প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৬ মে, ২০২৫, ৩:৪২ PM
বিশ্বে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির ভেতরেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যেকার চলমান আলোচনা স্থগিত হয়েছে। মূলত উভয় দেশের মতবিরোধের কারণেই এটি ঘটেছে। ইরানের পরমাণু ইস্যুটি এমন একটি ইস্যু যেখানে ঐক্যমতে পৌছানো অত্যন্ত কঠিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি আরো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি বাদ দেওয়ার শর্ত ইরান কখনো মানবে বলে মনে হয় না। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশ এই কর্মসূচি চালিয়ে গেলে ইরানের ওপর থেকে সন্দেহ পুরোপুরি যাবে বলে মনে হয় না। এই ইস্যুটিই বছর বছর সামনে আসবে। ওমানের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিন দফা পরোক্ষ আলোচনা হয়েছে। ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখা এবং এর বিনিময়ে ওয়াশিংটনের আরোপিত আর্থিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার উদ্দেশে এই আলোচনা চলমান আছে। পরমাণু ইস্যুতে চলমান পরোক্ষ বৈঠকের মধ্যেই গত বুধবার ইরানের একাধিক জ্বালানি কোম্পানিকে লক্ষ্য করে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর কাছ থেকে এই নতুন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসে। এখানেই শেষ নয়, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেন, ইরান থেকে যারা জ্বালানি কিনবে তাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। এদিকে ইরানের পরমাণু ইস্যু নিয়ে এখন বেশ সরব ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক কথায় এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ইসরায়েল চায় না ইরানে পারমাণবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকুক। অর্থাৎ কোনোভাবেই ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম না হয়। তিনি দাবি করেছেন, একমাত্র গ্রহণযোগ্য চুক্তি হবে যদি ইরান তার সামগ্রিক পারমাণবিক অবকাঠামো বাতিল করতে সম্মত হয়। এখানে তিনি লিবিয়াকে উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন। ২০২৩ সালে পশ্চিমাদের সঙ্গে লিবিয়ার চুক্তি অনুযায়ী তারা পারমাণবিক, রাসায়নিক, জৈবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বাতিল করতে রাজি হয়। প্রশ্ন হলো এটি কেন চায় দেশগুলো? এর কয়েকটি কারণ থাকলেও স্পষ্টভাবে দুটি কারণ বলা যায়। প্রথমত. পরমাণু অস্ত্র হাতে থাকা অর্থ সেই দেশ নিজের অস্তিত্ত্ব রক্ষায় সবশেষে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবেই এবং দ্বিতীয়ত. পরমাণু অস্ত্রে আর কোনো দেশ সজ্জিত হোক সেটি পৃথিবী আসলেই চায় না। তবে পরমাণু কার্যক্রম যদি উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয় তাহলে অবশ্যই সেটি করতে পারে। সেক্ষেত্রে এর বিপদজনক মাত্রা অতিক্রম কখনোই করা চলবে না। যা ইরানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল।
পরমাণু চুক্তি একটি প্রায় মৃতপ্রায় চুক্তি এবং একটি মৃতপ্রায় চুক্তি পুনরায় বেঁচে উঠবে কিনা সেটিই প্রশ্নের। এখানে মূলত দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের মতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি যে কোনোভাবে বন্ধ করা এবং ইরানের দিক থেকে প্রয়োজনীয় সাড়া প্রদান। যদি ইরানের স্বার্থ নিহিত না থাকে তাহলে ইরান কেন রাজি হবে? এর একটি উপায় হবে চাপ প্রয়োগ। অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ যা এর আগেও করা হয়েছে। সামরিক শক্তির মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করার বিষয়টি আপাতত বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালীন এটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং যেকোনোভাবেই ইরানকে রাজী করানোর চেষ্টা করবেনই। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ সংস্থার প্রধানের তেহরানে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে এমন বিস্ফোরক তথ্য সামনে আনলো আইএইএ। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) সতর্ক করেছে ইরান বিপজ্জনকভবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আইএইএ-এর ফেবরুয়ারি মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান বর্তমানে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রায় ২৭৪ দশমিক আট কেজি মজুদ রেখেছে। পরমাণু সমঝোতায় ইরানকে সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোগ্রাম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ইরান ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত ওই সমঝোতা মেনে চলেছিল।
পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে প্রায় ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ একেবারে কাছাকাছি মাত্রায় রয়েছে দেশটি। ইরানের পারমাণবিক ইস্যুটি মৃত না জীবিত তার থেকেও বড় প্রশ্ন হলো কতদিন এই ইস্যুটি ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে সেটি। ট্রাম্প যে কৌশলে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করছেন এবং খনিজ চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পর মনে হচ্ছে স্থায়ীভাবে যুদ্ধটা বন্ধ হতে যাচ্ছে, অর্থাৎ হতে পারে এখানে তিনি সফল হতে যাচ্ছেন। ইরানের ক্ষেত্রেও তিনি প্রচেষ্টার সর্বোচ্চ সীমায় পৌছাবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে কী ঘটতে পারে? দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে এবং মাঝে মধ্যেই এটি সামনে আসে, উত্তেজনা তৈরি করে। ট্রাম্পের ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদের কেবল শুরু মাত্র। কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে পুরো সময় ধরেই এ ধরনের উত্তেজনা বিশ্বকে দেখতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে যা ঘটবে তা হলো মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত থাকবে এবং ইরান সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব লেগে থাকবে। যুদ্ধ হয়তো হবে না তবে এটিও এ অঞ্চলের জন্য ভালো হবে না। