কাকপক্ষী হয়তো টের পেয়ে গেছে, গোপন সিদ্ধান্ত বোধকরি এমনই ছিল; শাহিন শুধু ঘুণাক্ষরে কিছু জানতে পারেনি। অবশ্য জানার কথা নয়। কয়েকদিন ধরে বাসায় পড়ে আছে। সে বেশ অবাক হয়। একটু বিষাদও, কেননা খারাপ সময়ে কারও আনুষ্ঠানিক সহমর্মিতায় আন্তরিকতা থাকে না; লেপটে থাকে অনুকম্পা বা করুণা। শাহিন চুপ করে থাকে। মনের কথা গোপনে থাক। সে জানল দিন কয়েক পর। সেদিন বিকালে দেড় জোড়া মোটরবাইক দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। অনেকদিন কারও দোরগোড়া খুঁজে নিতে একসঙ্গে তিন-চারটি মোটরবাইক গলিতে আসে না। কয়েকজন যেমন অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে দেয়াল দেখে অবাক হয়, গলির কুকুর দুটোও ঘেউ ঘেউ করে ওঠে; শাহিন শুধু বিস্মিত নিশ্চুপ। কুকুর জোড়ার একটি পুরুষ অন্যটি নারী। এদের আশ্চর্য স্বভাব এই যে, প্রত্যেক সন্ধে আর রাতের আযান লাউডস্পিকারে গমগম করে উঠলে প্রাণিদুটো আর স্থির থাকতে পারে না। যতক্ষণ আওয়াজ ততক্ষণ ঘেউ ঘেউ। কেউ কেউ রেগেমেগে বলে, ‘এই কুকুর দুটো সাক্ষাৎ শয়তান।’ ফজর আজানের সময় চারিদিকে ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। ভোরের ঘুম ভাঙিয়ে ছাড়ে। শাহিনের সেই সময়টুকু অসহ্য লাগে। এখনো তেমন। অর্থীর চোখে-মুখে শুধু অন্যরকম অভিব্যক্তি। তার ঘরে বুঝি কয়েকজন ফেরেস্তা এসেছে। শাহিন তখন চোকিতে কোনোমতো দুই হাতে ভর দিয়ে কোমর টেনে টেনে উঠে বসে। আধশোয়া হয়। বেডশিটের যা অবস্থা! ছেঁড়াফাটার চেয়ে অগোছালো ময়লা বড্ড লাগে। তার শরীরে বোঁটকা গন্ধ। আজ দুই-তিনদিন স্নান নেই। পায়খানাও একরকম বন্ধ। বেডে শুয়ে শুয়ে হাগতে হয় না এই শোকর। অর্থীর কাঁধে হাত রেখে ধীরে ধীরে টয়লেট পর্যন্ত যায়। ছোট রুমটির পাশে একটি টুল দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিচে খবরের কাগজ বিছিয়ে নেয়। অনেক কষ্ট অবশ্য। শাহিন জীবনে এমন কষ্টে পড়েছে কি? বেঁচে থাকার খেরোখাতায় শুধু যন্ত্রণার খতিয়ান।
আজ বিকেলে বুঝি চারিদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। অতিথি তো তিথি বুঝে আসে না। তারা কি অতিথি? অর্থী এদিক-ওদিক থেকে দুটো চেয়ার-টুল ঘরে এনে রাখে। অত্যন্ত মৃদুস্বরে সালাম দেয়। সে এমনিতে ধীরস্বভাব। স্থির শান্ত গলায় কথা বলে। শাহিনের অব্যাখ্যাত অহংকার। অর্থীর কণ্ঠস্বর সাবিনা-রুনার চেয়ে কম না। তেমন সুযোগ থাকলে গান শেখানোর ব্যবস্থা করত শাহিন। হারমোনিয়াম আর তবলা-বায়া কিনে নিত বড়বন্দর থেকে। সেখানে বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায়। একদা মন্টু দাশের সঙ্গে কথা বলেছিল। সে-সময় কলেজে পড়ত শাহিন। গিটার শেখার প্রচণ্ড শখ চেপেছিল। ছয়তারের মধ্যে সুরের টুং টাং। তখন জেনেছিল, গিটারের প্রকারভেদ আছে। গানের সুর তোলার জন্য হাওয়াইয়ান গিটার। আছে স্প্যানিশ। আর কী কী মনে নেই। সবচেয়ে ভালো হয় ইলেক্ট্রিক গিটার। একটি সাউন্ডবক্স দরকার। সেই শখ কোথায় হারিয়ে গেল। অর্থীর কণ্ঠস্বরে পুনরায় শখ নতুন করে জেগে উঠেছিল। বউকে গান শেখাবে। কে জানে একদিন রেডিও-টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করতে পারে অর্থী। শাহিন রেকর্ডিং স্টুডিও-য় বসে বসে শুনবে গানের সপ্তসুর। এক বা দুজন ব্যাকগ্রাউন্ড ভোকাল আরও মায়াময় করে তুলবে সুরের মায়াজাল। সেই স্বপ্ন আর সত্য হলো কোথায়! নিজের টানাপোড়েন জীবনে কত শখ, কি সাধআহ্লাদ ফেলে দিতে হয়; সেটিও হারিয়ে গেল। সে সামনে তাকিয়ে অর্থীর ব্যস্ততা দেখে। কথা শোনে।
‘ভাই আপনারা বসেন।’
‘এখন কেমন আছেন শাহিন সাহেব?’
পরিচালক রেজা হাসান স্বভাবসুলভ দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করেন। সেখানে না আছে আন্তরিকতার স্পর্শ কি যথার্থ কৌতূহল। শাহিন হাসিমুখে জবাব দেয়।
‘জি ভাই, ভালো।’
শাহিন এ ছাড়া আর কী বলতে পারে? সে পা ভেঙে পড়ে আছে ছয়-সাতদিন। ভালো থাকতে পারে? অফিসে ঘটনার পর পরই খবর দেওয়া হয়েছিল। তার খোঁজখবর নিতে সাতদিন লেগেছে। বেশ ভালো। অনেক অনেক দূরে থাকে সে। প্রায় ছয় শত মিটার মাত্র। অবশ্য এনজিওর কাজ। সকলের হাজার ব্যস্ততা থাকে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুসারে টার্গেট ও অ্যাচিভমেন্টের ঘনঘটা আছে। নিজেদের মান্থলি ওয়ার্কপ্ল্যান। ইত্যাদি। সেদিন সন্ধেয় অবশ্য অফিস পিওন এসেছিল। রশিদের চেহারায় চাপা হাসি। পৃথিবী এমনই। কেউ কারও কষ্ট দেখে আমোদিত হয়। কারও চোখ ভিজে ওঠে। প্রথম শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেশি। শাহিন মন থেকে সবকিছু মুছে ফেলতে পারে না। রশিদ বলে, -
‘এ কী করেছেন ভাই! গলির মধ্যে বাইক চালানো শেখে কেউ? বড়মাঠে গেলেন না?’
‘এই ছোটভাইয়ের গাড়িটা পেলাম তো!’
‘কোথাও ফ্র্যাকচার হলো কি না দেখেছেন?’
শাহিনের বুকের গহিনে দুর্ভাবনা উঁকি দেয়। কে জানে হতেও পারে। অনেক সমস্যা তবে সামনে। তার বাঁ-হাঁটুর পেছনের মধ্যখানে তীক্ষè খচখচ লাগছে। এই সাঁইত্রিশ-আটত্রিশে এসে শরীরের মধ্যে খুঁত তৈরি করে ফেলল। অর্থী সেদিন বাধা দেয়। শাহিনের শোনা উচিত ছিল। শাহিন এখন চেহারা মøান করে আধশোয়া অবস্থায় হাসি টেনে আনতে চেষ্টা করে। পরিচালক পরামর্শ দেন।
‘এক্স রে করে ফেলেন। আর একটা মেডিকেল লিভের দরখাস্ত পাঠিয়ে দেবেন। ঠিক আছে?’
‘জি ভাই।’
শাহিন পরদিন এক্স রে করে ফেলে। মাইনর ফ্র্যাকচার, কিন্তু পজিশন কমপ্লিকেটেড। অর্থীকে দিয়ে সেই খবরের সঙ্গে ছুটির অ্যাপ্লিকেশনও মুখবন্ধ এনভেলাপে পাঠিয়ে দিল। সেখানে অন্য এক করুণ আবেদনও আছে। তারপর প্রায় সারাদিন কাটিয়ে দেয় অর্থপেডিক ডাক্তারের কাছে। প্রখ্যাত চিকিৎক। নামের পাশে এ-বি-সি-ডির মতো অনেকগুলো বর্ণ। এগুলো নিশ্চয়ই অনেক বড় ডিগ্রি। এ ছাড়া ইউএস-অস্ট্রেলিয়ার বিদেশি ট্রেনিং-এর কী কী সব লেখা। শাহিন কিছু বোঝে না। তার মনে পড়ে পুরোনো কথা। সে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। মা হিন্দি মুভির ভক্ত ছিল। ছেলেকে মুভির নায়কের মতো পাইলট হিসেবে গড়ে তুলবে। বাবার শখ ব্যারিস্টার। শাহিন না হতে পারল পাইলট, বা ব্যারিস্টার অথবা অনন্ত অভিলাষ ডাক্তার; পরিশেষে হলো এনজিও কর্মী। সেও কয়েক মাস স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে চাকরি। সে ডাক্তার হলো না কেন? স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয়পত্রে রচনা লিখেছে কয়েকবার। ডাক্তার হয়ে গ্রাম ও বস্তির হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা দেবে। অনেক টাকা জমা হলে একটি ক্লিনিক বা হাসপাতাল। সেখানে গরিব মানুষের জন্য খরচ ছাড়াই চিকিৎসা সেবা অবারিত থাকবে। কোথায় গেল রচনা আর স্বপ্নসাধ! শাহিন কিছু হতে পারল না।
একাত্তর এসে সব স্বপ্ন রয়েল ব্লু কালিতে লেখা রচনা যেমন বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়ে যায়, সেগুলোও মুছে গেল। এক কোটি শরণার্থীর মতো ভারত পালাতে পারল না সে। বাবা তাদের নিয়ে শহর ছেড়ে একদিন এই গ্রাম, অন্যদিন সেই গ্রাম করে করে পালিয়ে বেড়ালো। জীবন হাতে নিয়ে বেঁচে থাকা। নেই খাওয়া নেই নাওয়া। তার উপর অসুখ। ডাক্তার নেই। ওষুধ নেই। মৃত্যুর আতঙ্ক সবসময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কয়েকমাস এভাবে অচেনা কষ্টের সঙ্গে যুদ্ধ হলো। একদিন শহরের পরিস্থিতি কিছু থিতু হয়েছে শুনে রবাহূতের মতো চলে এলো। বাড়িঘরের কিছু নেই। বিহারি লুটেরার দল দরজা-জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। তারা চেনাজানা প্রতিবেশী। কোনো কথা বলা যায় না, প্রতিবাদ তো দূরের কথা; তাদের আস্তিনের তলায় চকচক করছে শাণিত খঞ্জর। পুনরায় নতুন করে জীবনযাপন। বেঁচে থাকতে হলে খাবার দরকার। সেজন্য বাবা কাজে যোগ দিলো। শাহিন স্কুলে উপস্থিত হয়। ক্লাস তেমন হয় না। তাই প্রাণের ভয় গেল না। রাস্তায় হাঁটতে, বাজার যেতে, কথা বলতে এমনকি রাতে নিশ্চিতভাবে ঘুমোনো যাবে কিনা সন্দেহে মন জেগে থাকে। বাবা খুব নিচু ভলিউমে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের খবর শোনে। দেশ স্বাধীন হবে। সেই স্বপ্ন সফল হবে কবে? শাহিন স্বপ্ন দেখে একদিন মুক্ত পাখির মতো আকাশে ভেসে বেড়াবে। নতুন দেশ। নিজের মাতৃভূমি।
দেশ স্বাধীনের পর নিয়তিতে সিলছাপ্পর পড়ে গেল। তার বাবা দালাল। তাকে জেলে নেওয়া হলো। শাহিন, ক্লাস সেভেনে পড়া বহির্জগৎ সম্পর্কে একেবারে ধারণাবিহীন বালক কাঁধে তুলে নিল সংসারের হাল। স্কুল আর পড়ালেখা লাঠে উঠল। দীর্ঘ এগারো মাস জেল খেটে বেরোল বাবা। আগস্ট একাত্তর থেকে অফিস ও রাস্ট্রীয় কাজে সহযোগিতার অপরাধের দায় স্বীকার করে মুক্তি। এই সমাজে কেউ অপরাধ করে সাধু থাকে আর নিরপরাধ কারও কপালে অপরাধীর তিলক। বাবা নতুন উদ্যমে সবকিছু শুরু করলেও শাহিনের চোখে আর আলো জ্বলল না। অচেনা অভিমান প্রচণ্ড জেদের মতো বুকের কোণায় পাথর হয়ে বসে গেল। মানুষজন খারাপ। প্রতিবেশীরা খারাপ। ঈশ্বর ভালো নয়। তিনি শুধু কষ্ট দেন। অবিচার করেন। শাহিন আর কোনোদিন জায়নামাজে দাঁড়াল না। সবকিছু ভড়ং মনে হয়। একসময় চোখে সূর্যের সাত রং মুছে গেল। কবে কখন কীভাবে জানা নেই। সে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। সেই ভুল স্বপ্ন দিগন্তরেখায় ধুমকেতুর পুচ্ছ হয়ে ধীরে ধীরে ক্ষত রেখে হারিয়ে গেল।
শাহিন আশপাশে তাকায়। এলোমেলো স্মৃতি কোনো সরু গলি দিয়ে উঁকি মেরে দেখে থাকে। সে দেয়ালে বিবিধ পোস্টার পড়ে। নোটিশ বোর্ড। একজন রোগী দেখা ও পরামর্শের ফিস তিনশত টাকা। প্রথমবার। পরের বার দুই শত। প্রেসক্রিপশনের মেয়াদ দেড় মাস। এরপর প্যাডের নতুন পাতা নিতে হবে। ফিস পুনরায় তিনশত টাকা। একজন ডাক্তার প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে লাঞ্চ ও অন্যান্য বিরতি দিয়ে রাত আট কি নয় পর্যন্ত গড়পরতা রোগী দেখে পঞ্চাশ থেকে ষাটজন। অঙ্কের হিসাব খুব সহজ। চিকিৎসা এখন সেবা নয়, ব্যবসা; মানুষের জীবনমরণ নিয়ে চমৎকার বাণিজ্য। একসময় সেবা ছিল, ডাক্তার রোগীর বাড়ি যেত; এখন যায় না। আগে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছিল না। এখন এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্লিনিক বা হাসপাতাল ব্যবসা। আধুনিকায়ন আর বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার সমাজের মধ্যে কত শোষণ আর বৈষম্য তৈরি করে চলে। শাহিন ডাক্তার হতে চেয়েছিল।
ওইদিন মাসের আধেক দিনগুলোর খরচপাতির জন্য রাখা সব টাকা ডাক্তারকে দিতে হয়। শাহিন বাঁ-পায়ের উরু থেকে নেমে আসা কড়ে আঙুল পর্যন্ত ধবধবে প্লাস্টারের দিকে তাকিয়ে মন কালো করে ফেলে। এই ফ্র্যাকচার রিপেয়ার হতে হতে পাঁচ-ছয় মাস। এরপর আছে ফিজিক্যাল থেরাপি। সে কি আগের মতো শক্তি পাবে? সাইকেল চালিয়ে অফিস যাওয়া-আসা? তার জানা নেই। সে জানে না আগামীকাল থেকে দিন কেমন যাবে? জীবনযাপনের জন্য টাকা দরকার। টাকা হলো পুণ্য। তার জীবনে কোনো পুণ্য নেই। সে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অর্থী নিশ্চিত পাশের বাড়ি থেকে কাপপিরিচ এনেছে। ট্রে-য় বিস্কুট আর কাপে কাপে লাল চা। পরিচালক রেজা চায়ে একচুমুক দিয়ে রেখে দিলেন। তারপর নজরুলকে ইশারা। শাহিন নড়ে উঠল। তার আবেদন তবে নিশ্চয়ই মঞ্জুর হয়েছে। জীবনে কোনোদিন হাত পাতেনি। এবার সেই কাজ করতে হয়েছে। গরিব মানুষকে অনেককিছু করতে হয়, যা সে করতে চায় না; কিন্তু নিয়তি কিংবা কে জানে বেঁচে থাকার মায়াজাল। নজরুল ইসলাম যখন হলুদ এনভেলাপ এগিয়ে ধরে, শাহিন হাতে নিয়ে মনে মনে হালকা বাতাসেও একেবারে গুটিয়ে যায়। একদিনের বেতন। নিশ্চয় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। অভাবে স্বভাব নষ্ট। স্বভাবহীন মানুষের আবার মানসম্মান কি? তার মনে স্বস্তি এলেও শরম করে। সে-সময় আযানের ধ্বনি লাউডস্পিকারে ছড়িয়ে পড়ছে। গলির কুকুরদুটোও শুরু করে দেয় তারস্বর চিৎকার। শাহিনের দৃষ্টি সেই যে নিচে নেমে গেল, উঠল না; নিজেকে তার কুকুর মনে হতে লাগল। তার ইচ্ছে হয় চিৎকার দিয়ে কাঁদে। কেন? সে কথা না হয় থাক।
তারপর পুনরায় মোটরবাইকের জোরালো আওয়াজ। পেট্রোল পোড়ার ধোঁয়া আর গন্ধ। অর্থী চায়ের কাপ ওঠাতে ওঠাতে অপাঙ্গে তাকায়। শাহিন একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। অর্থী কি বুঝতে পেরেছে? কে জানে। তারপর রাত হলে অথবা একটু নিরিবিলি সময়ে এনভেলাপ খুলে দেখবে। কত টাকা সহায়তা পেয়েছে? অর্থী টিউবওয়েল পাড়ে বসে কাপপিরিচ ধোয়। শাহিন সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অর্থীর কষ্ট হচ্ছে। তার কাঁধে ভর দিয়ে টয়লেটের দোরগোড়ায় যায় শাহিন। সেখানে বাইরে একটি টুল দেওয়া আছে। সে টুলে বসে। অর্থী দেয়ালের ওপাশে পাহারা দেয়। কেউ যাতে ওখানে হুটহাট প্রবেশ না করে। শাহিন কোনোমতো নিজেকে পরিষ্কার করে ডাক দেয়। অর্থীর কাঁধ খোঁজে। এবার একজোড়া ক্র্যাচ কিনে নেবে। শাহিন বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা এনভেলাপ বের করে। অর্থী এরমধ্যে কাপপিরিচ আর কী কী সব দিয়ে ফিরে এসেছে। তারপর বেশ সন্ধিগ্ধ অথবা ভাবলেশহীন তাকায়।
‘একটা কথা বলব নিলুর আব্বা?’
‘বলো। তুমি কথা বলবে তার অনুমতির দরকার আছে? তুমি যে কী!’
‘তুমি সাহায্য চেয়েছিলে অফিস থেকে? কেন এটা করলে?’
‘সবাই তো নেয়। তা ছাড়া টাকার দরকার।’
‘সবার সাথে নিজেকে নামিয়ে নিলে কেন তুমি? কেন? আমি না হয় কানের দুলজোড়া বিক্রি করে দিতাম।’
‘বাদ দাও তো অর্থী। দেখ তো খামটা খুলে...কত টাকা?’
‘তোমার টাকা তুমি গোনো।’
অর্থী ঘর থেকে বেরিয়ে ছোট্ট বারান্দার এককোণায় গিয়ে বসে। শাহিন মৃদু আলোয় টাকা গোনে। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার নয়। দুই হাজার তিন শত ষাট টাকা। একদিনের বেতন নয়। সকল কর্মীর মধ্যে যার যার সামর্থমতো সাহায্য। শাহিন মরমে মরে যায়। সে এমন করল কেন? ওদিকে কেউ খুব চাঁপাস্বরে ফুঁপিয়ে কাঁদে। অর্থীর কণ্ঠস্বর অসম্ভব সুন্দর। তার কান্নাও কত মায়াময়! শাহিন ভেবে রেখেছিল তাকে গান শেখাবে। সাতসুরের আরোহ-অবরোহে জেগে থাকবে সুরের মায়াজাল। সে বোধকরি আর পারবে না। অর্থীর কষ্ট বুঝি নিজের বুকে বেজে ওঠে। আহ কষ্ট! শাহিনের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। এদিকে লোডশেডিং এসে সবকিছু আরও নিথর-নিশ্চুপ করে দেয়। বাতাসে জেগে থাকে শুধু চুপচাপ কান্নার ধ্বুন। শাহিন আবছা অন্ধকারে খুব চেষ্টায় চোকি থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে। অর্থীকে একবার জড়িয়ে ধরার সাধ হয়। তার কান্না যে বড় কষ্ট দেয়। শাহিন একটি পা মেঝেতে রেখে শক্তি হাতড়ায়। প্লাস্টার দেওয়া পা বড় ভারী লাগে। তারপরও...তাকে যে দাঁড়াতে হবে।
এদিকে অর্থীর কান্না ইথারে সাত রং হয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে।
আজকালের খবর/আরইউ