রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
আজি ফাগুন এসেছে ধরায়
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ১ মার্চ, ২০২৫, ৪:০৮ PM আপডেট: ০১.০৩.২০২৫ ৪:১৪ PM
‘হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,/বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?’/কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-/‘দখিন দুয়ার গেছে খুলি?/বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?/দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?’ (তাহারেই পড়ে মনে-সুফিয়া কামাল)

মাঘের মাঝামাঝি সময় থেকেই প্রকৃতিতে পরিবর্তন শুরু হয়। সেই পরিবর্তনে সাড়া দিয়ে গাছে গাছে ফুলের কলি আসে। ফুল ফোটে। চারিদিকে মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায়। পতঙ্গরাজির ভিতর বিরাজ করে আনন্দ। এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ওড়ে বেড়ায়। আকাশে-বাতাসে তারই ছোঁয়া লেগেছে। প্রকৃতিতে প্রাণ জেগেছে। শীতে যত আড়ষ্ট দল ছিল সব আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। ঝরে যাওয়া বৃক্ষরাশিতে কচি পাতা বের হচ্ছে। ফাল্গুন যেন যৌবনের প্রতীক। হয়তো বা সব ফুল এখনো ফোটেনি, হয়তো সব কোকিল এখনো ডাকেনি, হয়তো কোনো প্রেমিক হৃদয় আজো তার প্রেমিকাকে খুঁজে পায়নি তবু সময়ের পরিক্রমায়, কালের নিয়মে ফাগুন আগমনী সুর বাজছে ধরায়। ধরণীর পরে আজ ঋতুরাজের আগমনের বার্তা শোনা যা। তাই ‘ফুল ফুটুক, আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত/শান বাঁধানো ফুটপাতে পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে/ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।-কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার মতো করে নতুন বউয়ের ঘ্রাণে বসন্ত এসেছে। কোন গাছে ফুল ফুটেছে আর ফোটেনি সেই অপেক্ষায় তো নেই এ ধরা। বিষাদময় এ ধরা মেতে উঠেছে আনন্দে। সত্যি তো বসন্ত এলে তো আর অপেক্ষা করতে হয় না। কোথায় ফুল ফুটেছে আর কোথায় ফোটেনি। বসন্ত! বাঙালির প্রেম আর আবেগের নাম। ঋতুর হিসেবে সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় প্রকৃতিতে। তার আগের ঋতু শীত। শীতের হিম হিম জড়তায় মানুষ আর প্রকৃতি যখন জুবুথুবু হয়ে থাকে, গাছপালা, আকাশ মাঠঘাট যখন কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা থাকে তখন বসন্তের আগমনে সবকিছু জেগে ওঠে। নতুন করে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পায় সকলেই। হতে পারে এ কারণেই বসন্তের এত জয়গান। শুরু হয়ে বসন্তের গুণগান। এমন মোহময় রূপ বাংলায় কেবল বসন্তেই আসে।

বারবার বসন্ত আগমনের সাথে সাথে আমরাও বসন্তের গুনগানে মেতে উঠি। রং, রূপ আর প্রাচুর্যে অন্য সব ঋতু থেকে আলাদা হওয়ার কারণেই বসন্ত ঋতুরাজ। আর সব ঋতুর চেয়ে বসন্ত একটু আলাদা, একটু আদুরে। বসন্তের রং, রূপ অন্য ঋতুর চেয়ে ভিন্ন। লাল টকটকে পলাশ, শিমুল প্রকৃতিতে যেন আগুন ঝরায়। বসন্ত আগমনের সাথে সাথে প্রকৃতির অভূত পরিবর্তন ঘটে। ঢেকে থাকা ফুলের রেণু জেগে ওঠে। ফুলের ঘ্রাণে ছুটে আসে পাখিরা। গায়কের কণ্ঠে সুর ওঠে। সে সুর ছড়িয়ে পরে আমাদের প্রাণে। মুখ খুলে গেয়ে উঠি ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে...’। কবির কবিতায় বসন্তের গুনগান হয়। বাংলা সাহিত্য, গানে বসন্ত বন্দনা হয়েছে বহুবার। প্রায় সব খ্যাত কবিই তাদের কবিতায় বসন্তের বন্দনা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতা গানে বারবার বসন্ত ঋতুর প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, কবিতায় লিখেছেন, অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে/আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে-দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া/আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে। বসন্তের আগমনে প্রকৃতির অধীর আগ্রহের অবসান হয়। এ চঞ্চলতা শীতের জড়তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। এ চঞ্চলতা কাউকে কাছে পাওয়ার। প্রকৃতির মিলন মেলায় ভালোবাসার পাখিরাও গান গেয়ে ওঠে। কোনো এক গাছের ডালে বসে কোকিল তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল স্বরে ডাকতে থাকে। কোকিলের ডাকে সাড়া দিয়ে হয়তো কোনো সাথী বিহীন কোকিলাও ছুটে আসে তার কাছে। বসন্ত হারানোর বেদনাও তাই প্রকট। বসন্তকে বিদায় জানানোয় কষ্টদায়ক।  

কবি সুফিয়া কামাল তার বাসন্তী কবিতায় বসন্তের আগমনে যে পরিপূর্ণতার পরিবর্তন হয় তাই ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির বাসন্তী কবিতায় লিখেছেনÑ আমার এ বনের পথে/কাননে ফুল ফোটাতে/ভুলে কেউ করতো না-গো/ কোনদিন আসা যাওয়া/...সেদিন ফাগুন প্রাতে/অরুণের উদয় সাথে/সহসা দিল দেখা/উদাসী দখিন হাওয়া। যে পথে কেউ কোনোদিন আসেনি, ফুল ফোটেনি তো সে হোক বনে অথবা মনে ফাগুনের আগমনের সাথে সাথেই সে পথ ফুলে ফুলে ভরে উঠতে থাকে। এই তো বসন্তের স্বকীয়তা। এখানেই সে ঋতুরাজ। কবি নির্মলেন্দু গুণও লঘুচালে বসন্তের রূপের বন্দনা করেছেন তার ‘বসন্ত বন্দনা’ কবিতার মাধ্যমে। এ কবিতায় তিনি লিখেছেন, হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি/তবুও ফুটেছে জবা,-দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক। 

বসন্ত কেবল বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের মনেই প্রভাব বিস্তার করেনি। বসন্ত শীতপ্রধান দেশেও তার রূপ দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সে প্রভাব বাঙালির চেয়েও তীব্র। কারণ মনে হয় শীত যেখানে যত তীব্র বসন্তের অনুভূতি সেখানে তত তীব্র। শীতপ্রধান দেশে বসন্ত তাই জড়তা থেকে মুক্তির সময়কাল। সাথে উচ্ছ্বাস আর প্রাণচাঞ্চল্য তো আছেই। রবার্ট্র ফ্রষ্ট তার ‘এ প্রেয়ার ইন স্প্রিং’ কবিতায় বসন্তের কাছে প্রার্থনা করেছেন- ‘তুমি আমাদের পুষ্পের আনন্দ দাও, তুমি আমাদের ভালোবাসা দাও, ভালোবাসার চেয়ে ভালো কিছুই হয় না।’ আবার উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার প্রাক-বসন্তে লেখা কবিতায় বলছেন, বসন্ত আসে স্বয়ং স্বর্গ থেকে, প্রকৃতি পবিত্রতায় পুষ্পিত হয় অতএব এখন শোক করবার সময় নয়। 

একটি বিষয় তো স্পষ্ট বসন্ত মানে প্রকৃতির নির্মল প্রকাশ, বসন্ত মানে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলা, বসন্ত মানে পবিত্রতা। বসন্ত কি তবে প্রেমের দূত। প্রেম মানে চির বন্ধন, এক আত্নিক আনন্দ। চিরকাল দারিদ্র্যতা আর নিঝুম মনের অধিকারী জীবনানন্দের মনেও দোলা দিয়েছে বসন্ত। তিনি তার সবিতা কবিতায় বসন্তকে তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘বসন্তের রাতে, যেমন দেখি.../সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি/মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে/ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি/তাহাদের সাথে/সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন...। 

মোট কথা বসন্ত বন্দনার কোন শেষ নেই বাংলার লেখক কবিদের। বাস্তবিকপক্ষে বাংলার মানুষই যে বসন্ত পাগল। একটি ফুল, বাসন্তী শাড়ি, প্রেমিকের হাত, শিমুলের রং সব মিলিয়ে এ এক অন্য প্রকৃতি। বসন্তে প্রকৃতি যেমন মানুষকে সাজায় তেমনি নিজেও সাজে। বসন্ত এলে পরে নিসর্গে যেমন নির্মেঘ রোদ্দুর জেগে ওঠে, সিন্ধ বাতাসের পরশে সকাল সন্ধ্যা দেহে দেহে হিল্লোলে লাগে মিষ্টি দোলা, তেমনি কবিতার পূর্বের সব যাতনা ভুলে নতুন করে কবিতায় মগ্ন হয়। সে যেন তখন এক সদ্য যৌবনা তরুণী। কোন  তরুণের অপেক্ষায় প্রতি বছর পালা করে আমাদের মাঝে আসে। অথবা এমন হতে পারে প্রতি বছর কোন অতৃপ্ত মনের তৃপ্ত করার জন্যই পালা করে প্রকৃতিতে হাজির হয়। বসন্তের মাঝে এই প্রাণের হিল্লোল, এই উন্মাতাল সুর এসব কি কবির চোখ এড়াতে পারে। তাই বসন্তকে নিয়ে কখনো গান, কখনো কবিতা লেখা হয়েছে যুগে যুগে। বৃক্ষ প্রেমিক কবিগুরু বারবার প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ ঋতু, প্রকৃতির রাণীকে চিনছেন আপন ঢংয়ে। উন্মাতাল করা, আবেগে ভাসিয়ে দেওয়া ঋতু বসন্তের আগমনে বাঙালির অধীর আগ্রহের অবসান ঘটেছে। ফাল্গুনের রং আজ সকলের মন রাঙাবে।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
টঙ্গীতে মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
বাসসে অসাংবাদিক বেশি, জানালো সংস্কার কমিশন
ড. ইউনূস-মোদি বৈঠক বিবেচনাধীন আছে, বললেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কোটি টাকা চাঁদা দাবি, ফাঁদ পেতে ধরা হলো তিনজন
ফেনীতে ছাত্রদল নেতা গ্রেপ্তার, বাড়ি থেকে অস্ত্র-বুলেট জব্দ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বগুড়ার সোনাতলায় বিএনপির উদ্যোগে ইফতার মাহফিল
টেকনাফে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ থাকা ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
চুয়াডাঙ্গায় বাবাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার
ঈদে নিহারকলি নিয়ে আসছেন পরিচালক ফজলুল হক
কাজী ডাকতে যান প্রেমিক, প্রেমিকাকে নিয়ে পালালেন বন্ধু
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft