ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবার পরে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ এর মাঝামাঝি সীমান্তে পড়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত নিরাপত্তা ও নিজস্ব ঠিকানা জটিলতার প্রেক্ষিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে ‘ইবি থানা’ স্থাপন করা হয়। ২৬ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত থানাটি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আওতাধীন।
২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক ইবি থানা ঝাউদিয়ায় (ইবি থানার অধীনস্থ ইউনিয়ন) স্থানান্তর হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানাকে ঝাউদিয়া এলাকায় স্থানান্তর করে ‘ঝাউদিয়া থানা’ নামকরণ এবং ঝাউদিয়া পুলিশ ক্যাম্পকে ইবি ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ‘পুলিশ ক্যাম্প’ হিসেবে নামকরণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
এর পরে ইবি থানাকে নিয়ে শুরু হয় দুই পক্ষের টানাটানি। বাঁধে উভয় পক্ষের গৃহযুদ্ধ। একপক্ষ সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ‘ঝাউদিয়া থানা’ বাস্তবায়ন চান, অপরপক্ষ ২৬ বছরের প্রতিষ্ঠিত থানা স্থানান্তর না করার দাবিতে অনড়। সমাধানের পথ কি রুদ্ধ? প্রশ্ন সাধারণ জনগণের। দিন দিন বাড়ছে দাবি আদায়ের উত্তেজনা। উভয়পক্ষ ঘোষণা দেয় মহাসড়ক অবরোধের। সংশ্লিষ্ট এলাকাজুড়ে আতঙ্কে জনজীবন।
ঝাউদিয়া থানা বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানা অবিলম্বে ঝাউদিয়ায় স্থানান্তরের দাবিতে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করে এলকাবাসী। ওইদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। তাতে ভোগান্তিতে পড়েন অসংখ্য যাত্রীরা। ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে সোয়া তিন ঘণ্টা পর অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন বিক্ষোভকারীরা।
এদিকে পাল্টা প্রতিবাদে ইবি থানা বাস্তবায়ন কমিটির আয়োজনে গত ৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্বস্থ ‘ইবি থানা’ স্থানান্তর না করার দাবিতে ‘ইবি থানা ইবিতেই থাক’ স্লোগানে সোচ্চার হয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীরা। আগুন জ্বালিয়ে প্রায় ৪ ঘণ্টা কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে ছাত্রজনতা। এ সময় আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দৃশ্যমান সুরাহা দিতে না পারলে আবারও কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অচল করে দেয়ার ঘোষণা দেয় ইবি থানা বাস্তবায়ন কমিটি।
ঝাউদিয়া থানা বাস্তবায়নের পক্ষে এলাকাবাসীর যুক্তি:
১.ইবি থানার অধীনে ৭টি ইউনিয়ন হরিনারায়ণপুর, আব্দালপুর, ঝাউদিয়া, জিয়ারখি, আলামপুর, উজানগ্রাম, গোস্বামীদূর্গাপুর। তন্মধ্যে ঝাউদিয়া ইউনিয়নকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হয়েছে।
২. যেহেতু সরকার কর্তৃক অনুমোদিত থানা, বাস্তবায়ন করলে সমাধান হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঝাউদিয়াতে থানার অবকাঠামো নির্মাণও শেষ পর্যায়ে।
৩. প্রায় সময় মারামারি, হানাহানি ও বিভিন্ন অপরাধ ঘটে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাম্প থেকে সহযোগিতা করতে পারলেও সহজে প্রায় ইউনিয়নের লোক দূরত্বের কারণে প্রশাসনিক সেবা নিতে পারছে না।
৪. ইবি থানা স্থানান্তর করলে বিকল্প হিসেবে ‘পুলিশ ক্যাম্প’ থাকবে। তাহলে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার প্রশ্নই আসে না।
৫. থানা বাস্তবায়ন হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে চাঙ্গা হবে।
ঝাউদিয়া থানার পক্ষে আন্দোলন (৪ ফেব্রুয়ারি)। ছবি: সংগৃহীত
মনোহরদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঝাউদিয়া থানা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব মো. হায়াত আলী বলেন, ‘ঝাউদিয়া থানা বাস্তবায়নের সব কার্যক্রম সমাপ্ত হলেও থানা উদ্বোধনে গড়িমসি করা হচ্ছে। ঝাউদিয়া নামে থানা হয়ে গেছে, জায়গার মিউটেশন, দলিল সব তো হয়ে গেছে। আমাদের থানা নতুন করে বানানোর দরকার নাই। শুধু উদ্বোধন করলে হবে। ১০ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সুপারের সাথে আমাদের একটা বৈঠক হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে ওনারা দেখতেছে। একটু সময় নিয়েছেন, আপাতত আন্দোলনের কথা ভাবছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা আরেকটা থানা সরকারের কাছ থেকে নিয়ে আসুক, সমস্যা নাই।’
ইবি থানার পার্শ্ববর্তী জনতা ও শিক্ষার্থীদের যুক্তি:
১.ইবি থানার উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সীমান্তে নিরাপত্তা দেওয়া। ইবি থানা স্থানান্তর করলে ঝিনাইদহের অংশ যেহেতু বাদ পড়বে না। সুতরাং সীমান্ত বিরোধ প্রতিরোধে পুলিশ ক্যাম্প যথেষ্ট না।
২. ২৬ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত থানা কোন ষড়যন্ত্রে আইন পাশ করায়? নিশ্চয় ষড়যন্ত্র আছে। কেন এতদিন পর স্থানান্তর করতে হচ্ছে? এখন কি ক্যাম্পাস নিরাপদ মনে করে সরকার?
৩. জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটটা শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে হয়েছে। দেশজুড়ে তাদের ওপর চোখ এবং বিশেষ নজর। যেকোনো অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় ক্যাম্পাস থেকে। সুতরাং আগের তুলনায় এখন বেশি নিরাপত্তা দরকার।
৪. ঝাউদিয়া ইউনিয়নে বর্তমান ‘ঝাউদিয়া পুলিশ ক্যাম্প’ রয়েছে। যদি এলাকাবাসীরা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাহলে পুলিশ ক্যাম্প কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয়?
৫. ইতোমধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভাবে ইবি থানার সংশ্লিষ্ট অনেক কাজে পরিচিত লাভ করেছে। পুরাতন হওয়ায় এলাকার ঐতিহ্য হয়ে গেছে।
৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কুষ্টিয়া শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে এবং বিনাইদহ সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় এলকাটি দুর্গম এবং নিরাপত্তাজনিত সংকটে রয়েছে।
ইবি থানার পক্ষে আন্দোলন (৮ ফেব্রুয়ারি)। ছবি: সংগৃহীত
ইবি থানা বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুবকর সিদ্দীক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই থানা প্রতিষ্ঠিত। প্রায় ২৬ বছর কাজ করে যাচ্ছে এই থানার অধীনে কিন্তু কেনো যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের একটা স্বার্থান্বেষী মহল স্থানান্তর করার পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। আমরা এক বিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত এই থানা স্থানান্তর করতে দিব না। যদি দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট না পায় তাহলে ১৬ তারিখ মহাসড়ক অবরোধ করে দেয়া হবে।’
ইবি থানা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হাসান বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সাবেক এমপি হানিফকে ঝাউদিয়ার কয়েকজন নেতৃপর্যায়ের লোক ঝাউদিয়া ইবির সন্নিকটে বলে প্রতারণামূলক স্বাক্ষর করায় নেয়। যা মিথ্যা ও তথ্য গোপন রেখে এমন কাজ করেছে। থানা আসলে কাদের জন্য প্রয়োজন এ নিয়ে সরকার চাইলে উভয় পক্ষের গণস্বাক্ষর বা জরিপ করতে পারে।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ‘আমি শক্তভাবে কমিটমেন্ট ইবি থানা এখান থেকে যাবে না। ১৭ হাজার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইবি থানা ইবিতেই থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। প্রয়োজনে ঝাউদিয়াবাসী সরকারের কাছ থেকে ৪-৫ টা থানা নিয়ে আনলেও আমাদের আপত্তি নাই। তারা আমাদের থানা নিয়ে টানাটানি করার যৌক্তিকতা দেখছি না।’
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া ও প্রশাসন) পলাশ কান্তি নাথ বলেন, ‘উভয় পক্ষের কথা শুনেছি। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কাদের জন্য সুবিধা বেশি, কারা প্রাপ্ত তার রিপোর্ট জমা দেয়া হবে। ঝাউদিয়া থানার প্রাথমিক অনুমোদন হয়েছে, এটা তো ফাইনাল না।’
সমাধানের পথ আদৌও আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা তদন্তাধীন। এখন বলতে পারছি না। উভয় পক্ষের দাবির কথা উর্ধতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। যেহেতু পুরাতন ইবি থানা, হুট করে স্থানান্তর করলে আশেপাশের লোকজনের এমনিতেই টান থাকতে পারে। তবে দুইটাই রাখা যায় কিনা সুপারিশ করা যেতে পারে।’
সর্বোপরি ‘থানা বাস্তবায়ন কেন হচ্ছে না’ আর ‘২৬ বছরের প্রতিষ্ঠিত থানা কী কারণে স্থানান্তরের আইন পাশ হলো’ এই ২টি প্রশ্নের উত্তর মিললেই সুরাহা পাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারপরও আতঙ্কিত জনমনে একটাই প্রশ্ন- সুরাহা কোন পথে?