অমর একুশে বইমেলা। এ এক প্রাণের মেলা। পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের মহামিলন মেলা। প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হয়ে মাসব্যাপী চলে। করোনার সময় একটু ব্যতিক্রম হয়েছে। বইমেলা শুরুর অনেক আগে থেকেই আয়োজনের দৌড়ঝাঁপ চলে। ছাপাখানা এখন মহা ব্যস্ত। বাঙালির প্রাণের এ উৎসব থেমে যায় ফেব্রুয়ারির শেষ দিন। তারপর এক বছরের অপেক্ষা।
বইমেলার শুরু স্বাধীনতাপরবর্তী ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। মুক্তধারা প্রকাশনীর কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহার অভাবনীয় ও সাহসী উদ্যোগে। বর্ধমান হাউস (বর্তমান বাংলা একাডেমি) প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে বসে যান তিনি। চারপাশ না ভেবে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা চিত্তরঞ্জন সাহা গ্রন্থমেলার আজকের সমারোহ, দু’মলাটে বাঙালির প্রেম; ভিন্নচোখে দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এর ফলেই মুদ্রণের অনেক সীমাবদ্ধতায়, বাঙালির গাঁটের পয়সা খরচ করে বই কিনে পড়ার দুর্দিনে আমাদের সবার চিত্ত দা চিত্ত হরণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে চিত্ত দার চিত্তকে প্রফুল্লিত করেন বাংলা একাডেমি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। সব মিলে চিত্ত দার এ প্রচেষ্টা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়। মিশে যায় বাংলা ভাষার জন্য জীবনদানকারী প্রত্যেকের বিদেহী অন্তরে। চিত্ত দা আজ ইতিহাস। ঠিক যেমন তার প্রচেষ্টা।
ইতিহাস নয় বাস্তবতা হলো, আমরা একবিংশ শতাব্দীর অতি আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি। এখন কথাগুলো ক্ষণিকের তরে ভেসে যায় আধুনিক যন্ত্রের স্ক্রিনে। ভাবের বদল হয় পুরো বিশ্বে। তবু বইখানা যেন চিরন্ত যৌবনা। এ প্রবাদ এ সময়ে সাযুজ্য পেয়েছে। এখন মুদ্রণ সৌন্দর্য আলোর বেগে ধাবমান। সাদা-কালো যুগে ভাঙা ভাঙা টাইপ, সহজাত নিউজপ্রিন্ট, রংতুলির গরিবি আঁচর পেরিয়ে আমরা এখন বইকে দিয়েছি বাস্তবের যৌবন। এ যৌবন বেলা কোনো কোনোভাবে চিত্ত দার চিত্তকে প্রফুল্লিত করছে।
তারও আগে প্রফুল্লিত করছে নাগরিক বাঙালির জীবনকে। তারা এখন ভাষার মাসের এ মেলাকে উৎসবে রূপ দিয়েছে। শুধুই কি নাগরিক? প্রাক ফাগুন ও ফাগুনের এমন দিনে পুরো বাংলাদেশ বইয়ের গন্ধে মাতোয়ারা। পাঠক, লেখক, প্রকাশক, বইসংশ্লিষ্ট সবাই বইয়ের ঘ্রাণ শুকে মাতাল। এমনি মাতাল সমীরণে বইমেলার পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। শুরুতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ঠিক ভরত না। এতে এক ধরনের আনন্দই ছিল। প্রাণের মেলায় প্রিয় কোনো সারথির সঙ্গ নিয়ে আচমকা বইয়ে ঢুকে পড়া। মনে চাইলে আবার সারথির গল্পে চোখ ও কান পাতা। হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে শিহরণ জাগানো কোনো লেখক-সাহিত্যিক-কবি। এমন বেলা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুরি হচ্ছে। এর মাঝে ঢুকে পড়েছে নানা বাণিজ্য। তা বাদ রাখলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা একসময় বুঝতে শিখিয়েছে পরিধি বাড়াতে হবে মেলার। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে মেলা পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে সম্প্রসারণ করা হয়। এর ফলেও প্রাণের খোঁজ মিলছে না। কারণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনতা। বাংলা একাডেমির নিয়ন্ত্রণ এতে কাজ করছে না। এর জন্য যুগের ভুলও দায়ি। একাডেমি নানা সময়ে নানা পদক্ষেপে প্রশ্নবিদ্ধ। একাডেমির নিয়ন্ত্রণ যদিও বা কাজে দেয়; প্রকাশক, গণমাধ্যম ও পাঠকের প্রচেষ্টার অভাবে আদি অকৃত্রিম ওই সুরটি ধরা দিচ্ছে না। কী আর করা? সময়কে সঙ্গে নিয়েই এমন আয়োজনকে মেনে নিতে হয়।
