রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ
অলোক আচার্য
প্রকাশ: রবিবার, ৯ মার্চ, ২০২৫, ৬:০১ PM
কবি উইলিয়াম গোল্ডিং-এর নারীর মূল্য কবিতার বাংলা অনুবাদ এরকম, আমি মনে করি, নারীরা একটু বোকা ধরনের হয়/নইলে নিজেদের তারা পুরুষের সমান ভাববে কেন?/তারা পুরুষদের চেয়ে অনেক অনেক উন্নত এবং সর্বকালের জন্য, চিরকালের জন্য তাই সত্য।/নারীকে যাই দাও না কেন, সে তাকে বাড়িয়ে তুলবে।/যদি একটি শুক্রাণু দাও তাকে, সে দেবে সন্তান।/যদি একটি ঘর দিতে পারো তাকে, সে দেবে সংসার। মুদিও দোকান থেকে চাল ডাল, তেল নুন এনে দাও/সে তোমাকে চমৎকার খারার রান্না করে খাওয়াবে। একটি হাসির বিনিময়ে সে তোমাকে দেবে হৃদয়। সে ছোটকে বড়ো এবং কমকে বেশি করতে জানে। আরও দুলাইন রয়েছে। কবির নারী সম্পর্কিত বর্ণনায় এত উঁচুতে স্থান দেওয়া হয়েছে যে প্রকৃতপক্ষে আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। 

মা, বোন, স্ত্রী অথবা কন্যা, যে রূপেই হোক না কেন, নারীর প্রেম পুরুষের প্রেম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র। উক্তিটি করেছেন। এইচ. জি. লরেন্স। নারী যা অবারিতভাবে দেয়, পুরুষ তা কার্পণ্য করে। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহার নারী। আজকের এই সফলতায় যেমন পুরুষের অবদান রয়েছে তেমনি রয়েছে নারীদের অবদান। এই অবদান মনে করিয়ে দেয়Ñ এ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর। কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতার লাইন। পৃথিবীর মঙ্গলময় সৃষ্টিতে নারীর রয়েছে সমান অবদান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কিন্তু অতীত কাল থেকেই নারীরা অবহেলিত। অথচ আমরা নারীর উপর সহিংসতার আগে ভুলেই যাই যে, এরকমই কোন নারীর দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা তীব্র যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করার কারণেই আজ আমরা এই পৃথিবীতে। পৃথিবীতে আজ আমার যে অধিকার বলে চিৎকার করি সে অধিকার আদায়ের শুরুটা পৃথিবীর আলো দেখিয়ে একজন নারীই করেছে। 

দিন বদলের সাথে সাথে নারীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করে নিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। নারীর কাজ যে শুধু সন্তান জন্ম দান নয় তা বোঝাতেই কেটে গেছে অনেক বছর। নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। ঘরের কোণ থেকে বের হয়ে আজ মহাশূন্য পর্যন্ত তাদের পদচিহ্ন রাখছে সফলতার সাথে। তবে কাজের ক্ষেত্র বাড়লেও কমেনি নারীর উপর সহিংসতার হার। বরং দিন দিন সহিংসতার নতুন নতুন ঘৃণ্য রূপ সমাজকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। যে সহিংসতা থেকে বাদ পরছে না তিন থেকে ত্রিশ বা তদুর্থো বয়সী নারীরা। তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে, বাসে গণধর্ষণ শেষে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এতসব করেও নারীরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সমান অংশীদার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অর্ধেক শক্তি। নারী শক্তি বাদ দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা অসম্ভব। নারীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগামী ভুমিকা পালন করছে। দেশের গার্মেন্টস শিল্পের একটি বিশাল অংশই নারী শ্রমিক। এই খাতে আজ যে সাফল্য বাংলাদেশ পেয়েছে সেটা এই নারীর জন্যই। পোশাক শিল্পের বর্তমানে বড়, মাঝারি ও ছোট-সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার গার্মেন্টস কারখানায় কাজ কওে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্যমতে দেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিক মোট শ্রমিকের ৬০-৬২ শতাংশ। সে হিসাবে বর্তমানে পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখের মতো। যদিও নব্বই দশকে পোশাক শিল্পে কর্মরত মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশই ছিল নারী। বিভিন্ন কারণে পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের হার আগের চেয়ে কমে এসেছে।  নারীর ক্ষমতায়ন মূলত চারটি পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে। সেগুলো হলো-পরিবারে নারীর আর্থিক অবদান, সম্পদে নারীর প্রবেশাধিকার, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ এবং সংকট সামলানোর ক্ষমতা। গার্মেন্টস খাতে নারী কর্মীদের আর্থিকভাবে অবদান রাখতে, পরিবারের সিদ্ধান্ত  গ্রহণে অংশগ্রহণ, সম্পদে অধিকার ও ঝুঁকি মোকাবিলার দক্ষতা তৈরি করে। এগুলো শেষ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে সমাজে তাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করেছে। 

নারীর ক্ষমতায়ন মূলত চারটি পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে। সেগুলো হলো- পরিবারে নারীর আর্থিক অবদান, সম্পদে নারীর প্রবেশাধিকার, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ এবং সংকট সামলানোর ক্ষমতা। গার্মেন্টস খাতে নারী কর্মীদের আর্থিকভাবে অবদান রাখতে, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ, সম্পদে অধিকার ও ঝুঁকি মোকাবিলার দক্ষতা তৈরি করে। এগুলো শেষ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে সমাজে তাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করেছে। একটা সময় প্রায় ৪৫ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের প্রায় ৩৫ লাখই ছিল নারী। এটি চাকরির বাজার হিসাবে বিশাল খাত। ফলে অনেক নারী যেমন বাসাবাড়িতে যারা কাজ করত, তাদের অনেকেরই গার্মেন্টসে কর্মসংস্থান হয়েছে। নারীর মেধা এবং পারদর্শীতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। অধিকার ফলানোতেই যেন তাদের আনন্দ সিমাবদ্ধ। বাল্যবিয়ে, যৌতুক,ধর্ষণ, রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ, পরিবারে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মূলত বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক নামক এক ভয়ংকর প্রাচীন কিন্তু আধুনিক জীবনের আদিমতা থেকে আজও বের এ বিশ্ব বের হতে পারেনি। কারণ কেবল বাংলাদেশ নয় ভারত, পাকিস্থান সহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান বাধা এই বাল্যবিবাহ এবং যৌতুক প্রথা। কছু মানুষের বর্বরতায় কুলষিত হচ্ছে সমাজ জাতি দেশ। ধর্ষণ নামক এক নোংরা মানসিকতায় সমাজের কিছু মানুষ আনন্দ খুজে নিচ্ছে। তারা ধর্ষণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেখানে কোন মায়া নেই, মানবিকতা নেই কোনো সংকীর্ণতাবোধ নেই। তিন বছর থেকে শুরু করে সব বয়সী নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটা এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই কয়েকটি করে ধর্ষণের খবর মিলছে। এটা তো গেল পত্রিকায় যা আসছে তার কথা। তার বাইরেও তো নারীদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। 

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা জোরদার হয়েছে তবুও যেন এই ধরনের বিকৃত মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না নারীদের। বারবার বিবেকের দংশনে দগ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরাও হেরে যাবো না। একদিন না একদিন এ পৃথিবী নারী পুরুষ সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধা দিয়ে বাসযোগ্য করে যাবো। আমরা ততদিন প্রতিবাদ করে যাবো যতদিন পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে নারীর উপর নির্যাতন বন্ধ না হয়। নারীর উপর নির্যাতন করার আগে ভাবতে হবে নারীর প্রতি আমার দায়িত্ব নির্যাতন নয় বরং অধিকার নিশ্চিত করা। পেশিশক্তির যুগে নারীর উপর পেশীশক্তি দেখানোর ভেতর কোন বিরত্ব নেই। বিরত্ব তো কেবল ভালবাসায়। কোন সত্যিকারের পুরুষ তার পৌরুষত্ব ঘৃণ্যভাবে ফলানোর চেষ্টা করে না। পুরুষ তো সে যে তার পৌরুষত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যে সবার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই নারীর প্রতি আর সহিংসতা নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমরে অংশ নেওয়ার উদাহরণ থেকেই দেশের কাজে তাদের সর্বোচ্চ অবদানের প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম। 

বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে নারীরা। পাস করা শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও নারীর সংখ্যাই বেশি। ক্রমশই এই হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত দয়া নয় অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস করতে হবে নারীদের। সেই অভ্যাসটা পরিবার থেকেই তৈরি করতে হবে। পরিবারেই যদি মেয়েদের নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বা কোন পুরুষ সদস্যের সাথে তুলনায় খাটো করা হয় তাহলে সমাজেও তার প্রভাব পরে। বাসে, অফিসে, রাস্তায় সবসময় যদি নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের নিরাপত্তা পেতে আলাদা কোন সাহায্য প্রয়োজন হবে ততদিন পার্থক্য সুস্পষ্ট থেকে যাবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের একবারে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। জেএসসি পরীক্ষার সময় দেখা যায় পত্রিকায় অনুপস্থিত মেয়েদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এমনকি পিইসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত অনেকে মেয়ের ক্ষেত্রেই ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসটি ঘটে। যেখানে একজন ছেলে সন্তানের পরিবার থেকে লক্ষ ঠিক করে দেওয়া হয় লেখাপড়া করে চাকরি করা। সেখানে মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। স্বামী সন্তান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ঘর কন্যার কাজে লেগে পরা যায় ততই মঙ্গল! এটাই বিপরীত চিত্র। এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আবার বিয়ের পর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও প্রায়ই দেখা যায়। যদিও এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইন আছে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শাস্তির ঘটনাও ঘটছে কিন্তু সমস্যা কমছে না। আমরা চাই সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। নারীর প্রকৃত মূল্য নারীকে দিতে হবে। পরিশেষে কবি কাজী নজরুলের নারী কবিতার অংশ দিয়ে শেষ করি।’ এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল/নারী দিল তাহে রুপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল। 
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
টঙ্গীতে মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
বাসসে অসাংবাদিক বেশি, জানালো সংস্কার কমিশন
ড. ইউনূস-মোদি বৈঠক বিবেচনাধীন আছে, বললেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কোটি টাকা চাঁদা দাবি, ফাঁদ পেতে ধরা হলো তিনজন
ফেনীতে ছাত্রদল নেতা গ্রেপ্তার, বাড়ি থেকে অস্ত্র-বুলেট জব্দ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বগুড়ার সোনাতলায় বিএনপির উদ্যোগে ইফতার মাহফিল
টেকনাফে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ থাকা ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
চুয়াডাঙ্গায় বাবাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার
ঈদে নিহারকলি নিয়ে আসছেন পরিচালক ফজলুল হক
কাজী ডাকতে যান প্রেমিক, প্রেমিকাকে নিয়ে পালালেন বন্ধু
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft