অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চার বছর আগে পাকিস্তানের করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানিয়েছিলেন কুমিল্লার ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দও। এ জন্য পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাকে। ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখায় ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর কুমিল্লার ঝাউতলা এলাকার ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ের বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। পরবর্তী সময়ে তার মরদেহেরও সন্ধান পায়নি পরিবার।
ভাষা আন্দোলনের আগেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ‘ভিত প্রস্তুতকারী’ ছিলেন কুমিল্লার ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। দেশ স্বাধীনের ৫৪ বছর পরেও তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটি রক্ষার দাবি উঠলেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সর্বশেষ ২০১০ সালে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বাড়িটি পরিদর্শন করতে এসে ‘ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। জেলা প্রশাসন বলছে, বাড়িটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরসূরিদের আগ্রহ না থাকায় বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
গতকাল শনিবার সকালে নগরের ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ে সরেজমিনে দেখা যায়, অযত্ন-অবহেলায় ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। চারদিকে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। সামনের ভাঙাচোরা টিনশেড ঘরটি যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। পেছনের ঘরটি ভেঙে পড়েছে। পুরো বাড়িটি নোংরা-আবর্জনায় ভরে গেছে। বাড়ির সামনে ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামফলকও নেই।
ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটির সামনের অংশ।
প্রায় ২৫ বছর ধরে বাড়িটিতে বসবাস করেন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার নেয়ামতকান্দি গ্রামের সুজন মিয়ার পরিবার। তাদের দায়িত্ব বাড়িটির দেখাশোনা করা। সুজন মিয়া মারা গেছেন প্রায় ১৩ বছর আগে। এখন তার স্ত্রী জাহানারা বেগম সন্তানদের নিয়ে সেখানে বসবাস করেন। বাড়ির সামনে এক পাশে জাহানারা বেগমের ছেলে রিপন মিয়া চা ও খাবারের দোকান দিয়েছেন।
জাহানারা বেগম আজকালের খবরকে বলেন, ‘আমরা এত কিছু কইতাম পারতাম না। আমরার কাম বাড়িডা দেইখ্যা রাহোন। মালিকে আমরার কাছ থাইক্যা কোনো ভাড়া নেন না। পুরো বাড়িডার অবস্থা অনেক খারাপ। আমরা অসহায় মানুষ, যাওনের কোনো জায়গা নাই। এর লাইগ্যা কষ্ট কইরা দিন পার করতাছি।’
কুমিল্লার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম আতিকুর রহমান বাশার বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ছিলেন। জানতে চাইলে আরমা দত্ত বলেন, ফেব্রুয়ারী মাস এলেই সবার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা মনে পড়ে। সারা বছর কোনো খোঁজ থাকে না। বাড়িটি তার দাদুর পৈতৃক সম্পত্তি। বাড়িটি সংরক্ষণে তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে। যদিও তা বাস্তবায়নে অনেক সময় লাগবে। এ নিয়ে সরকার বা প্রশাসন তাদের সঙ্গে কখনো কথা বলেনি।
পেছনের ঘরের ভাঙা অংশ।
যোগাযোগ করলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘আমরা তো জেনেছি, তারা (আরমা দত্ত) ওই বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে বায়না দলিলও হয়ে গেছে। শুরু থেকেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি সংরক্ষণে তার উত্তরাধিকারীদের কোনো আগ্রহ ছিল না। আরমা দত্ত এমপি থাকতে উদ্যোগ নিতে পারতেন। কিন্তু তারা এটা চান না। বাড়ির সম্পত্তি ব্যক্তিমালিকানাধীন। এ কারণে প্রশাসন চাইলেও বাড়িটি সংরক্ষণের সুযোগ আমাদের নেই।’
তিনি বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলে বাড়িটি অধিগ্রহণ করতে পারে। তারা চান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণ করা হোক।