তবু কথা থাকে। প্রাণের এ মেলায় প্রাণ থাকছে না কেন? কারণ খোঁজা জরুরি। এর মাঝেই ধরা দেয় নানা চিহ্ন। শুরুতে মেলা ছিল শুধুই বইয়ের। নানা সময়ে তা বারোয়ারি হয়ে এখন মিশ্র হয়ে গেছে। মধ্যের অনেকটা সময় মেলায় সব পাওয়া যেত। পথে পথে ছড়ানোসহ খোদ একাডেমি প্রাঙ্গণে। এসবের ভিড়ে, মানুষের হল্লায়, ধুলোর পাল্লায় চিত্ত বাবুর চিত্ত হরণ কিংবা পাঠক-লেখক-প্রকাশকের চিত্ত হরণ করা বইমেলা ছিল না। এসবের থেকে মুক্তির চিন্তায় বইমেলা সম্প্রসারণ করা হয়। তাতেও লাভ হচ্ছে না। অবারিত সুযোগ পেয়ে বাণিজ্যমেলার স্টাইলে আমরা নানা প্যাভিলিয়নে ভরিয়ে দিচ্ছি জায়গা। যে যার জয়গানে মত্ত হয়ে পাঠক-লেখকের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ বন্ধ করে দিয়েছি। এর মাঝে উটকো হয়ে আছে গণমাধ্যম (বইও কিন্তু গণমাধ্যম)। অজস্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের পুরো পসরা সাজিয়ে পছন্দসই লেখকের কথা কিনতে ব্যস্ত। এসবের ভিড়ে প্রকাশকদের ক্ষুদ্র চিন্তার বৃহৎ ফলস্বরূপ কোথাও প্রাণের খোঁজ মিলছে না। এসবের সুরাহাও করতে পারছে না বাংলা একাডেমি। বারোয়ারি পর্ব পেরিয়ে এখন হ-য-ব-র-ল পর্বে যাচ্ছে। এসবের ভিড়ে একাডেমির ভেতর নজরুল মঞ্চ চিড়ে বসছে এক হাট। বইয়ের মার্কেটিংয়ের হাট। সদিচ্ছা বা ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখানে তাই বসছে। দুই মলাটে যা তা ছেপে এনে কিছু মানুষ শব্দ দূষণ ঘটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে কোনো বিশেষ বইয়ের পক্ষে। অনেক ক্ষেত্রে মাইকও ব্যবহার করা হচ্ছে। এসবের ভিড়ে বইয়ের খোঁজে থাকা মন, ঠিক মননে থাকছে না। হয়ে যাচ্ছে বিগড়ানো। আর এসবের সুযোগে অনেক কিছুই কিনে এনে ব্যাগ খুলে বই পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে তা কোনো গোষ্ঠীর কোনো লিফলেট। বই হতে পারেনি।
অবশ্য বই না হওয়ার একাধিক কারণ আছে। বই ভিন্ন একটি ব্যঞ্জনা। কিন্তু তা এখন লেখা হচ্ছে মেলা উপলক্ষে। প্রকাশও হচ্ছে মেলাকে ঘিরে। দেখা গেছে প্রকাশক লেখককে তাগাদা দিচ্ছে- ‘বই চাই’। কিন্তু লেখক বই পাবে কোথা থেকে। ‘বই লিখতে হবে’- এমন চিন্তা সামনে নিয়ে কোনো মহান বই ইতিহাস পায়নি। বই লেখা হবে বইয়ের গতিতে। প্রকাশ হবে প্রকাশের গতিতে। সব হবে নিজস্ব গতিতে। পাঠকের নেড়েচেড়ে দেখাও। চূড়ান্ত পর্বে ক্রয়। কিন্তু এখন এ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে। লেখক ভাবছেন এ বইমেলায় এতটি বই আনতে হবে। বই তো আনার বিষয় না। প্রকাশক ভাবছেন এ বইমেলায় এতটি বই না প্রকাশ করলে অনেক দিকে হেনস্তা হব। তারও যে একটি কোটা আছে। বই কি কোটা মেনে হয়? মানা যেত যদি এসব পুরো বছর নিয়ে করা হতো। বইমেলার সময় আসলেই সংশ্লিষ্ট সবার শুরু হয় তোড়জোড়। এই প্রকাশক যাচ্ছেন লেখকের বাড়ি- পাণ্ডুলিপি কই? লেখক ভাবছেন কী করে বলি লেখাই হইনি? তাগাদা শেষে প্রকাশক ছুটছেন ছাপাখানায়। তাদের ঘুম নেই। কাউকে নতুন করে সিডিউল দেওয়ার সময় নেই। বাইন্ডাররা ব্যস্ত হরদম কাজে। সবকিছু সৌন্দর্যের বাইরে। আর তা দিয়ে ওই বই বইয়ের মান রাখছে না।
এর মাঝে পাঠক ঠিকই পয়সা রাখছেন হাতে। বই কিনতে হবে। আর তা মেলা থেকে হলেই ভালো। এক কাজে দুই কাজ। তারা বই কিনছেন। তা অতীতের চেয়ে গ্রাফ আকারে বাড়ছে। তবু বই তার মান পাচ্ছে না। পাঠক প্রচারে বইয়ের ভালো-মন্দ যাচাই করছেন। আর এ ভাবনায় কিনছেনও। তারা হুমরি খেয়ে পড়ছেন বাজার কাটতি বইয়ে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অনেক হিসাব। এর সামান্য ও অনুল্লেখ্য অংশ মান। ফলে ওই কাটতি বই ঠিক বই-ই হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন হচ্ছে না। অথচ রাজপথ দলে হাঁটছেন মানুষ। তাদের কেউ মেলায় প্রবেশে ইচ্ছুক। রাজপথ দলছেন আরো কিছু মানুষ। তাদের সবার হাতে বইয়ের ব্যাগ। এমন দৃশ্য খুবই সুখের। তবু মিলছে না সুখ। পাঠকের এখানে দোষ কম। যদিও সবচেয়ে বড় দোষটি তারাই করছেন। তাড়াহুড়ো করে বা খবর না নিয়ে মলাটে ভাঁজ ছাপা কাগজ তারা কিনবেন কেন? এ প্রশ্নের মীমাংসা করা যাচ্ছে না। আর প্রকাশক অনেক অজুহাতে বইকে ব্যবসার বস্তু দেখছেন। প্রকাশকের কাছে বই ব্যবসার বস্তুই, কিন্তু খুব অল্পক্ষেত্রে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখানে ভালোবাসা জড়িত। তাইতো যুগের পরিক্রমা বলে লেখক-প্রকাশক বলে একটি মানুষ সব সময় থাকেন। মানে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত মানুষরাই প্রকাশক হন বেশি ক্ষেত্রে। অবশ্য লেখক-প্রকাশক বলে একটি বিষয় এখন আছে। চিরকালই ছিল। তা হলো, আমি আমার বই প্রকাশ করব। কিছু মনের মানুষ, পাঠক কিনবে। না কিনলেও কিছু যায় আসে না। বই লিখে বেঁচে ব্যবসা হবে এমন চিন্তা তাদের কোনোকালেই ছিল না। তারাও এখন হতাশায়। কারণ আগে এমন বইও বিক্রিতে আলোড়ন তুলেছে। এখন আধুনিক মার্কেটিং ও চাকচিক্যের বইয়ের দুনিয়ায় হতাশা নিয়ে বইমেলায় নিজ বইয়ের ফেরি করা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকছে না। বইমেলা কিংবা বইয়ের চিরন্তন সৌন্দর্য; পাঠক, লেখক, প্রকাশক ও বইয়ের সম্পর্ক নষ্ট করছে আরেকটি বিষয়। লেখক মেধার স্থানটিতে ভূমিকা রেখেও বই প্রকাশে অর্থের সংস্থান করছেন। প্রকাশকরা খুব কম রয়েলিটি দিচ্ছেন। ব্যতিক্রম ছাড়া লেখক বই প্রকাশ করতে প্রকাশককে টাকা দিচ্ছেন। তা অবশ্যই চুক্তিহীন। ফলে চিরন্তর সুর নষ্ট হচ্ছে। লেখক ব্যবসায়ী ওই সমাজের মার খাচ্ছেন। তারা সহজেই নানা অজুহাত তুলে ধরছেন।
এসবের ভিড়ে আমরা ক্রমশ বইমেলার প্রকৃত উদ্দেশ্য হারাতে বসেছি। চিত্ত দার প্রচেষ্টার মূল সুরের বাইরে চলে যাচ্ছি। বাইন্ডার ছেলেকে বলতে শুনা যাচ্ছে- ‘সারা বছর বাদ দিয় এহন আইলে কেমতে অইব?’ প্রকাশককে বলতে শুনা যাচ্ছে- ‘আপনার কোনো ভাই-ব্রাদার বই কিনে নাই’। লেখককে বলতে শুনা যাচ্ছে- ‘১০০টি বই আগেই কিনে নিয়েছি।’ পাঠককে বলতে শুনা যাচ্ছে- ‘ধুর এইটা কি বই আনলাম, অথচ সাইনবোর্ডে লেখা ছিল সাড়া জাগানো।’ প্রহসন, ভালোর ভয়ংকর কোনো ইচ্ছা ছাড়া বই নিয়ে সাইনবোর্ডও হওয়া লাগে না। এমনসব অভাবের জায়গাটি রুখতে পারলে বইমেলার কোনো বই চারপাশে পুরোনো দামে বেচতে দেখা যেত না। লজ্জার চরম প্রকাশ, তা কোনো পাঠকের কিনে নেওয়ার পরে বেচে দেওয়া হলে এবং তাই হচ্ছে।
হচ্ছে না পাঠক, লেখক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমি, একুশ, ভাষা, সাহিত্য, মনন, সর্বোপরি দু’মলাটের সম্পর্কোন্নয়ন। অথচ অমর একুশে গ্রন্থমেলার চূড়ান্ত লক্ষ্য তাই। আমরা লক্ষ্যহীন সুড়ঙ্গ ধরে হেঁটে যাচ্ছি ক্রমাগত। যদিও পাথেয় ফাগুনের অজেয় দিন।
আজকালের খবর/আরইউ