সোমবার ১৬ জুন ২০২৫
সারাদেশে মাদকের ছড়াছড়ি
শুধু সিসা লাউঞ্জে থেমে আছে অভিযান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০২৫, ৮:৫১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানী ও গুলশানের একাধিক সিসা লাউঞ্জে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (নারকোটিক্স) অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সারাদেশে ইয়াবা-ফেনসিডিলসহ ভয়ানক সব মাদকদ্রব্যের বিস্তার ঘটছে। এ ছাড়া বৈধ বারগুলোতেও পারমিটবিহীন যে কেউ গিয়ে অবাধে অ্যালকোহল পান করছেন। অথচ সেদিকে নারকোটিক্স নামে সংস্থাটির সঠিক নজরদারি নেই। অথচ সিগারেটের চেয়েও অনেক কম মাত্রার নিকোটিন সমৃদ্ধ কিংবা মাদকের আওতায় না পড়া সিসার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযান নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে অনেকের মাঝে। 

অপরাধ বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিমত, সিসা লাউঞ্জগুলোর অবস্থান অভিজাত এলাকায়, আর এখানে যারা আসেন তাদের অধিকাংশই বিদেশি এবং শিল্পপতি। তাদেরকে বিব্রত করতেই কি কোনো  টোব্যাকো কিংবা মদের বারের মালিকদের পক্ষে এ অভিযানের ইন্ধন; এমন প্রশ্নও সামনে চলে আসছে।  

এক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখা সিসা লাউঞ্জ থেকে নিয়মিত অর্থ নিতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ডিবি-র‌্যাব ছাড়া অন্য সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানের ভয় দেখিয়ে সিসা লাউঞ্জগুলো থেকে নিয়মিত বখরা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।   

জানা গেছে, ঢাকায় মোট ১৯টি সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টির অবস্থান বনানীতে। ২০১৩ সালে এক রিটের মাধ্যমে লাউঞ্জগুলো চলতো। করোনা পরবর্তীকালে যা আর রিনিউ করা হয়নি। 

সিসা ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, একটি সিগারেটে যেখানে নিকোটিনের মাত্রা আট থেকে ১০ শতাংশ; সেখানে সিসায় রয়েছে শূন্য দশমিক দুই থেকে ছয় শতাংশ। সিসা মূলত বিভিন্ন ধরনের ফলের নির্যাস। লেডি কিলার নামে ফ্লেভারে রয়েছে, শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ নিকোটিন, লাভ সিক্সটি সিক্স ফ্লেভারে রয়েছে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ। এ ছাড়া হ্যাভানা লাইট, অরেঞ্জ মেইন্টসহ এ ধরনের ফ্লেভারে একই ধরনের নিকোটিন রয়েছে; যা ব্যাভের চেয়েও উত্তম। দেশে পর্যটকদের চাহিদার মধ্যে প্রথমে রয়েছে সিসা। সিসা কিন্তু ঠিকই ব্যবহার হচ্ছে কিন্তু এটিকে একটি নীতিমালার মধ্যে এনে লাইসেন্স দেওয়া হলে সরকার এর থেকে বড় ধরনের আয়কর পেতো। তাদের দাবি, মাঝেমধ্যেই এসব অভিজাত সিসা লাউঞ্জগুলোতে অভিযানের নামে করা হয় হয়রানি। 

সিসা মূলত কী: হুঁকা একটি আরবি শব্দ। আরব দেশগুলোতে এটি সিসা বা নারগিলা বলে পরিচিত। ইরানে একে বলা হয় গালায়ুন, উজবেকরা বলেন সিলিম। আর বাংলাদেশে পরিচিত হুঁকা নামে। সিসা মূলত একটি ধাতু যা শত শত বছর ধরে রঙ-পানির পাইপে ব্যবহার হয়ে আসছে। কয়লার সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ফলের নির্যাসে প্রস্তুত করা হয় সিসা বা হুঁকা। বাংলাদেশে এ কালচার প্রাচীন, তবে সৌদি আরব, কাতার, বাহারাইন, জর্ডান, মিসর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশে এর ব্যাপক প্রচলন আদিম যুগ থেকে। 

সিসা হুঁকার ওপরে আক্রমণ অনেকটা কালচারাল হেরিটেজের ওপরে আক্রমণের মতোই, বলছেন ঐতিয্য বিশারদরা। জানা যায়, ওসমানিয়া খেলাফত (অটোমান সাম্রাজ্যের) একটি উল্লেখযোগ্য কালচার ছিল এই হুঁকা। অটোমান বাদশাহ সুলাইমানের সবচেয়ে প্রিয় অবসরের সঙ্গী ছিল এই হুঁকা যা পরবর্তীতে সকলের জন্য এক অভিজাতের বেঞ্চমার্ক হিসেবে কাজ করে। এক সময় আরবের শাসক ও দিল্লির মুঘল শাসকদের ঐতিহ্যের প্রতীক ছিলো সিসা। 

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৭৫৭ সালে বাংলায় হুঁকা দিয়ে ধূমপানের প্রচলন শুরু করেন মোঘলরা। রাজ দরবারে হুঁকার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে সমাজের অভিজাত পরিবারগুলোয়। অনেকের মতে, মোঘল এক চিকিৎসক হুঁকার আবিষ্কারক। মোঘল আমলে বাদশাহ-বেগম থেকে শুরু করে সাধারণ সকল মানুষ সকলেই হুঁকা টেনেছেন। এমনকি আমাদের বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো প্রচলন রয়েছে এই হুঁকার।

এই সিসা বা হুঁকা মুসলিম বিশ্বের ঐতিহ্যেরও প্রতীক। আরবের দেশগুলোর মরুপ্রান্তরে এবং দরবারে বাদশাহরা সাফারি নাইটে নৈশভোজে গোশত-রুটি পর্বে আরবি নৃত্য উপভোগ আর সিসা সেবন করতেন। অভিজাত পরিবারগুলোর আভিজাত্যের প্রতীক ছিল সিসা। কিন্তু বাংলাদেশে যেন এ হুঁকার বিরুদ্ধেই চলছে অনবরত আক্রমণ।

জানা যায়, বনানীর ১১ নম্বর রোডে অবস্থিত একটি সিসা লাউঞ্জে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (নারকোটিক্স)। এসময় সেখানে সিসা বা হুঁকা সেবন করছিলেন বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা। ঐতিহ্যের প্রতীক হলেও অনেক সম্ভ্রান্ত অতিথি এমন অভিযানে হয়রানির শিকার হন বলে মত সংশ্লিষ্টদের। 

এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, সিসা ‘খ’ শ্রেণির মাদক হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষাগারের ফলাফল বলছে, সিসা কোনো মাদক নয়। এতে মাদকের মিশ্রণ নেই। এরপরও যদি কোনো সিসা লাউঞ্জ মাদকমিশ্রিত করে সিসা তৈরি করে তাহলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো দূতাবাসের কর্মকর্তাকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে এসব করা উচিত নয় বলেই মন্তব্য নেটিজেন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ডিজি মারুফ হাসান বলেন, বনানীতে আইন মেনেই অভিযান চালানো হয়েছে। সিসা সেবনে ছেলেমেয়ে নারী পুরুষ তরুণ-তরুণী সামাজিকভাবে নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর সংশোধনী ২০২০-এর ধারায় এটি মাদক।

সিগারেটের চেয়েও নিকোটিনের পরিমাণ কম, তারপরেও কেন এটিকে বৈধ করা হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের বিষয়। এখানে কোনো প্রকার হয়রানির ঘটনা ঘটেনি।

অনেকেই বলছেন, বর্তমানে দেশের সর্বত্র এমনকি শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে মাদক। কিন্তু সব বাদ দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চোখ কেবল সিসাকে ঘিরে!

তাদের মতে, স্কুল-কলেজগুলোতে বর্তমানে মাদকের ভয়াবহতা এতটাই যে, সেখানে মদ, গাঁজাকে ছাড়িয়ে ইয়াবা, হিরোইন, এমডিএমএ, আইস, কুশ, ড্রাগস ককটেলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাদকেরও সন্ধান মেলে। এসবের নামই হয়তো শোনেননি নারকোটিক্স সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে গণমাধ্যমে ঠিকই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মাদক নিয়ে প্রতিবেদন হচ্ছে। প্রহসন, নারকোটিক্স কোনো সাংবাদিকের কাছে কখনো কোনো তথ্য চায় না। তাদের অভিযানেও রাখে না গণমাধ্যমের কাউকে। 

গত বৃহস্পতিবারের বনানীর ঘটনায় রীতিমতো ক্ষেপেছেন নেটিজেনরাও। জারা রহমান নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বলে ফলাফল জিরো পার্সেন্ট। যেখানে মাদক আছে, সেখানে না গিয়ে সিসা লাউঞ্জে কী করেন নারকোটিক্সের কর্মকর্তারা?

সোহেল রানা নামের একজন লিখেছেন, সিসা কি মাদক? যদি মাদক হয় তাহলে লাইসেন্স কীভাবে পেলেন লাউঞ্জ মালিকরা? সিসা লাউঞ্জগুলোকে হয়রানির শেষ কোথায়? নারকোটিক্সের এসব অদক্ষ কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করে তরুণ আর অভিজ্ঞদের বসানো উচিত।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসি) প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, সিসায় দুই শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া গেলে তা আইন অনুযায়ী মাদক হিসেবে গণ্য হয়। অথচ রাজধানীর অধিকাংশ লাউঞ্জে ব্যবহৃত সিসার নিকোটিন মাত্রা গড়ে পাঁচ থেকে সাত শতাংশের মধ্যে। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়ানোর ‘সম্ভাবনা’ রয়েছে: ডোনাল্ড ট্রাম্প
ইসরায়েলে ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করেছে ইরান
ইসরায়েলের সব বিমানবন্দর ও আকাশসীমা বন্ধ
ক্ষেপণাস্ত্রসহ আকাশপথে ইরানকে সহায়তা করছে চীন-রাশিয়া
রিজার্ভ বেড়ে ২৬.১৫ বিলিয়ন ডলার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
এক ভবঘুরের বস্তায় পাওয়া গেলো তিন লক্ষাধিক টাকা
কি এমন হয়েছিলো দীপার সঙ্গে, যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন!
ইরানের হামলায় আটকে গেল নেতানিয়াহুর ছেলের বিয়ে
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার জন্য জরুরি নির্দেশনা
আখাউড়া সীমান্তে খুলে ফেলা হলো সিসি ক্যামেরা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft