কবি সরোজ দেব উত্তর জনপদের একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন। গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য অঙ্গনে সবার প্রিয় পরিচিত মুখ, আমাদের শ্রদ্ধাভাজন সরোজ দা। ছোট-বড় সবার সঙ্গে যার বিনয়সুলভ আলাপচারিতা হৃদয় মুগ্ধ করে তার স্নেহ সান্নিধ্য ভালোবাসায় আমরা সিক্ত হই। কবি সরোজ দেবের জন্ম ২৬ মার্চ ১৯৪৮ গাইবান্ধায়। বাবা ওস্তাদ উপেন্দ্রনাথ দেব। ১৯৬৪ সাল থেকে গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি দীর্ঘকালব্যাপী নিয়মিতভাবে শতাধিক শিল্পনন্দিত লিটলম্যাগ প্রকাশ করে লিটলম্যাগ আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। তিনি লিটল ম্যাগের জনক। শিক্ষা জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে গড়ে তোলেন ‘সংস্কৃতি সংসদ’। ষাট দশক থেকে দুর্দান্ত গতিতেই তার পদচারণায় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন মুখরিত ছিল। নিজের লেখার চাইতে অন্যের লেখার প্রতি তার মনযোগ বেশি ছিল। তার উৎসাহ অনুপ্রেরণায় বহু কবি সাহিত্যিক সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নিজস্ব প্রকাশনা শব্দ প্রকাশনী থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় ও উত্তর জনপদের সম্ভাবনাময় কবিতাকর্মীর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল লিখিয়েদের অনুপ্রাণিত করেছেন অত্যন্ত সহনশীলতায়।
সুনির্দিষ্ট কোনো বিশেষণই সরোজ দেব’র গুণগান শেষ করা যায় না। ব্যক্তি জীবনের দুঃখ হতাশার পাহাড় ঠেলেও সেই তারুণ্যের বেলা থেকেই প্রগতিশীল জীবনবোধের প্রতি তার সীমাহীন পক্ষপাত। একটু ভালোবাসার জন্য উজার করে দিতে পারেন নিজেকে। নিজস্ব বোধ ও অনুভূতির সাযুজ্য খুঁজে পেলে খুলে দেন আবেগের রুদ্ধ দুয়ার। প্রকাশনা, লেখালেখি কিংবা সংস্কৃতিচর্চা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফুটে ওঠে দেশ মাটি ও মানুষের কাছে তার দায়বদ্ধতা। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসছে গোটা দেশ। এ রকম একটি সময়ে কেটেছে সরোজ দেবের কৈশোর ও তারুণ্যের কাল। বাবা প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী উপেন্দ্র নাথ দেব পরিবারে ছড়িয়ে রেখে দিলেন সংস্কৃতির সুবাতাস। আজন্ম প্রতিবাদী সরোজ দেব তাই কখনো বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলে, আবার কখনো সংগীত আর কবিতার মঞ্চে সমানভাবে উচ্চকিত। এরই মধ্যে তার ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে ভাঙা গড়ার খেলা। নতুন এক আদর্শিক প্রেরণায় শপথ দীপ্ত হন তিনি। জড়িয়ে পড়েন বাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে। ’৬৯-এর সেই তালমাতাল দিনে ছাত্রছাত্রীদের বিপুল সমর্থন নিয়ে তিনি গাইবান্ধা কলেজের বার্ষিকী সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। বস্তুত, এ সময় থেকেই লিটল ম্যাগ আন্দোলন ও প্রকাশনা শিল্পের প্রতি তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি চলতে থাকে কবিতা লেখা। এভাবেই কাটে অনেক দিন। আসে একাত্তর।
মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ কিংবা দেশকে ভালোবাসার কথা বলতে বলতে সরোজ দেব’র চোখ ভিজে যায়-তিনি পেছন ফিরে মুখ লুকানোর চেষ্টা করেন। শিশুরা তা বুঝতে না পারলেও তার কাছের মানুষেরা তা ঠিকই বুঝতে পারে। প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সরোজ দেব প্রিয় স্বদেশ ভূমিকে হানাদার মুক্ত করতে সরাসরি সম্পৃক্ত হন মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। বিজয় অর্জিত হবার পর রক্তাক্ত ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে ফিরে এসে সরোজ দেব নতুন উদ্দীপনায় কাজ শুরু করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হবার পর কুশলী সংগঠক সরোজ দেব সংস্কৃতি সংসদের মাধ্যমে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। এ সময় তার উদ্যোগে সংস্কৃতি সংসদ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকা ছাত্রছাত্রী ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭৪ সালে গাইবান্ধায় তার অন্যতম উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সূর্যকণা’। স্থানীয়ভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এ সময় থেকেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। সরোজ দেব ছিলেন সূর্যকণা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
গাইবান্ধা তথা উত্তরাঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে বেগবান করে সরোজ দেব সম্পাদিত ‘শব্দ’। ১৯৬৪ সালে কবিতা পত্র হিসেবে প্রথম প্রকাশিত ‘শব্দ’ই এখন পর্যন্ত অনিয়মিত হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয়ভাবে বেঁচে থাকা একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন। ‘শব্দ’র পরিশীলিত, আকর্ষণীয় অবয়ব আজও সাহিত্যকর্মীদের কাছে প্রিয়।
পুনশ্চ: লেখাটি শেষ করবার আগে ২০০৯ সালে বাংলা একাডেমি চত্বরে অনুষ্ঠিত একুশের বইমেলায় প্রকাশিত বহুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্ত রোদ্দুরে এসো’র উৎসর্গ পত্রটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরতে চাই। এই লেখা থেকে তার সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি-শুভ, মঙ্গলময় সকল কিছু প্রতি তার পক্ষপাত অনুভব করি। সেখানে তিনি লিখেছেন-বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে এক সুন্দর, স্বপ্নময় শোষণহীন, শাস্তি ও সম্প্রীতিময় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত বাংলাদেশের। আর সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে মহৎ সাহসী-ত্যাগী-সৎ মানুষেরা আত্মনিবেদিত, কর্মে-কীর্তিতে-ভাস্বর-উজ্জ্বল তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান আর সময়ের সাহসী-সন্তান তারণ্যদীপ্ত মহৎ মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা রইল...। শ্রদ্ধা আপনার জন্যও প্রিয় কবি সরোজ দেব। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে আপনার অবদান গৌরবের অক্ষরে হৃদয়ে হৃদয়ে লেখা হয়ে গেছে। আপনি যে পথে যাত্রা শুরু করেছেন- সেই পথ ধরে এগিয়ে গেলে নিশ্চয়ই আমরাও একদিন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে যাব।
সরোজ দেব। একজন কীর্তিমান মানুষ। কবি-সাংস্কৃতিককর্মী পরিচয়ে তিনি ধন্য। উত্তরজনপদে আমাদের উঠোনে তিনি সবার প্রিয়ভাজন। জীবনকে সম্পৃক্ত করেছেন কবিতা আর লিটল ম্যাগ আন্দোলনে। কাব্যময় দৈনন্দিন জীবনেও তিনি হাস্যময় এবং উজ্জ্বল তারুণ্যের প্রতীক। ইতোমধ্যে বহু পুরস্কারে তিনি ভূষিত। শতাধিক লিটল ম্যাগ প্রকাশের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে সাথে নিয়ে নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও। মুুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া কবি সরোজ দেব এদেশের মাটি ও মানুষের ভালোবাসার ঋণে সেসব প্রত্যয়ী জীবন, জাতি ও কালকে স্বপ্ন দেখায় উদ্দীপ্ত করে আর চিন্তা করে মানুষের সুখ-শান্তি-সম্ভাবনা ও স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ তাদেরই একজন কবি সরোজ দেব। ব্যক্তিগত বেদনা, আশা-হতাশা এবং সমকালীন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সমাজ সচেতন, প্রতিবাদী, সংবেদনশীল অন্তরঙ্গ প্রেমেরই করুণ-মধুর-সুর দীর্ঘলয়ে অনুরণিত হয়েছে তার কবিতার শরীর জুরে।
সরোজ দেব সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা বা লিটলম্যাগ প্রাণেশ্বরীর মাচান, বজ্রে বাজে বেণু, লাল গোলাপের জন্য, শতদল, মোহনা, সংশপ্তক, শতাব্দী, নান্দনিক বিভিন্ন সময় ১৩৫টি সংখ্যা বের হয়েছে।
সরোজ দেবের কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ধবল মেঘের দিন গুলো (২০০৬), অনন্ত রোদ্দুরে এসো (২০০৯), স্বরচিত সুখের সৎকার (২০১০), স্বপ্ন শুয়েছিল কুয়াশায় (২০১১) ও সময় আমাকে হত্যার কথা বলে গ্যাছে (২০১৩)।
সরোজ দেবের সম্পাদিত গ্রন্থগুলি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসার গল্প (ঢাকা, ২০০৬), শরৎচন্দ্রের ভালোবাসার গল্প (ঢাকা, ২০০৬), কবিতার যৌথ খামার (কাব্য, ২০০৯), নির্বাচিত কবিতা (২০১২), ছোটদের শরৎচন্দ্র (২০১২), নীলাভ রৌদ্রের মোহনায়, স্বপ্নীল স্বদেশ, ডালিম গাছে দোয়েল নাচে, মানুষ নামের মূর্তি, নিসর্গ অভিলাষ, নির্বাচিত পঙ্ক্তিমালা, মাটির কোলে, অ একটি গল্প, আলোক পাখির গান, গোলাপী কামিজ, মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু, অস্তরবির কান্না, অপরাধী, বিবেক যা বলে।
বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তাকে সম্মাননা প্রদান করেছে যার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পদক (২০০), একুশের শহীদ স্মৃতি পদক (২০০৬), আদিবাসী সাহিত্য পদক ময়মনসিংহ (২০০৭), দুই বাংলার কবিতা উৎসব পদক (২০০৭), ছান্দসিক পদক (২০০৮), আনোয়ার আহ্মেদ স্মৃতি পদক (২০০৯), অভিযাত্রিক রংপুর পদক (২০০৯), শেরপুর লেখক চক্র পুরস্কার (২০১০), ছোট কাগজ পুরস্কার (ঢাকা ২০১১), সাত বিভাগ থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগ চিহ্ন সম্মাননা লিটলম্যাগ মেলা ২০১১ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার সম্মাদিত ‘শব্দ’ শ্রেষ্ঠ লিটলম্যাগ এবং কবি সরোজ দেব শ্রেষ্ঠ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্প্রতি ঢাকার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র মিলনায়তনে ‘এবং মানুষ’ লিটলম্যাগ কবি সরোজ দেবকে সংবর্ধিত করেন।
বর্তমানে কবি সরোজ দেব নতুন প্রজন্মকে হাজার বছরের বাঙালির গৌরবময় গাঁথা সংস্কৃতিক, ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার কাজে এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে তার কর্ম প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
এখন সেই তারুণ্যের দিনগুলোর মতো শিশুদের মধ্যে নিজেকে আগের মতো খুঁজে পেয়েছেন কবি সরোজ দেব। আয়োজন করেন বিশাল বিশাল অনুষ্ঠান। কি পহেলা বৈশাখ, কি রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী সবখানেই তার কাছে সবার আগে শিশু। এ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ বিশ্বাস আর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির গৌরবদীপ্ত মানুষগুলোর কথা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েই ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কবি সরোজ দেব এপার বাংলা ও ওপার বাংলা দুই বাংলার সাহিত্য অঙ্গনে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন ও সংবর্ধিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, গাইবান্ধা জেলা শাখার উদ্যোগে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে তার জন্মদিন পালন ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ও তার জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করা আমার সুযোগ লাভ হয়েছিল। এখান থেকেই তার সম্পর্কে তথ্য সূত্র নেওয়া হয়েছে। বার্ধক্য ও অসুস্থতাজনিত কারণে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন সর্বজন প্রিয় এই মানুষটি। সরোজ দেব নেই, আছে তার বহু গুণ কীর্তি। আমরা তাই গর্বিত হই, তাকে স্মরণ রাখবো সর্বকাল।