রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
কবি মনসুর হেলাল’র ‘গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রুপ’
নিখাদ বাস্তবতার শুদ্ধপাঠ
আলম মাহবুব
প্রকাশ: শনিবার, ৮ মার্চ, ২০২৫, ৪:০৫ PM আপডেট: ০৮.০৩.২০২৫ ৪:২৮ PM
কবির কাজ মানব জীবন ও মানব চরিত্রকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করে জীবন ঘনিষ্ঠ ভাষার দ্বারা তাকে সাহিত্যে রূপান্তরিত করা (-Should look to human life and character for his models and from derive a language that is free from life.)।

শিল্পতৃষ্ণার ভেতরে জীবন তৃষ্ণাকে লুকিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন শুদ্ধতম কবিতার কবি মনসুর হেলাল। তার কবিতায় গভীর মমতা, প্রেম আর জীবন ঘনিষ্ঠতা বরাবরই পরিলক্ষিত হয়। বিষয় ও ভাবগত উচ্চতায় উত্তরাধুনিক চিন্তন চর্চার নান্দনিক অভিযাত্রী সে। ‘গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রুপ’ কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই পাঠককে আনন্দ দিয়েই দায়মুক্ত হয় না, বরং নিগূঢ় ভাবনার আবহে তৈরি করে বিশাল রহস্যময়তা। তার অবগাহন কবিতায় ‘বাতাবী লেবুর মতো কারো কারো উষ্ণ ঠোঁট/নীল শিপনের ভাঁজে শৃঙ্খলিত বুকের জমিন।/সামিনার নাকের ডগায় স্থির ক্রোধের শিশির/আশশ্যাওড়ার ঝোঁপে তন্দ্রাহত/বেলির মন্থন।/যা কিছু দেখি, সবই শেষবারের মতো দেখি/এমন কি তোমাকেও’।

নিঃসন্দেহে কবি মনসুর হেলাল এই প্রজন্মের একজন শক্তিমান কবিকণ্ঠ। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে চার বছর পর প্রকাশিত ‘গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রুপ’ (২০২২) কাব্যগ্রন্থে তিনি ক্রম-উত্তরণের স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রুপ’ এ কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে আমার আলোচনার প্রয়াস।

কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে কবি মনসুর হেলাল প্রচণ্ড ঘোরগ্রস্ত-ভাবুক, অনাবিষ্কৃত সুন্দরের পূজারি। তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দমালা, ভাষাভঙ্গিমা, আঙ্গিক ও ভাবের স্ফূরণে স্বকীয় শুধু নয় মৌলিকও এবং সূর্য কীরণের মতো প্রোজ্জ্বল। ‘বৈরিতার নুন’ কবিতায় কবি বলেন ‘নিঃশ্বাসের ভাঁজে ভাঁজে বৈরিতার নুন/আর অমীমাংসিত সত্যের দীর্ণ প্রচীর পেরিয়ে/হাতে নিয়ে রক্তজবা কেন তুমি এলে?’

গীতিময়তা কবির কবিতার অনন্য বৈশিষ্ট্য তা সত্ত্বেও বেদনাবোধ থেকে কোথাও কোথাও উচ্চারিত হয় মৃদু ক্রোধ। যেমন ছায়াপাত কবিতায় ‘সৌরভের গৌরবর্ণে দলিতের বোঝা/দংশিলে অলীক বিষে কি করিবে ওঝা?’

শব্দের প্রয়োগ কুশলতা, ইঙ্গিতবহ উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাবলীল প্রয়োগ তার কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ব্যবচ্ছেদ কবিতায় ‘মাঝে মাঝে প্রচল ভূষণ ছিঁড়ে/হঠাৎ বেরিয়ে আসে এক বেঢপ মানুষ/যেন মুহূর্তেই পাল্টে দেবে সব’।

কবি মনসুর হেলালের কবিতায় অসংগতির বিরুদ্ধে উচ্চারণ থাকলেও যাপিত জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গও উঠে এসেছে। তার ‘প্রান্তজন’ কবিতায় কবি বলেন ‘জলের জমিনে লেখা রিক্ত দিনলিপি/বিবর্জিত হলো সব সামাজিক ক্ষতে/তবু তুমি মনোযোগী/অন্য চাষাবাদে।’

প্রেম মানবিক জীবনের একটি সহজাত প্রবৃত্তি অর্থাৎ প্রেমাসক্ত হয় না এমন কেউ নেই। কবি তো প্রেমাসক্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কবি মনসুর হেলালও তার ব্যতিক্রম নন, তবে হেলালের কাব্যে নারীর প্রতি প্রেম সেভাবে উচ্চকিত নয়। তিনি প্রেমকে দেখেছেন ভিন্নরূপে, যেখানে নারী প্রাধান্য পেয়ে ওঠেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও অচরিতার্থ প্রেম মনসুর হেলালকে আহত করে। তিনি অকপটে প্রশ্ন তোলেন তার নিগ্রহ কবিতায় ‘জল-স্থল অন্তরীক্ষ/কিংবা গভীর অরণ্যেও নেই/তবে তুমি কিসে/তুমি কি প্রলয় শিখা/তাণ্ডবের বিষে।’ অথবা কবি তার ‘মনস্তাপ’ কবিতায় প্রেমিকাকে খুব সহজে পেতে চান না। তিনি চান,‘এত টা ঔদার্যে নয়, স্পর্শে নয়/চাই রক্ত ঘামে/ধ্রুপদী উল্লাসে।’

ঐতিহ্যের কাছে আমাদের ফিরতেই হয়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সভ্যতার শীর্ষে অবস্থান করলেও আমরা আমাদের ঐতিহ্য ভুলে যেতে পারি না। কবি মনসুর হেলাল তাই স্মরণ করিয়ে দেন তার ‘স্রোতের বচন’ কবিতায় ‘অবগাহনের দায়ে যতই তৃষিত হও তুমি/তবু ক্ষতি নেই/সমূলে উত্থিত শাওনের ঢলে/নিশ্চয় নিভৃত হবে তোমার প্রকৃতি।’

বিষয়-বৈচিত্র্যে ভরপুর ‘গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রুপ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয় কবি কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ দাস থেকে ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। সায়াহ্নের সন্নিকটে শিরোনামের কবিতায় ‘প্রথাগত নয় কিছু, কিছু দৈবতার/তাড়িত বোধের ক্ষতে তাপিত অঙ্গার/বিস্ফোরিত হবে কোনো উৎসবের রাতে/ভীষণ উঠবে কেঁপে কবন্ধ সংঘাতে।’

কবিতা কতটুকু এগুলো, এ নিয়ে কবির ভাবনা বিচলিত করলেও কবি দিকভ্রান্ত হন না। স্মৃতি কাতরতা অতীতমুখী করলেও কবি সচেতন হয়ে ওঠেন তার স্বাভাবিক কাব্যগুণের তেজে। তাই কবিকে বলতে শুনি তার ‘স্মৃতি শিরোনাম’ কবিতায়। তিনি বলেন, ‘উত্তরাধুনিক চিন্তার দ্যোতক/শূন্য দশকের শেষে/কবিতাকে কে কত হৃদ্ধ করেছে/কিংবা রক্তাক্ত করেছে তার আপতিক পরিপাক/আজ থাক কাল জানা যাবে/কে কাকে পোড়ালো।’

সভ্যতার যাবতীয় অসামঞ্জস্যতা কবিকে ব্যথিত করে নিদারুণভাবে। যুদ্ধবাজের হুংকারে কবি হন আহত। কবি মনসুর হেলাল মনে করেন ‘নিঃসঙ্গ আক্রোশে যতই বলি না, না/স্থিতি স্থাপকের বাহুল্যতা ছুঁবে না তোমাকে গমনাগমন নির্ধারিত/তোমাকে যেতেই হবে।’ সভ্যতার অন্তরালে যে বন্ধ্যা সময়ের অনিবার্য পরিণতি থেকে উত্তরণের চেষ্টায় কবি মনসুর হেলাল অনন্য। তিনি উচ্চারণ করেন তার ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ কবিতায় ‘নেই প্রান্ত বদলের তাড়া;/লাল গালিচার সংবর্ধনা কিংবা/সবিশেষ কোনো গন্তব্যও নেই, আছে আটপৌরে বিপন্ন কুটির’। তাই কবির অনুসন্ধিৎসা জাগে ‘উত্তাল এ আকুতির কী হবে উত্তর’। কবি তাই নিরন্তর খুঁজে ফিরেন ‘মানুষে মানুষ খুঁজি কোথায় মানুষ/ছুঁতে গেলে ফণা তুলে বিবর্ণ ফানুস। (কালের পশরা)

কবি মনসুর হেলালের কাব্য ভুবনে মিলে মিশে থাকে প্রেম-প্রকৃতি, বিষণ্নতা আর সৃষ্টির ব্যাকরণ। কবি তাই অকপটে নির্মোহ বাস্তবতায় প্রকৃতি পুরাণ কবিতায় উচ্চারণ করেন- ‘কেননা কষ্টের চেয়ে/স্থায়ী কোনো আবাসন নেই মানুষের!’ গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রুপ এভাবেই হয়ে উঠেছে নিখাদ বাস্তবতার শুদ্ধ পাঠ।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত
আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা কঠোর হাতে দমন করা হবে: নাহিদ
শেখ হাসিনার বিচার হতে হবে, নির্বাচন পেছানো যাবে না : টুকু
বিক্ষোভে উত্তাল তুরস্ক, এরদোয়ানের পদত্যাগ দাবি
সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে : তারেক রহমান
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বগুড়ার সোনাতলায় বিএনপির উদ্যোগে ইফতার মাহফিল
টেকনাফে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ থাকা ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
চুয়াডাঙ্গায় বাবাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার
পুত্রবধূ অন্তঃসত্ত্বা, শ্বশুর গ্রেপ্তার
ঈদে নিহারকলি নিয়ে আসছেন পরিচালক ফজলুল হক
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft