
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ বৈশাখে খড় তপ্তময় পৃথিবীতে এসেছিলেন, স্বর্গীয় প্রেমিক পুরুষ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বর্ষণমুখর মেঘে ঢাকা, ২২ শ্রাবণে তিনি চির বিদায় নিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের কুঞ্জে ফুল ফুটিয়ে রেখে গেলেন, এ ফুল অক্ষয় অমর পারিজাত। চিরদিন বাংলা বাঙালি এমনকি সাহিত্যপ্রেমী বিশ^বাসীর মাঝে গন্ধ বিলিয়ে যাচ্ছে। এ আসা যাওয়ার মাঝখানের সময়টুকু পঞ্জিকার হিসেবে মাত্র ছিল ৮০ বছর। এ ৮০ বছর একটি মানুষের জীবনে কম সময় নয়। ৮০ বছরের অমূল্য সৃষ্টি তার বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার নবীন্দ্র সাগরে অবগাহণ না করলে, এ রতন আহরণ কার সম্ভব নয়।
অথচ বিগত পাক-আমলে এক শ্রেণি এ দেশের বেতার টিভিতে রবীন্দ্র চর্চা বন্ধ করে দেন। কিন্তু রবীন্দ্র প্রেমিক জ্ঞান বোদ্ধাগণ তার বিপরীতে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন করেন। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে তার লেখা গান আমাদের জাতীয় সংগীতÑ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
বাঙালি মনীষার এক আশ্চর্য প্রকাশকারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তার জাদুকরী প্রতিভার স্পর্শ লাগেনি। বাংলা সাহিত্যে তিনিই একমাত্র নোভেল বিজয়ী কবি। কেউ কেউ তাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক বলে আক্ষ্যায়িত করেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্দশ সন্তান। পিতা মহর্সি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, মাতা সারদা দেবী। কলকাতা বিখ্যাত জোড়া সাঁকো ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ সালে ২৫ বৈশাখ (৭ মে ১৮৬৯) জন্ম গ্রহণ করেন। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী চার-পাঁচ বছর বয়সে গৃহ শিক্ষকের কাছে তার পড়াশোনা শুরু হয়। ছয় বছর বয়সে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হন। বছরখানেক পর নরমাল স্কুলে, তারপর বেঙ্গল একাডেমিতে তিনি লেখাপড়া করেন। কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়াস স্কুলে, কিছুদিন লেখাপড়া করেন। কিন্তু স্কুলের বাঁধা-ধরা লেখাপড়ায় তার মন বসতো না। বনের পাখি কখনই খাঁচায় বন্দী জীবন চায় না। কবি ছিলেন মুক্ত মনের অধিকারী বনের পাখি। অভিভাবকরা তার ভবিষৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তবে ব্যারিস্টারি পড়ানোর জন্যে প্রথমে ব্রাইটন ও লন্ডন বিম্ববিদ্যালয়ে দেড় বছর পড়াশোনার পর, তিনি দেশে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে তার সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কান্দম্বিনী দেবী রবীন্দ্রনাথকে খুব স্নেহ করতেন। প্রতিটি কবিতা গল্প লেখে তিনি তার বৌদিকে দেখাতেন। বৌদির উৎসাহ আদরে রবীন্দ্রনাথ উৎসাহিত হয়ে কাব্য জগতে বিশাল স্থান করে নেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ১৮৭৭ সালে মাসিক ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দাদা-বৌদির অনুপ্রেরণায় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি ‘বনফুল’ নামে কাব্য রচনা করেন। এরপর কবি কাহিনী, সন্ধ্যা সংগীত প্রভূতি কাব্য একের পর এক প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভানু সিংহের পদাবলী ছদ্দনামে বহু কীর্তন লিখে গেছেন, তিনি বৈঞ্চব কবি চন্ডী দাসের একটি গান বহুবছর পর সুর দিয়ে ছিলেন। ১৮৮২ সালে কলকাতার ১০ নম্বর স্ট্রিটে অবস্থান কালে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটি রচনা করেন। রবীন্দ্র বলয়ে বর্তমান কবি’রা বিচরণ করছেন।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কবির এই ভবঘুরে জীবনের সমাপ্ত ঘটাতে ১৮৮৩ সালে কুষ্টিয়ার শিয়ালদহ এবং পাবনার শাহজাদপুরে ঠাকুর পরিবারের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পল্লির প্রকৃতি ও তৃণমূল সংলগ্ন মানুষের মাঝে এসে তার সৃষ্টিকর্ম নতুন সমৃদ্ধি লাভ করে। সোনার তরী, চিত্রা, মানসী বিখ্যাত কাব্যগুলো এ সময় রচনা করেন। এ সময় তিনি তার নিজির বিরুদ্ধেই ‘দুই বিঘা জমি’ শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখেন। জমিদারি দেখতে এসে নিজে সাহিত্যের জমিদার হয়ে উঠেন। জমিদারের অর্থ না পাঠানোর জন্য কৈফিয়ত চাওয়া হলে, তিনি উত্তরে বলেনÑ আমি ঠাকুর পরিবারের অমরত্বের দায়িত্ব পালন করেছি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের মাঝে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের জীবন মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই সেখানে প্রবেশ না করেছেন। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ, পত্র সাহিত্য, অনুবাদ, ভাষণ ও সাহিত্য, নন্দনতত্ব, চিত্রকর্মসহ বহুমাত্রিক রচনা সম্ভার দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের সাহিত্য জগৎ। সঙ্গীতের গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠ তার নিজেরই, যা রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে উল্লেখিত।
কবির ৫০ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে ১৯১১ সালে কবিকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ দেশবাসীর পক্ষে সংবর্ধনা প্রদান করেন। অপরদিকে নিজের অনুবাদ করা এবং ইংরেজি কবি ডব্লিউ বি ইয়েট’স-এর ভূমিকা লেখা ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকাশিত হলেÑ ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
কলকাতাবাসী কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। কবি তাদের সংবর্ধনা সমন্ধে বলেন- আপনাদের দেওয়া এ সংবর্ধনা আমার ওষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। কারণ আমি গীতাঞ্জলী বাংলায় লিখেছি, তখন এদেশের মানুষ মূল্যায়ন করেনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ‘ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯১৯ সালে জালিয়া নওরালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজদের দেয়া ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিই ছিলেন না, তিনি সমাজ উন্নয়নে সমবায় আন্দোলন, কৃষি উন্নয়ন, রাজনীতি, সংস্কৃতি নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন। ১৯২১ সালে ‘বিশ্ব ভারতী’ ও ১৯২২ সালে ‘শান্তি নিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মহান কবিকে নিয়ে কত ঘটনা কত রটনা। রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র ও বহুমূখী হলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। সত্য সুন্দর কল্যাণই তার আদর্শ। সীমার মাঝে তিনি অসীমের সন্ধ্যান করেছেন। ছোটবেলায় পড়ায় ফাঁকি দিতে গিয়ে শীতের সকালে নাগরা জুতায় জল ভরে খোলা ছাঁদে বেড়িয়েছেন। সুস্থ সুন্দর নিরোগ দেহের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃদ্ধ বয়সে ‘এ্যাপেন্টিসাইড’ অপরেশন করার কিছুদিন পর ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বাংলা, ৭ আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় পরলোক গমন করেন। তার অজস্র সৃষ্টি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে। তারই লেখা দু’টি গান ভারত-বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বাংলা-বাঙালি ও বিশ^বাসির ভালোবাসায় অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর...।
আজকালের খবর/আরইউ