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে কড়া নিষেধাজ্ঞায় ইরানও সমস্যায় রয়েছে। ইরানের পারমাণবিক ইস্যুটি আগে থেকেই পশ্চিমা দেশ, ইসরাযৈল ও আরো কয়েকটি দেশের কাছে দুশ্চিন্তার কারণ। পারমাণবিক চুক্তির পুনরুদ্ধারের ইস্যুটির কোনো সমাধানের পথ দেখছে না। বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরেই ঝুলে আছে। আগেও কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কার্যত তেমন কিছুই হয়নি। ইরানের সাথে পরমাণু ইস্যু নিয়ে পশ্চিমা দেশের সাথে দীর্ঘদিন টানাপোড়ন চলছে। ইরান যদিও বারবার বলছে, এটি বেসামরিক উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে কিন্তু যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে পরমাণু অস্ত্র দরকার সেক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা থেকে সরে যেতে খুব বেশি ভাবার অবকাশও থাকবে না। কারণ অস্তিত্ত্ব রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপোষ নয়। ২০১৫ সালে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার জন্য ইরানের সঙ্গে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্লান অব অ্যাকশন-জেসিপিওএ নামে পরিচিত পরমাণু চুক্তিতে পৌছায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ছয় শক্তিধর দেশ।
দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, চীন ও রাশিয়া। এইবার আলোচনার ক্ষেত্রে রাশিয়ার আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। মৃত চুক্তিটি আবার পুনরোজ্জীবীত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ সালে শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। অর্থাৎ চুক্তিটি আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি। আপাতত কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ব্যাপারে এখন জোর দিচ্ছেন। মৌখিকভাবে বলার পর তেহরানের চিঠি পাঠানোই সেটির প্রমাণ। তবে চিঠি পাওয়ার পর আবারো আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানালেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই আলোচনার উদ্যোগ নিলেও ট্রাম্প এ সিদ্ধান্তের সম্মান করবেন না। আর এমন হলে এ আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। এসময় ২০১৫ সালে করা পরমাণু চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে ট্রাম্পের বেরিয়ে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের বিষয়টি স্মরণ করের খামেনি। পরমাণু ইস্যুটি পৃথিবীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ একদিকে যেমন দেশকে কোনো বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকি থেকে রক্ষা করতে একটি কার্যকর অস্ত্র তেমনি পৃথিবীর অস্তিত্ত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিও বটে। জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোট পাচ হাজার ৯৭৭টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে রাশিয়ার, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ৫৫০টি বেশি। বিশ্বে মোট পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের ৯০ শতাংশেরও বেশি এই দুই দেশের কাছে আছে। কোনোভাবে এর প্রয়োগ শুরু হলে পৃথিবীর অস্তিত্ত্ব যে থাকবে না সেটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। বৈশ্বিক পরিস্থিতি যেদিকে এগিয়ে চলেছে তাতে কতদিন পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি দেশগুলোকে এ অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখা যায় সেটিই প্রশ্নের। কারণ নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পরমাণু অস্ত্র চাইছে অনেক দেশই।
১৯৭০-এর দশকে রাজতান্ত্রিক শাসনে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রথম পরমাণু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রকল্প থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে দাড়ালেও ইরান প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখে। ২০১৮ সালে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে পরমাণু চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দেন। এখন পরিস্থিতি এমন যে, আলোচনা শুরুও হয় তাহলেও তা কার্যকর হওয়ার নিশ্চয়তা হয়তো বেশি নেই। কারণ উভয় পক্ষেই শর্তের বোঝা যা পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব নাও হতে পারে। এর মধ্যেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়টিও উঠে এসেছে। যদিও সেই সম্ভাবনা কম। কারণ এখন পর্যন্ত ইরানকে চাপে রাখার কৌশল সামরিক নয় ছিল নিষেধাজ্ঞা। মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে নতুন সমীকরণ হচ্ছে। সেই সাথে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিও উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। যদিও ইরান বলেছে এ কর্মসূচি পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য নয় কিন্তু তা বিশ্বাস যোগাতে সক্ষম হয়নি। এই চুক্তির সফলতা নিয়ে আগ্রহী সারা বিশ্ব। ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনোমালিন্যের অন্যতম ইস্যু হলো ইরানের পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধকরণ। প্রায় ঝুলতে থাকা চুক্তিটি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রচেষ্টা হচ্ছে। যদি ইরানকে একতরফাভাবে পরমাণু কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া হয় তাহলে হয়তো কোনো সমাধান হবে না।
অলোক আচার্য: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
আজকালের খবর/আরইউ