প্রায় দেড় যুগের অপশাসনের সমাপ্তি যে খিড়কি দুয়ার দিয়ে পলায়নের মধ্য দিয়ে হবে, তা বোধ হয় কোনো জ্যোতিষী-মহাজ্যোতিষীও কল্পনা করেননি। হায়, শেষ পর্যন্ত এটাও দেখতে হলো দেশবাসীকে! এ যেন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য-সামন্ত রেখে চুপিসারে সেনাপতির পলায়ন। তবে প্রতিবেশী বড়দা বা বিশ্ববাসী যে যা-ই বলুন, বাংলাদেশের মানুষ যে খুব একটা বিস্মিত হয়েছে ‘সেনাপতির’ এহেন আচরণে, তা কিন্তু মনে হয় না, বরং এই অঘটনঘটনপটীয়সী নারী সেনাপতি দেড় যুগ ধরে ‘লাখে লাখে সৈন্য মারে কাতারে কাতার/শুমার করিয়া দেখে বিয়াল্লিশ হাজার’ নীতিতে অবিচল থেকে শুধু ভাই-বেরাদর ও পা-চাটাদের স্তুতিবাক্যে সন্তুষ্ট থেকেছেন, প্রকৃত হাল-হকিকত কী, তা জানার প্রয়োজন মনে করেননি। দেশটাকে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমিদারি মনে করতেন এবং উঠতে-বসতে দেশবাসীকে তা স্মরণ করিয়ে দিতেন (তার মুখে তার একটি প্রিয় উক্তি ‘আমার বাবা এই দেশকে স্বাধীন করেছিলেন’ শুনলেই আমি সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ লাখ লাখ যোদ্ধার কাছে ক্ষমা চাইতাম তার এই দম্ভোক্তির জন্য)।
যা হোক, তার সুদীর্ঘ শাসনামলে গুম, ক্রসফায়ার, আয়নাঘর ইত্যাদির ভয়ে কেউ কদাচিৎ মুখ খোলার সাহস দেখাতেন। আর এখন তার অনুপস্থিতিতে তার এসব এবং আরো অনেক কীর্তিকাহিনীর কথা বললে জানি না তা ‘গিবত’ হয়ে যাবে কিনা, কিন্তু আমি বা আমার মতো দেশবাসী অনেকেই এসব ব্যাপারে চুপ থাকলেও তিনি কিন্তু দাদাবাবুর নিরাপদ আতিথ্যে থেকে রীতিমতো ফাউল খেলতে শুরু করেছেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন তার আপাতনিষ্ক্রিয় সৈন্য-সামন্তকে চাঙ্গা করতে, তা এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। জানি না কোন বুদ্ধিদাতা গণেশের নির্দেশে বা পরামর্শে তিনি কাজটা করলেন।
কিন্তু দেড় যুগ রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভদ্রমহিলার এটুকুও কি মাথায় এলো না যে তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে বারুদে আগুন দিতে যাচ্ছেন। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড উপেক্ষা করে সাঈদ-মুগ্ধর সহযোদ্ধারা আবারো প্রয়োজনে বুক পেতে দেবে, তবু তাকে দেশের বিরুদ্ধে, দেশের মানুষের বিরুদ্ধে গায়ে ফোসকা পড়ার মতো অসত্য, ভিত্তিহীন বক্তব্য প্রচার করতে দেবে না। তার এ ধরনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে সদ্যোজাগ্রত ন্যায্যতাকামী ছাত্র-জনতা প্রতিবাদমুখর হবেই। এটিই স্বাভাবিক।
হয়েছেও তাই। সারা দেশে তার এবং তার দলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বিক্ষুব্ধ মানুষ।
এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু প্রতিবাদের পদ্ধতি নিয়ে আমাদের ‘দুইখান কথা আছে’। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বর্তমান অরাজনৈতিক, অন্তর্বর্তীকালীন, নিরপেক্ষ সরকারকে বিব্রত করা, সারা দেশে ভঙ্গুর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তোলা, বিশেষ করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না।
পলাতকা নেত্রীর ওই উসকানিমূলক বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের পর যদি মিটিং-মিছিল, প্রতিবাদসভা ইত্যাদি হতো, তাহলে সেটাকে সবাই স্বাভাবিকই মনে করত। কিন্তু ওই বক্তব্যকে উপলক্ষ করে তার এবং তার দলের লোকজনের বাড়িঘর ভেঙে চুরমার করা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, লুটপাট করা নিশ্চয়ই সমর্থন করা যায় না। ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি যে একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন, তা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ওই বাড়িটির কোনো বেপথু বংশধর অপরাধ করলে নিশ্চয়ই তার জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু ইট-পাথরের স্থাপনা বাড়িটি অতীতের নানা ঘটনার নীরব সাক্ষীÑ এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। যে বা যারা অন্যায় করেছে, অবশ্যই তাদের বিচার হতে হবে, বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে তারা শাস্তি পাবে, কিন্তু তাই বলে তাদের বাড়ি-গাড়ি-ধনসম্পদ ধ্বংস করতে হবে কেন? তাহলে কি তাদের ব্যাংকে রক্ষিত অথবা বিদেশে পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা স্তূপীকৃত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে? আর শুধু ৩২ নম্বরের বাড়িই নয়, আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীর বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করার কর্মসূচি নিয়ে দেশব্যাপী তৎপর হয়ে উঠল একদল মানুষ। তারা ভেবে দেখল না দেশে-বিদেশে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত যে সরকার নিজেদের একটি সুশীল ইমেজ তুলে ধরেছে প্রথম থেকেই, সেই সরকারের ভাবমূর্তির ভাবটুকু হয়তো অদৃশ্য থেকে যাবে, কিন্তু এসব কর্মকাণ্ডের কারণে সেই ভাবমূর্তির মূর্তিতে যে কালিমা লেপন হবে, তা কি অস্বীকার করা যায়?
এ প্রসঙ্গে অর্থাৎ এই বাড়িঘর ভাঙাভাঙি এবং দৃশ্যত একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে সদাশয় সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর ভূমিকা কেমন রহস্যময় মনে হয়েছে অনেকের কাছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩২ নম্বরে ভাঙচুর চলল, কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দেখা পাওয়া গেল না। তেমনি ফায়ার সার্ভিস নামক সদাপ্রস্তুত এবং ত্বরিতগতিতে অকুস্থলে হাজির হওয়ার প্রশংসনীয় রেকর্ডধারী সংস্থাটিরও টিকির নাগাল পাওয়া গেল না। বিষয়টা কী? কেউ যদি বলে, পুলিশ-ফায়ার সার্ভিস গংকে যেতে নিষেধ করা হয়েছে ওপর থেকে, তার কী জবাব দেবে কর্তৃপক্ষ? সারা দেশে প্রায় একই সময়ে অবাধে এ ধরনের ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি সংঘটিত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের অভিযান শুরু করে ডেভিল অর্থাৎ দুষ্কৃতকারীদের পাকড়াওয়ের ঘোষণা দিয়েছে। এটা অনেকটা স্কুলে ইংরেজি ট্রান্সলেশন ক্লাসের ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল’র মতো। তবু আমরা আশা করব, জনগণের, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর, সমর্থন সহায়তা নিয়ে সরকার এই ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের দ্রুত ইতি টানতে সক্ষম হবে।
দেশে-বিদেশে সর্বমহলে ডক্টর ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এক ব্যক্তির বাংলাদেশের দুঃসময়ে শাসনভার গ্রহণ মুক্তকণ্ঠে প্রশংসিত হলেও বোধগম্য কারণে একটি মহল তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। তারা তাদের বিদেশি বন্ধুদের নিয়ে ফ্রম ডে ওয়ান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। এর আলামত আমরা প্রায় প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। কারখানা শ্রমিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন তাদের ন্যায্য-অন্যায্য সব দাবিদাওয়া নিয়ে যমুনামুখী (নদী নয়, প্রধান উপদেষ্টার অফিস-কাম-রেসিডেন্স) অথবা সচিবালয়মুখী হচ্ছে। বিগত প্রশাসনের নৃশংসতা-নির্মমতার বিরুদ্ধে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান এবং আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকারকে, বিশেষ করে কথায় কথায় ধরপাকড়, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি না করার দৃশ্যমান ভূমিকাকে ডক্টর ইউনূসের সরকারের দুর্বলতা মনে করছে অনেকে। ফলে অনেক বেআইনি সভা-সমাবেশ করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমরা সবিনয়ে সেই পুরনো নীতিটাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সরকারকেÑ আইন প্রয়োগে প্লিজ কোনো ছাড় দেবেন না। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনÑ এই নীতিই অনুসরণ করে চলুন। এতে যদি আইনকানুন ভঙ্গকারী কারো বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয় নিন। দিনশেষে যে সার্টিফিকেট আপনাদের পাওয়া উচিত তা হচ্ছে- ‘তারা বড় দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন।’ (তারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন- এই সার্টিফিকেটের কোনো প্রয়োজন নেই আপনাদের। আপনারা যে ভালো মানুষ, তা বিশ্ববাসী সবাই জানে।)
এটা তো ঠিক, দ্রব্যমূল্যের চাপে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ সব সময় একটা দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান চায় তারা। আর এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা বর্তমান সরকারই করতে পারে। কারণ তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই, কোনো দল বা গোষ্ঠীর কাছে তারা দায়বদ্ধ নয়। তাদের দায়বদ্ধতা একমাত্র দেশবাসীর কাছে। দেশকে রাহুমুক্ত করেছে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতা, দেশকে এখন সঠিক পথে চালিত করবে বর্তমান নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারÑ এটাই সবার প্রত্যাশা। আর সেই কাজটি সহজ হবে যদি দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে সব ধরনের বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে থাকে। হিংসার পথে নয়, শান্তি-সম্প্রীতি, সংযম ও সৌহার্দ্যের মধ্য দিয়েই জীবনে নেমে আসবে প্রশান্তি, জীবন হবে সুন্দর সুষমামণ্ডিত।
শেখ সাদীকে (মতান্তরে পণ্ডিত লোকমান হাকিমকে) একজন নাকি জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি এত ভদ্রতা, নম্রতা, বিনয় কার কাছ থেকে শিখেছেন? উত্তরে তিনি নাকি বলেছিলেন, দুর্বিনীত অভদ্রের কাছ থেকে। প্রশ্নকর্তা আবারো জানতে চাইল, কীভাবে? সেই মহাপুরুষ বললেন, ও যা যা করে, আমি তা করি না।...আমরাও মনে করি দেড় যুগ ধরে তেনারা যা করেছেন, তা না করাই হবে উত্তম পন্থা।
শেষ করি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুল উচ্চারিত চরণগুলো উদ্ধার করে- ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;/ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ।/...শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,/করুণাঘন ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য’।...
লেখক : সাবেক সচিব, কবি।
আজকালের খবর/আরইউ