমে আছে ছাই/তাপ ও আগুনÑছেঁকে খাই/সিগারেটের মাথাটা নুয়ে থাকে/মনে পড়ে খুবÑমনে পড়ে তাকে।’
এ কবিতায় কবির ছন্দের নিরীক্ষাধর্মীতা চোখে পড়ে।

‘লকডাউন ও রেড জোন অ্যালার্ট’ এবং ‘করোনা ও উড়ে আসা গাঙচিল প্লেন’ কবিতাগুলোর প্রেক্ষাপট করোনাকাল। কবিতায় দহনকালের স্মৃতি ওঠে আসে। কবিও আমাদের মতো এই কৃষ্ণপক্ষে ছিলেন। এই কৃষ্ণপক্ষের কবিতাগুলো হয়ে ওঠে আমাদের যাপনের বিগত সঙ্গী। বন্দি দিনগুলোর স্মৃতিচিহ্ন।

কিছু লাইন তুলে ধরছি- ‘রেড জোনে থাকলে বুঝতে প্রিয়তমা!/এখানে ধৈর্যের সুনসান পেরিয়ে উতরে গেছে প্রেম ও নিবেদনের পদ্ধতি/কোলাকুলি নেই, স্ত্রীর গাঢ় ঠোঁটও ধর্তব্য নয় এখন আর।’ (কবিতা : লকডাউন ও রেড জোন এ্যালার্ট)

কোভিড ’১৯ কে বরদাস্ত করতে পারছি না আর (কবিতা : করোনা ও উড়ে আসা গাঙচিল প্লেন)

শেষ করছি কবির কবিতা বইয়ের কয়েকটি চিত্রকল্প দিয়ে। তার কবিতার চিত্রকল্পগুলো কবিতার ভেতরের কবিতা হয়ে ওঠে। অমিতশক্তি স্থাপন করে কবিতার শরীরে। কয়েকটি এ রকম-
গ্রিল ছুঁয়ে তদন্ত দায়িত্বে মাকড়সা এবং টিকটিকি (কবিতা : আমি এবং রেশমি)
শরীরে মনস্তত্ত্বিক ভেড়া দৌড়োয় (কবিতা : আমি এবং রেশমি)
তুলোরাশির তালুতে ভাগ্য গোনা শিখি; (কবিতা : শ্বেতপাথরে নির্মিত চোখ)
ধূপধুনো দিয়ে চড়ুইটা মেঘ হয়েছিলো (কবিতা : আকাশ হলো মেঘের জলসিঁড়ি)

তার কবিতায় প্রেম, সমাজচেতনা, দ্রোহ, ভাব ও ভাবনার বিন্যাস লক্ষ করার মতো। এগুলো পাঠকের মনকে নাড়া দিয়ে ওঠে। কবিতাগুলোর পরতে পরতে পরাবাস্তবতা শ্যামলতার সিঁড়ি বেয়ে পাঠকের মনের খোরাক হয়ে ওঠে। পাঠকও হয়ে ওঠেন কবিতার প্রেমিকা। আমি বইটির প্রসার ও বহুল পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
রাশিয়ার ‘বন্ধু ও নিরপেক্ষ’ তালিকায় বাংলাদেশের নাম
কবি নজরুলের মাজারে প্রনস নির্বাহী কমিটির শ্রদ্ধা
‘মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগের ফলে বিএনপিই বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে’
ভিসানীতি-নিষেধাজ্ঞা পরোয়া করে না আওয়ামী লীগ: কাদের
বোমা বিস্ফোরণে সোমালিয়ার সেনাসহ নিহত ১০
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বাউফল রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন
লেখক সম্মাননা দেবে ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল
ফরিদপুরে মুরগীর ট্রাকে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার চার
পঞ্চগড় জেলা বাপার সভাপতি খায়ের, সম্পাদক জুয়েল
কিশোরগঞ্জে আব্দুর রশিদ ল’ কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনদ বিতরণ
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft