শেরপুর থেকে ভবানীপুর আঠারো কিলোমিটার পথ। প্রসস্ত পাকা রাস্তা। এই রাস্তায় ভারি যানবাহন চলে না। ভ্যান, রিকশা আর বাইকে চলাচল করে এই এলাকার লোকজন। মাঝামাঝি এলাকায় রাস্তার পাশে কোনো জনবসতি নেই। এখানকার গ্রামগুলো একটু আলাদা ধরনের। এই রাস্তা থেকে প্রতিটি গ্রামের জন্য আলাদা রাস্তা আছে। গ্রামগুলো এই রাস্তা থেকে এক দেড় কিলোমিটার দূরে দূরে অবস্থিত। কালের পরিবর্তনে এখন সব রাস্তাগুলো পাকা। আম্বইল বাজারের বেশ খানিকটা দক্ষিণে একটি রাস্তা বিশ্বা গ্রামের দিকে চলে গেছে। এখান থেকে কোনোদিকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বাড়িঘর নেই। শুধু রাস্তার সংযোগ স্থলের পাশে রয়েছে একটি ছোট সেমিপাকা বাড়ি। বাড়িটা খুব পুরাতন না। চার পাঁচ বছর হলো হয়েছে। একটি বিশাল দিঘীর পাশে এই বাড়িটি। বাড়ির লোকজনের সাহস আছে বলতে হয়। তা ছাড়া এমন ভুতুড়ে জায়গায় থাকতে পারত না। প্রসস্ত পুকুর পাড়টি আগাছায় ছেয়ে জঙ্গল হয়ে আছে। রাস্তার পাশে পাড়ের কোনায় বিশাল একটি আম গাছ। এই গাছের ছায়াতলে এক টুকরো জমিতে এই বাড়িটি। আমগাছের একটি বিশাল ডাল বাড়ির একটি অংশকে ছায়া দিয়ে রেখেছে। গরমকালে শান্তির জায়গা।
ধীরেন বাবুর বাড়ি ছিল পাশের গ্রামে। চার পাঁচ বছর আগে ভাইদের সাথে পৃথক হয়ে, পুরাতন বাড়ি ছেড়ে রাস্তার ধারে পৈত্রিক সম্পতিতে এই বাড়িটি করেছে। বাড়ির সামনে আম গাছের নিচে একটি ঘুন্টি দোকান। দোকানে বেচার মতো তেমন কিছু নেই। দু-চার প্যাকেট কমদামী বিস্কুট আর পান বিড়ি-সিগারেট। সাথে চা। ধীরেন বাবু আর তার স্ত্রী দুজন মিলে দোকান চালায়। ধীরেন বাবুর বয়স সত্তরের কিছু বেশি হবে। দোকানের পাশে ছোনের ছাউনির নিচে বাঁশের একটি বড় মাচান। এই মাচানে বসে লোকজন চা-বিড়ি খায়। কিন্তু এই জনবসতীহীন জায়গায় চা খেতে আসবে কারা এটিই মাথায় ঢোকে না। আমার মতো কয়জন পথচারীই বা এখানে বসে চা খাবে। এই রাস্তায় অনেক যাতায়াত করা হয়। কখনো এখানে বসা হয়নি। আজ কিছুটা কৌতুহলী হয়েই দুই বন্ধু বসলাম। হাতে বেশ সময়ও আছে। দিনের যে তাপমাত্রা বাইকে বসেও গা পুড়ে যাচ্ছিল। তাই ছায়ায় বসে একটু আরাম করাও হবে আর চা খাওয়াও হবে। এমনটি ভেবেই দুজন বসে পড়ি বাঁশের মাচানে।
দোকানে মালপত্র তেমন না থাকলেও, দোকানটি অনেক পরিস্কার। দোকানের একপাশে মাটির উঁচু একটা ঢিপিতে তুলশি গাছ লাগানো। দুজনের চেহারাও বেশ সুন্দর। বয়স্ক লোক, গলায় কাঠের মালা দেখে কাকাবাবু সম্বোধন করে দু-কাপ চা দিতে বললাম। তুলশি গাছ দেখে বললাম- চায়ে তুলশি পাতা দিতে। ধীরেন বাবুর স্ত্রী যত্ন করে দু-কাপ চা করে দিলেন আমাদের। চায়ে চুমুক দিয়ে দুজনের সাথে কথা হলো। বললাম- কাকাবাবু মানুষ দোকানপাঠ করে সাধারণত লোকালয়ে। আপনি তা না করে এই জনশূন্য জায়গায় দোকান করেছেন কেন? এখানে লোকজন আসে? মৃদু হেসে কাকাবাবু উত্তর দিলেন, আপনাদের মতো অনেক পথচারী বসে বাবা। বললাম- এই দোকানের আয়ে সংসার চলে? আবারো মৃদু হেসে বললেন- ভগবান চালায় বাবা।
এই পথে কখনো আসা হলে ইচ্ছে করেই বসে একটা চা খেয়ে যাই। দুজন মানুষের সাথে বেশ খাতির হয়ে গেছে। মহিলাকে কাকি মা বলে ডাকি। বেচারি খুব যত্ন করে চা তৈরি করে দেন। কিছুদিন আগে মেয়ে বিয়ে দিলেন। আমাকে দাওয়াত করেছিল। বেশ বড় আয়োজনই করেছিল। আমিও এসেছিলাম বিয়েতে। অনেক টাকা খরচ করেছে বেচারা। এই দোকানের আয়ে সম্ভব হয়নি। হয়তো জমিজমা আছে।
ইদানীং দোকানে বেশ লোকজন দেখা যায়। বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেরা দূর দূরান্ত থেকে বাইক নিয়ে এসে মাচানে বসে চা-সিগারেট খায়। নির্জন এলাকার জন্য আসে হয়তো। লোকালয়ে বসে সিগারেট টানতে পারে না। তাই এদিকে আসে। এদের উছিলায় ধীরেন বাবুর দোকানটা বেশ চলে এখন।
এক শীতের সকালে ওইদিক দিয়ে যাওয়ার সময় দোকানে বসে তুলশি চা খেলাম। ধীরেন বাবু দাওয়াত করলেন, সামনে মঙ্গলবার থেকে পাশের গ্রামে তিন দিনের মেলা। রাতে যাত্রাপালাও হবে। দুজন মানুষই আন্তরিকতার সাথে একদিনের দাওয়াত করলেন। আমারও যাত্রা দেখার একটা লোভ আছে। তাই কথা দিয়ে আসলাম, আসব কাকাবাবু। প্রথম দিনই আসব।
আজ মেলা শুরু। সকালেই মনে হয়েছে। রাতে মেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেই দুই বন্ধু। রাত ৯ টার দিকে আমরা ধীরেন বাবুর দোকানে যাই। আজ দোকানে অনেক লোকজন। এক কিলোমিটার দূরে মেলা হলেও, এখানে লোকজনের চাপ অনেক। ভালো বেচা-বিক্রি হচ্ছে। রাত দশটার দিকে আমরা ধীরেন বাবুর বাড়িতে মিষ্টি মুখ করে মেলায় যাই। খুব জোরাজোরি করছিলেন ভারি খাবার খাওয়ার জন্য। কিন্তু আগেই এক বন্ধুকে বলে রেখেছিলাম। ওর বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এই এলাকায় অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। ওদের সাথে আড্ডা দিয়ে হানিফের বাড়িতে রাতের খাবার সারি।
মাইকে প্রচার হচ্ছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে আজকের যাত্রাপালা। আমরা সঠিক সময়ে চলে যাই যাত্রা মঞ্চে। একটু পর শুরু হয় যাত্রা পালা। রাতভর যাত্রা দেখে ভোরের দিকে হানিফের বাড়িতে গিয়ে ঘুমাই। বেলা এগারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে বাড়ির দিকে রওনা হই।
ধীরেন বাবুর দোকানের সামনে দিয়েই আসতে হয়। আমরা দোকানের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়াই। দোকানটি বন্ধ। বাঁশের মাচানে বসে বিড়ি টানছে মাঝ বয়সী দুজন কৃষক। হয়তো মাঠে কাজ করতে এসেছে। একটু জিড়িয়ে নিচ্ছে আর বিড়ির অমৃত স্বাদ নিচ্ছে। বললাম, দোকান বন্ধ হয়েছে কখন? একজন বলল- আজ সকাল থেকেই দোকান বন্ধ। ভোর রাতে পুলিশ এসে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই ধরে নিয়ে গেছে। বললাম- কেন? লোকটি বিড়িতে একটা আয়েসী টান দিয়ে বললেন- ধরবে না, এরা এলাকাটি শেষ করে দিছে। এই দোকানে বসে ইয়াবা, গাঁজা সবই বেচে দুজন। কাল রাতে পুলিশ এসে এক হাজার পিস ইয়াবা আর তিন কেজি গাঁজা সহ দুজনকে ধরে নিয়ে গেছে।
আমার মনে পড়ল একটি কথা, এই দোকানের আয়ে সংসার চলে কাকা? -ভগবান চালায় বাবা।
আজকালের খবর/আরইউ