রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
স্বরাষ্ট্র-বাণী
সোহেল অটল
প্রকাশ: শনিবার, ৮ মার্চ, ২০২৫, ৩:৫১ PM
স্বরাষ্ট্র শব্দের অর্থ কী? নিজের রাজ্য? নিজের সাম্রাজ্য?

আক্ষরিক অনুবাদে ব্যাপারটা তেমনই। তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি, তিনি মূলত নিজের সাম্রাজ্যের মন্ত্রী।

ব্যাপারটার মধ্যে এক ধরনের ‘রাজা রাজা’ ব্যাপার আছে।

সম্ভবত সে কারণেই বঙ্গদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীগণ নিজের খেয়ালে চলেন। নিজের খেয়ালে বলেন।

এই ধরুন আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কথাই বলি। এই এয়ার ভাইস মার্শাল ভদ্রলোক ছিলেন বিমান বাহিনীর প্রধান। পরবর্তীতে বিএনপির শাসনামলে ২০০১-২০০৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি কতটা বিচক্ষণ ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে রামপুরায় নিজের বাসায় বাবার কোলে বসে থাকা ২০ মাস বয়েসী এক শিশু ছিনতাইকারীর ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারালে। ঘটনা ২০০২ সালের ৯ মে’র।

জনাব চৌধুরী এর প্রতিক্রিয়ায় নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিলেনÑ ‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে’।

গোটা বাংলাদেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিচক্ষণ প্রতিক্রিয়ায় তাজ্জব বনে গিয়েছিল। বিএনপি আমলের শেষ দিকে সমালোচনার মুখে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার উত্তরসূরী হিসেবে যিনি আসেন, লুৎফুজ্জামান বাবর, নিজ বাণীতে পূর্বসূরীকেও ছাড়িয়ে যান।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ছিলেন তুলনামূলক কম বয়েসী। হেয়ার জেল লাগিয়ে, স্পাইক করা চুল নিয়ে যখন গণমাধ্যমের সামনে আসতেন, মনে হতো এইমাত্র বোধহয় চলচ্চিত্রের কোনো রোমান্টিক সিনে ডায়লগ দিয়ে আসলেন।

তেমনই পরিপাটি ভঙ্গিতে গণমাধ্যমে একদিন বাবর বলে বসলেনÑ ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ!’

বাংলা ‘শত্রু’ শব্দটার বহুবচন কী দারুণ দক্ষতায় ‘ইংরেজি ভার্সন’ তিনি করলেন, ভেবে দেখেছেন? এই অমর বাণী তিনি দিয়েছিলেন ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হওয়ার পর প্রসঙ্গক্রমে এই বাণী তিনি দিয়েছিলেন।

অতঃপর ২০০৬ সালে এদেশ থেকে বিএনপি আমল শেষ হলো। কিন্তু ‘স্বরাষ্ট্র-বাণী’ প্রসব থামলো না।

বরং স্মরণকালের বালখিল্যতম বাণী প্রসবিত হলো এরপরই।

সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা আপনাদের মনে থাকার কথা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা নামের ওই বহুতল ভবনটি ধসে পড়ে এবং ১১৭৫ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।

এই ঘটনার জন্য প্রকৃত অর্থে দায়ী ছিল ভবনটির মালিক রানা, যিনি তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

অথচ, ভীষণ নির্বিকারচিত্তে ঘটনার দায় বিরোধীদলের ওপর চাপিয়েছিলেন সেসময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর।

খান সাহেবের বাণী ছিল শতাব্দীর সেরা। সক্কালবেলা ঢুলুঢুলু নয়নে সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘হরতালকারী ও মৌলবাদীরা এই ভবনের স্তম্ভ ধরে টানাটানি করায় ভবন ধসে পড়তে পারে।’

মহিউদ্দিন খান আলমগীরের একাধিক বাণী স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। তার মধ্যে আরেকটা হলো

‘আমরা সম্প্রতি খবর পেয়েছি, অনৈতিক অবৈধ হরতালের মাধ্যমে তিনি যে ১৮ ব্যক্তিকে খুন করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন সে জন্য বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়ি আক্রমণ করতে পারে। এ কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর তরফ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’

খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করার অভিযোগের জবাবে ২০১৩ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর এ কথা বলেন। ওই সময়ে খালেদা জিয়ার বাড়ির চারপাশে প্রায়ই বালির ট্রাক নিয়ে ঘিরে রাখা হতো। যাতে খালেদা জিয়া বাড়ি থেকে বের হতে না পারেন।

এই ঘটনাকে মশকরা করেই জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর উক্ত মন্তব্য করেছিলেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। এককভাবে সিংহভাগ আসন জয় করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ২০০৯ সালে। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদকে অলঙ্কৃত করেন সাহারা খাতুন।

ব্যস্ত এই রাজনীতিবিদের প্রায়শই মঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ার বদভ্যাস ছিল। একবার তো সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। তার মড়ার মতো ঘাড় বাঁকা করে মঞ্চে ঘুমিয়ে থাকাকে ‘অন্যকিছু’ ভেবে কর্মীরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। সবাই পড়িমরি করে সাহারা খাতুনের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা শুরু করেন। মিনিট দুয়েক বাদে চোখ খুলে সাহারা খাতুন সবাইকে উদ্ধার করেন।

যাহোক, আলোচনা যা নিয়ে হচ্ছিল সেদিকে মন দেই। সাহারা খাতুন দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে কতটা তটস্থ থাকতেন তার প্রমাণ তার বিখ্যাত ‘তালা-চাবি’ বাণীর মধ্যে লুকিয়ে আছে।

‘ঈদে বাড়ি গেলে ঘরে তালা লাগিয়ে যাবেন’, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে সমালোচনার মুখে ২০১২ সালের ৮ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সভা শেষে সাহারা খাতুন এ কথা বলেছিলেন। ব্যাপারটা এমন যেন, তিনি না বললে কেউ তালা লাগাবে না। কিংবা, তালা লাগালেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

তার বিখ্যাত ‘৪৮ ঘণ্টা’ বাণীও ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিজ বাসায় সাংবাদিক দম্পতি নিহত হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এই বাণী দিয়েছিলেন।

তারপর কেটে গেছে কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা! সাহারা খাতুনের মন্ত্রিত্ব চলে গিয়েছে। আওয়ামী শাসনের পতন হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়া হয়েছেন। তবু সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ১১৬তম বারের মতো পিছিয়েছে কিছুদিন আগেই।

আমাদের মনে দাগ কেটে গিয়েছেন সাম্প্রতিককালের আরেকজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আসাদুজ্জামান খান কামাল। গণমাধ্যমের সামনে ইনিও ঢুলুঢুলু নয়নে প্রায়শই নিজের সাম্রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে নানান বাণী প্রসব করতেন। তার এই ‘ঢুলুঢুলু নয়ন’ নিয়ে অবশ্য বাজারে অনেক কথা আছে। দুর্মুখেরা বলতেন, রাতভর বোতল নিয়ে বসে থাকতেন এই আওয়ামী মন্ত্রী। সঙ্গত কারণেই দিনে নয়ন দুটো ঢুলুঢুলু হয়ে থাকতো।

আওয়ামী দুঃশাসনের ১৫ বছরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল গুম। রাষ্ট্রের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই গুম নিয়ে আতঙ্কিত ছিলেন। গুম যখন আলোচনার শীর্ষে, তখনই একদিন ওই ঢুলুঢুলু নয়নে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘কোনো গুম হচ্ছে না। প্রেমে ও ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে নানান জন নানান দিকে চলে যাচ্ছে। আমরা তাদের এনে হাজির করছি।’

দিনটি ছিল ১৭ জুলাই ২০১৮। স্থান ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

হাহাহা। লোকটা রসিক বটে! রসিকতা করতে করতেই গত জুলাই-আগস্টে হাজার দুয়েক মানুষকে মেরে ফেললেন। গুলি করে। স্রেফ নির্বিকার ভঙ্গিতে।
আহত-পঙ্গু করলেন লাখ খানেক মানুষকে।

রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীরা যখন স্বরাষ্ট্র-পীড়নের দানব-প্রভু হয়ে ওঠেন; অরাজনৈতিক, সুশীলে তখন ভক্তি তৈরি হয়। আমাদেরও তাই হলো।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা আশ্রয় খুঁজলেন জনাব জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছে। তিনি সেনাবাহিনীর উচ্চ কর্মকর্তা ছিলেন। ‘সৎ মানুষের ইমেজ’ নিয়ে মন্ত্রনালয়ে বসার পর পূর্বসূরীদের ভূত চেপে বসল তার ওপরও।

আইন-শৃঙ্খলার ক্রমাবনতি ঠেকাতে না পেরে কৌতুককর কিছু কাণ্ড করে চলেছেন তিনি। রাত ৩টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে একটাও জরুরি কথা বলতে না পেরে কয়েকদিন ধরেই তিনি আলোচিত। দেশের নানান প্রান্ত থেকে তার পদত্যাগের দাবী জোরালো হচ্ছে। এমন সময় লালমাটিয়ায় দুই তরুণী’র ধূমপানের ঘটনায় তিনিও বাণী প্রসব করলেন।

রাজধানী ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করা নিয়ে দুই তরুণীকে শারীরিক লাঞ্ছিতের ঘটনা ঘটে গত শনিবার (১ মার্চ)।

পরদিন সাংবাদিকরা ওই ঘটনার বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি তারা (দুই তরুণী) নাকি সিগারেট খাচ্ছিল, কিছু লোক সেখান দিয়ে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। তারা বাধা দেওয়ায়, তাদের ওপর চা ছুড়ে মেরেছিল।’

তিনি বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। তাই সবাইকে অনুরোধ করব, কেউ যেন উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান না করে।’

নারীর ধূমপান যদি এদেশে সামাজিক রীতির পরিপন্থি হয়, তাহলে তাকে সেভাবেই হ্যান্ডল করতে হবে। প্রচলিত আইন দিয়ে নারীর ধূমপান আটকানোর কোনো সুযোগ নেই।

আর সামাজিক রীতি বদলায় না? জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বেড়ে ওঠার সময় সমাজ, আর এখনের সমাজ কি এক? সমাজ কি বদলেছে না? এই পরিবর্তন সহজভাবে মেনে নিতে না পারলে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না।

চৌধুরী সাহেব একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাকে অবশ্যই আরো সতর্ক মন্তব্য করতে হতো।
তাতে অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাণী প্রসবের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়তো। সম্ভবত প্রকৃতি সেটা চায়নি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
ড. ইউনূস-মোদি বৈঠক বিবেচনাধীন আছে, বললেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কোটি টাকা চাঁদা দাবি, ফাঁদ পেতে ধরা হলো তিনজন
ফেনীতে ছাত্রদল নেতা গ্রেপ্তার, বাড়ি থেকে অস্ত্র-বুলেট জব্দ
আওয়ামী লীগ-জাপা ছাড়া নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না: জি এম কাদের
গুলি করে গরু ব্যবসায়ীদের ৭৮ লাখ টাকা লুট
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বগুড়ার সোনাতলায় বিএনপির উদ্যোগে ইফতার মাহফিল
টেকনাফে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ থাকা ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
চুয়াডাঙ্গায় বাবাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার
পুত্রবধূ অন্তঃসত্ত্বা, শ্বশুর গ্রেপ্তার
ঈদে নিহারকলি নিয়ে আসছেন পরিচালক ফজলুল হক
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft