ড. মাহবুব উল্লাহ্
সাগর-রুনী খুন হওয়ার পর ১৩ বছর পার হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনীর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। সেদিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মিডিয়াতে সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের তাগিদ এসেছে বারবার। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়নি অথবা যাদের এ দায়িত্ব ছিল, তারা এ কাজটি করতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না।
১৩ বছর আগে ঘটা সাগর-রুনী হত্যার রহস্য আজ পর্যন্ত উদ্ধার না হওয়ায় একদিকে যেমন-মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে, অন্যদিকে দেশের পুলিশি তদন্তের দক্ষতা সম্পর্কেও অনেক প্রশ্ন জেগেছে। সাগর-রুনী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের এবং অপরাধীদের সমুচিত শাস্তির দাবি উঠেছিল সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের সাংবাদিকসমাজ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে দ্বিধাবিভক্ত। সাংবাদিক সমাজের ন্যায্য পেশাগত দাবিতেও এরা একতাবদ্ধ হতে পারেনি। সাগর-রুনী হত্যার পর সাংবাদিকরা কিছুদিন একসঙ্গে একাট্টা হয়ে তদন্ত দাবি করেছেন এবং খুনিদের চিহ্নিত করে বিচারে সোপর্দ করার দাবিও জানিয়েছেন। আশা করা গিয়েছিল সাংবাদিক সমাজের এ আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখবে। প্রত্যক্ষ খুনি ও তাদের যারা নিয়োগকর্তা, তাদের চেহারা অচিরেই উন্মোচিত হবে এমনটি আশা করেছিলেন অনেক কল্যাণকামী মানুষ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাংবাদিক সমাজের সংহতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। সাংবাদিকদের মধ্যে বিদ্যমান স্বার্থবাজরা কৌশলে সাগর-রুনী হত্যার বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে সটকে পড়েন। কিছু সাংবাদিক নেতাকে দেখেছিলাম উচ্চকণ্ঠে বিচারের দাবি তুলতে এবং এ ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানাতে। দেখা গেল সাংবাদিক সমাজের চিহ্নিত দু-একজন নেতা সরকারি কাঠামোতে ঢুকে পড়লেন এবং পদ-পদবির বদৌলতে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকলেন। নিজ বাসগৃহে দুজন সাংবাদিক, যারা বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, তারা খুন হলেন নির্মমভাবে। বাংলাদেশের কিছু সাংবাদিক কর্মস্থলে কিংবা প্রকাশ্যে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে সাংবাদিক মানিক সাহা ও সামছুর রহমান রয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডেরও রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে অনুমান করা হয় দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের উগ্রবাদী চরমপন্থিরা এদের খুন করেছে। তবে এ উগ্রবাদীরা প্রভাবশালীদের কারোর না কারোর দ্বারা নিয়োজিত হয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। প্রশ্ন জাগে, সাংবাদিকসমাজ কেন নিজ কমরেডদের খুন হওয়ার মতো ঘটনায় সাময়িক প্রতিবাদ জানিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যাবেন? এভাবে নিশ্চুপ হওয়া নিজ রক্তের সঙ্গে বেইমানির শামিল। সামান্য পদ-পদবির লোভ যদি ন্যায্য আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না। পৃথিবীব্যাপী সাংবাদিকতার পেশাটি ঝুঁকিপূর্ণ। সাংবাদিকরা দুঃসাহসের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দান থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করেন। তারা মাফিয়াদের কর্মকাণ্ডের ওপরও নজর রাখেন এবং এ নিয়ে রিপোর্ট লেখেন। এসব দুঃসাহসিক কাজ করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক প্রাণ হারান অথবা নিহত হন। সাংবাদিকদের এভাবে নিহত হওয়া অথবা প্রাণ হারানোর ঘটনার বিহিত সবসময় হয়ে ওঠে না। তারপরও তাদের বীরত্ব ও সাহসিকতা বিশ্বময় স্বীকৃতি অর্জন করে এবং তার মধ্যেই তাদের সহকর্মী ও আপনজনরা সান্ত্বনা খুঁজে পায়।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যা মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে স্থানান্তরের আগের ছয় বছর কার্যত কোনো তদন্ত হয়নি। এ সময় তদন্তকারী সংস্থা র্যাব আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা নিয়ে কেবল সময়ই চেয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত র্যাবের তদন্তের ফল ছিল শূন্য।
২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। পরে বিভিন্ন সময়ে রুনীর কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবীরকে গ্রেফতার করে। রুনীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে তানভীরের কথা বলার সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বনানী থানার একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলায় গ্রেফতার মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান ওরফে অরুন, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাদের মধ্যে তানভীর, নিরাপত্তা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর, নিরাপত্তা কর্মী রুদ্র পাল ও মিন্টু জামিনে মুক্ত আছেন।
হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাট, সাগরের হাত বাঁধা ওড়না ও রুনীর পরনের কাপড় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠিয়েছিল র্যাব। এ ছাড়াও নিহতদের ভাড়া বাসার ভাঙা গ্রিলের অংশ, ঘটনাস্থলে পাওয়া চুল, ভাঙা গ্রিলের পাশে পাওয়া মোজা, দরজার লক, দরজার চেইন ও ছিটকিনির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সেখানে পাঠানো হয়। হত্যায় সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তির ডিএনএর নমুনাও যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। পরে এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন র্যাবের কাছে আসে। হত্যার ঘটনার বিভিন্ন পর্যায়ের মোট ১৬০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। কিন্তু খুনি শনাক্তের জন্য কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি র্যাব।
সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে তথ্য দিতে পারব বলে আশা করছি।’ দুবছর পর ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ওই সময় তিনি হত্যার রহস্য উন্মোচনের সুনির্দিষ্ট তারিখও ঘোষণা করেছিলেন।
হত্যার ঘটনায় রুনীর ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রথমে এর তদন্ত করেছিল শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ, চারদিন পর মামলার তদন্তভার ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ৬২ দিনের মাথায় ডিবি হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে। এরপর আদালতের নির্দেশে র্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। র্যাব যখন কিছু করতে পারল না, তখন আদালতের নির্দেশে র্যাবের কাছ থেকে মামলার নথিপত্র বুঝে নেয় পিবিআই। এর আগে গত বছর ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলাটি তদন্তে চার সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, এ সময়টি হলো বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের আমল। টাস্কফোর্সকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিতে।
টাস্কফোর্সের প্রধান ও পিবিআইয়ের প্রধান মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, খুনের রহস্য উদ্ঘাটন হওয়ার মতো কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিবেদন জমা দিতে টাস্কফোর্স আদালতের নির্দেশে কাজ করে যাচ্ছে। ছয় মাসের মধ্যে তিন মাস ইতোমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আমরা আমাদের আঙুলগুলো আড়াআড়ি রাখব অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল হবে কিনা। জানা গেছে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআই কাগজপত্র নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে এবং অকুস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা তদন্তের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাব থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুনীকে পেছন থেকে ডান হাত দিয়ে পেটের ডানপাশে কোপ দেওয়া হয়েছে। তার পরনের টি-শার্টে ওই ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে। সবুজ রঙের ওড়না দিয়ে সাগরের হাত-পা বাধা ছিল। সেখানে আরেকজনের ডিএনএ পাওয়া গেছে। পিবিআই এখন ওই দুই ব্যক্তির ডিএনএ মিলিয়ে দেখতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খুঁজছে। সাগর-রুনী নির্ভেজাল মানুষ ছিলেন। তাদের সঙ্গে কারোর কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ছিল, এমন কিছু জানা যায়নি। কর্মজীবনে তারা কোনো ধরনের হুমকির সম্মুখীন হননি। তাহলে কে বা কারা ওদেরকে হত্যা করল এবং হত্যা করাল। মামলার বাদী ও রুনীর ভাই নওশের আলম বলেছেন, ‘পিবিআই আমার সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, সরকার ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবে। তবে তদন্তের ফল না পাওয়া পর্যন্ত আশাবাদী হতে পারছি না।’ ঘটনা তদন্তের পূর্বাপর বৃত্তান্ত একটি জাতীয় দৈনিকে গেছে। এ অংশটি অনেকটা এই পত্রিকার ভাষাতেই লেখা হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাগর-রুনী হত্যার ঘটনাটি বহুল আলোচিত। গোড়া থেকেই বেশির ভাগ মানুষের সন্দেহ ছিল এ হত্যাকাণ্ডে এমন কেউ বা কারা জড়িত, যাদের ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। সে কারণে হয়তো এ হত্যার রহস্য উন্মোচিত হয়নি। অনেকের ধারণা তদন্তকারীরা ক্ষমতার চাপ অনুভব করায় তদন্ত কাজ পরিণতি পায়নি। এখন দেশে ভিন্ন এক ধরনের সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এ সরকার ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সংকল্পবদ্ধ। আমরা আশা করব ডিএনএ আবিষ্কার হওয়ায় অপরাধী শনাক্তের একটি চাবিকাঠি খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন মিলিয়ে দেখার বিষয় এ চাবির সঙ্গে কোন তালার সম্পর্ক রয়েছে। আশা করি অপরাধের জটিল রহস্য ভেদ করতে পারঙ্গম পিবিআই পেশাগত একাগ্রতা নিয়ে সাগর-রুনী হত্যার রহস্য উন্মোচন করে দেশবাসীর উদ্বেগের নিরসন ঘটাবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ।
আজকালের খবর/আরইউ