বুধবার ৪ অক্টোবর ২০২৩
প্রকৃতির কবি, পল্লীর কবি বন্দে আলী মিয়া
সোহেল বীর
প্রকাশ: শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০২৩, ৩:৩৩ PM
বাংলাসাহিত্যের বিরল প্রতিভাবান কবি বন্দে আলী মিয়া। তিনি সমগ্র বাংলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বন্দে আলী মিয়া একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, চিত্রকর, গীতিকার, নাট্যকার ও শিশুসাহিত্যিক। তার কবিতায় আমরা যেমন পাই আবহমান বাংলার পল্লী তথা গ্রামের কথা, তেমনি গ্রামীণ দৃশ্যপট, লোকজ উপাদনসহ সুনিপুণভাবে ফুটে ওঠে প্রকৃতির কথা। কবিতায় প্রকৃতি বন্দনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবি বন্দে আলী মিয়ার কবিতা পাঠকদেরকে নিয়ে যায় সোঁদা-মাটির গন্ধ মেশানো গ্রামের অনাবিল সবুজ আর চোখজুড়ানো প্রকৃতির কাছে। কবিতায় ফুটে ওঠে গ্রামীণ বাংলার রূপ-রস-গন্ধে ভরা প্রকৃতির এক অনন্য চিত্র। তার সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় একটি কবিতা- আমাদের গ্রাম। এ কবিতায় তিনি চমৎকারভাবে গ্রামের স¦রূপ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। ছোট্ট গ্রামে ছোট ছোট ঘরের মানুষের মাঝে এক অকৃত্রিম মেলবন্ধন। এখানে কেউ কারোর পর নয়। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে পাড়ার সকল ছেলের মিলেমিশে একসাথে খেলাধূলা আর পাঠশালায় যাওয়ার যে দৃশ্য তা ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতায় ধরা পড়েছে সাবলীলভাবে। পিতামাতা আমাদের গুরুজন, তাদেরকে সম্মান করা, তাদের কথা মেনে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য। কবির ভাষায়-

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।/পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,/একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।/হিংসা ও মারামারি কভু নাহি করি,/পিতামাতা গুরুজনে সদা মোরা ডরি।
গ্রাম আমাদের অস্তিত্বের শেকড়। অনাবিল সবুজ আর প্রকৃতির রং দিয়ে লেখা গ্রামখানি মা-মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। গ্রামের আলো-বায়ুতে রয়েছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। আর এই আলো-বায়ুতে বেড়ে ওঠে প্রতিটি প্রাণ।
কবি লিখেছেন-
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,/আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।

ছোট এই গ্রামে মাঠভরা ধান, জলভরা দিঘি, আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় সবাই যেন আত্মীয়, মিলেমিশে একই গ্রামে তাদের বসবাস। কোনো হিংসা নেই, কোনো মারামারি হানাহানি নেই। সবাই সবার আপন। কবিতায় এভাবেই একটি গ্রামের প্রকৃতির অনন্য চিত্র তুলে ধরেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া-
মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘি,/চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।/আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় যেন,/মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।

‘আমাদের গ্রাম’ কবিতাটি শুধু কবির গ্রাম নয়, এ যে আবহমান বাংলার গ্রামের প্রকৃত দৃশ্য। এই কবিতাটি যেমন আমাদের সামনে একটি গ্রামের স্বরূপ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে, তেমনিভাবে শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় একটি কবিতা।

বহুমাত্রিক লেখক বন্দে আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে। পিতা মুন্সী উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেসা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্যের উচ্চাসনে আরোহন করতে সক্ষম হন। কর্মজীবনে তিনি প্রথমদিকে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তার কলকাতা যাপনের সময় বন্দে আলী মিয়া কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য লাভ করেন। সে সময় বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানিতে তার রচিত পালাগান ও নাটিকা রের্কড আকারে কলকাতার বাজারে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তীতে প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন।

তার প্রথম গ্রন্থ উপন্যাস ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরই আলোচনায় চলে আসেন। পাঠকমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয় তার এই বইটি। এই বইয়ে লোকজ উপাদানে সমৃদ্ধ কবিতায় প্রকৃতির স্বরূপ চিত্র অঙ্কণে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। বুনো ঝাউ, বুড়ো বট, গাঙের তট, বিহানের লাঙল, চাষি, গাঙচিল নানা অনুষঙ্গ ‘ময়নামতির চর’ কবিতার উপজীব্য। কবি লিখেছেন-
এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও-পারের বুড়ো বট/মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট;/এরি উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষি,/কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি।

বাংলাদেশের চরের সহজ-সরল প্রকৃত বর্ণনা পাওয়া যায় এ কবিতায়। পুরো কবিতাজুড়ে রয়েছে চরে বসবাসকারী মানুষের জীবন ও জীবিকার বর্ণনা, চরের মাঠ-ঘাট, নদী, ঐতিহ্যবাহী উৎসবসহ প্রকৃতির আসল রূপ ও  গ্রামীণ জীবনের আবহমান দৃশ্যপট।

উৎসব শেষে খা খা করে হায় শূন্য বালির চর/এ-পারের পানে চাহিয়া ও-পার কাঁদে শুধু রাত ভর। [ময়নামতির চর]

‘ময়নামতির চর’ ছাড়াও চর নিয়ে আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ হলো- ‘পদ্মানদীর চর’ এবং ‘মধুমতীর চর’। তার আরো উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- ‘অনুরাগ’ ও ‘ধরিত্রী’। নামগুলোর মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই আবহমান বাংলার গ্রামীণ চিত্রকল্প এবং প্রকৃতি বন্দনা। ‘ময়নামতির চর’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর এতটাই পাঠকপ্রিয় হয়েছিল যে পরবর্তীতে কবি বন্দে আলী মিয়া ‘ময়নামতির চর’-এর কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল, বরেণ্য কবি বন্দে আলী মিয়া বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও সমানতালে লিখেছেন। শিশুদের জন্য তিনি নিরলস সাহিত্য চর্চা করেছেন। তার লেখায়  বাংলা শিশুসাহিত্য পেয়েছে নতুন এক মাত্রা। ‘চোর জামাই’, ‘মেঘকুমারী’, ‘বোকা জামাই, ‘ডাইনী বউ’, ‘রূপকথা’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা’ ও ‘সাত রাজ্যের গল্প’ তার উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। তার একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হচ্ছে- পাখি। এ কবিতায় পাখির প্রতি একটা শিশুর যে গভীর মমত্ত্ববোধ ও ভালোবাসা যেমন একদিকে ফুটে উঠেছে, তেমনি অন্যদিকে খাঁচা নয় পাখির কাছে তার স্বাধীনতা হলো উন্মুক্ত স্থান, খোলা আকাশ। প্রত্যেক প্রাণিই স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। আবার পাখি খাঁচা ছেড়ে চলে যাওয়ায় শিশুমনে যে গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, পাখির জন্য অশ্রুবিসর্জন দেয় সেরকম একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও ফুটে ওঠে ‘পাখি’ কবিতায়-
খাঁচার দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে,/ছোট কালো পাখি উড়ে গেছে দূর নীল নভ অঙ্গনে।/শূন্য খাঁচাটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে,/খোকা বসি পাশে অশ্রুসজল চোখ মোছে বারে বারে।
কিংবা,
এত ভালোবাসা, এত যে সোহাগ, পোষ তবু মানে নাই,/খাঁচার প্রাচীরে পাখা ঝাপটিয়া, পথ খুঁজিয়াছে তাই।/খোকা চায় পাখি, পাখি চায় বন-স্বাধীন মুক্ত প্রাণ,/কন্ঠে তাহার জাগে ক্ষণে ক্ষণে নীল আকাশের গান। [পাখি]

রেডিওতে চাকরি করার সময় তিনি ‘গল্পদাদু’ নামে শিশুদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কারণ, সেসময় ছোটদের জন্য রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সবুজ মেলা’ নামে একটি চমৎকার অনুষ্ঠান। কবি শিশুদের কাছে অনুষ্ঠানটিকে আরও আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করতে শিশুদের উপযোগী গল্প লিখে তা শুনাতেন। আর এভাবেই বেতারে প্রচারিত ‘সবুজ মেলা’ অনুষ্ঠানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

সাহিত্যান্ত প্রাণ কবি বন্দে আলী মিয়া কবিতায় গ্রামীণ কণ্ঠস্বর, পল্লির কবি ও প্রকৃতির কবি। সাহিত্যে স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার সাহিত্য প্রতিভার জন্য তৎকালীন সরকার তাকে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে তিনি রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৮৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।

১৯৭৯ সালের ২৭শে জুন কবি বন্দে আলী মিয়া সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে যান, রাজশাহীতে তার মৃত্যু হয়। পল্লি ও প্রকৃতির কবি, ছোটদের বড় এই লেখক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তার অমর কীর্তি কবিতা, গল্প, গান বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে। সাহিত্যকর্মের মাঝেই তিনি টিকে থাকবেন। তবে বর্তমানে কবি বন্দে আলী মিয়া যেন আমাদের অন্তরালে চলে গেছেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে তার পাঠ অতি জরুরি। কেননা, মন ও মননের প্রকৃত চর্চায় বন্দে আলী মিয়া এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

কবি বন্দে আলী মিয়ার ব্যবহৃত আসবাবপত্র, লেখার টেবিল, আলমারি, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, তার আঁকা ছবিসহ নানাবিধ জিনিসপত্র অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হওয়ার উপক্রম। কবির স্মৃতিবিজড়তি এসব মূল্যবান জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। পরিবারের পক্ষ থেকে কবির নাতনি ডা. নাদিরা আক্তার রুনু কবি বন্দে আলী মিয়াকে বাংলাসাহিত্যের সম্পদ তথা আমাদের জাতীয় সম্পদ উল্লেখ করে তার স্মৃতিবিজড়তি মূল্যবান জিনিসপত্রসহ বাস্তুভিটা সংরক্ষণ করার জন্য কবির নামে একটি গ্রন্থাগার বা স্মৃতি সংগ্রহশালা তৈরির পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।  
বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র বন্দে আলী মিয়ার বইগুলো নতুনভাবে মুদ্রিত হওয়া দরকার। আমরা যত বেশি কবিকে পাঠ করব, ততবেশি তিনি পঠিত হবেন, মূল্যায়িত হবেন; মূল্যায়িত হবে আমাদের সাহিত্য। আমরা প্রিয় এই কবিকে স্মরণ করি ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নির্বাচনে বাধা দিলে যেকোনো ব্যক্তি ভিসানীতির আওতায় পরবে
ভিসানীতি নিয়ে সরকার কোনো চাপ অনুভব করে না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আরও কমলো সোনার দাম
বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা: বদিউল আলম মজুমদারের শ্যালক গ্রেপ্তার
ইংরেজি দৈনিক পিপল'স লাইফ উদ্বোধনে স্পিকার ও তথ্যমন্ত্রী
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ধামরাইতে আপন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা, বড় ভাই আটক
হাইস্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু ২৪ অক্টোবর
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে প্রথম ধাপের পরীক্ষা নভেম্বরে
মানুষের সেবা করা একটি উত্তম ইবাদত: দয়াল বড়ুয়া
ফেনীতে ১৪৭টি পূজা মণ্ডপে অনুদান দিলেন সাংসদ নিজাম হাজারী
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft