ইকবাল সাহেবের দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে এখন সরকারি অনেক বড় অফিসার। ইকবাল সাহেব একজন সরকারি সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। এক বছর হয় রিটায়ার্ড করেছেন। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বড় ছেলে মাসুদকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করলেন। তার ইচ্ছা ছিল বড় ছেলে মাসুদ একটা চাকরি করে ছোট দুই বোনের দায়িত্ব নিবে।
কিন্তু মাসুদের যখন দুইবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ও অন্য সব জায়গায় চেষ্টা করেও চাকরি হলো না; তখন ঢাকায়ই এক বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে। মেয়ের বাবা তার টাকা আর পরিচিত লোক দিয়ে মাসুদের চাকরির ব্যবস্থা করেন। যদিও মাসুদ ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিল। তাই খুব একটা কষ্ট হয়নি চাকরি পেতে।
চাকরি পাওয়ার পর থেকে মাসুদ বাড়িতে তেমন আসে না। যেখানে ইকবাল সাহেব কোনোদিন একটা অসৎ উপায়ে রোজগার করেননি; সেখানে মাসুদ ঘুষের টাকা দিয়ে ফ্লাট আর গাড়ি কিনেছে চার বছরে। এসব কথা শুনলে ইকবাল সাহেবের মাথা নিচু হয়ে যায়। চোখে পানি চলে আসে। মাথা নিচু করে চোখের পানি আর লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করেন। নিজে সারাজীবন সৎ পথে চলেছেন। কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছেন। অথচ ছেলের জন্য মুখ দেখাতে লজ্জা পান। এলাকায় তার সারাজীবনের জমানো সম্মান নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে ভেবে কষ্ট পান ইকবাল সাহেব।
ইকবাল সাহেব তার পেনশনের টাকা দুই মেয়ের জন্য রাখেন। কারণ সে জানে মাসুদ তার দায়িত্ব কোনোদিনই পালন করবে না। মাসুদকে ছোট বোন দুটোকে এসএসসি পাস করার পর ঢাকায় ভর্তির কথা বলেন ইকবাল সাহেব। কিন্তু মাসুদ নানা সমস্যা দেখিয়ে নিষেধ করে দেয়। কোনো উপায় না দেখে ইকবাল সাহেব মেজো মেয়ে রুনাকে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইংরেজিতে অনার্সে ভর্তি করেন।
রুনা যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে তখন তার মামা ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আনে। ইকবাল সাহেবের খুব পছন্দ হলেও মাসুদ অন্য চিন্তা করে নিষেধ করে। কারণ তার ইচ্ছা ছিল রুনাকে তার প্রয়োজনে একজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিবে। এতে তার ফায়দাও ছিল। লোকটার বউ দুই বাচ্চা রেখে তাকে ছেড়ে চলে যায়। ইকবাল সাহেব সবকিছু শুনে এক বাক্যে নিষেধ করে দেন। এতে রেগে যায় মাসুদ ও তার বউ টিনা। তারা জানিয়ে দেয় রুনার বিয়ে নিয়ে তারা আর নেই। ইকবাল সাহেব যা ইচ্ছা করুক। তারা এসবের মধ্যে নেই।
ইকবাল সাহেব মাসুদের অমতেই রুনার বিয়ে ঠিক করেন। মাসুদ উপস্থিত থাকলেও কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। কারণ রুনার সাথে ঐ লোকের বিয়ে না হওয়াতে মাসুদের প্রমোশনটা আটকে গেছে। এই রাগে টিনা বিয়েতে আসেনি। তবে ইকবাল সাহেব অনেক খুশি রুনার জন্য। কারণ হাসিব ছেলে হিসাবে অনেক ভালো। একদম নিজের ছেলের মতো আচরণ তার। অনেক ভদ্র প্রকৃতির মানুষ। হাসিবের মাও অসম্ভব ভালো মানুষ। হাসিবের দুই বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা মারা গেছেন বেশ আগেই। হাসিব পাবনায় ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। ভালোই বেতন পায়।
রুনা তার হাসবেন্ড হাসিবকে নিয়ে বাবার বাড়িতে এসেছে। এদিকে ইকবাল সাহেবের হাতে একদম টাকা নেই। মাসুদকে ফোন করে কিছু টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু মাসুদ এখনো টাকা পাঠায়নি। বারবার হাত পাততে লজ্জা লাগে ইকবাল সাহেবের। কারণ উনি জানেন মাসুদ ইচ্ছা করলেই এটা মিনিটের মধ্যে দিয়ে দিতে পারে। এমন অবস্থায় তো মেয়ে জামাইকে অসম্মান করতে পারেন না। তাই পরিচিত একজনের কাছে ধার করতে যান বাজারে। সেও দিতে পারছে না বলে জানান। কারণ তার ছেলে ঢাকায় পড়ালেখা করে। হঠাৎ তার টাকার দরকার হয়েছে।
হাসিব ইকবাল সাহেবের কথা পিছনে থেকে শুনতে পায়। ভীড়ের মধ্যে ইকবাল সাহেব তাকে খেয়াল করে নাই। কিন্তু হাসিবের খুব কষ্ট লাগলো। তার লজ্জাও লাগলো। তার কেন মাথায় আসেনি ইকবাল সাহেবের অবস্থা এখন এমন নাজুক হয়েছে? তাছাড়া তারই তো উচিত এখানে আসলে বাজার করে আনা। বাবা মা বয়স্ক হলে তাদের দায়িত্ব সন্তানের। আর আজ ইকবাল সাহেবকে তাদের জন্য এভাবে ধার চাইতে হচ্ছে। তার চোখে পানি আসলো। রুনার উপর একটু রাগও হলো। তাকে কিছুই বলে না মেয়েটা। অবশ্য তাদের কাছে সম্মানই বড়।
হাসিব তিন ব্যাগ ভর্তি বাজার করে শশুর বাড়িতে আসলো। যাতে এসব নিয়ে আর চিন্তা করতে না হয় তার শ্বশুর শাশুড়িকে। এদিকে রুনা কিছু দিন থাকতে চায় এখানে। তাই বেশি করে বাজার করে এনেছে। আর ভেবে রেখেছে এখন থেকে প্রায়ই আসবে খোঁজ নিতে শ্বশুর বাড়িতে।
এতো বাজার দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ইকবাল সাহেব ও তার বউ রুবিনা। তাড়াতাড়ি ইকবাল সাহেব এগিয়ে এসে বলেনÑ এগুলো কী করেছো বাবা? তুমি জামাই মানুষ। তুমি কেন বাজার করতে গেলে বাবা? হাসিব বলেÑ কেন আব্বা? এটা তো আমারও বাড়ি। আর আমি জামাই মানে ছেলে আপনার। আর আমার পছন্দের সবকিছু এনেছি। আম্মা তার নিজের হাতে রান্না করে ছেলেকে সামনে বসিয়ে খাওয়াবেন। এখন থেকে আমি মাঝে মাঝেই আসবো। এখন বিরক্ত বেশি করবো। রুনা না আসলেও আমি আসবো। খোঁজ খবর নেওয়া হবে। খাওয়া দাওয়াও করতে পারবো। টেস্ট বদলানো আরকি।
ইকবাল সাহেব তাড়াতাড়ি রুবিনাকে বললেন, দাঁড়িয়ে থেকো না। তাড়াতাড়ি যাও রান্না করো। ছোট মেয়ে রানুকে ডেকে বললেন, তাড়াতাড়ি তোমার দুলাভাইকে শরবত দেও মা।আর রুনাকে বলো তোমার মা'কে সাহায্য করতে।
রুবিনা শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছেন আর রান্না করেন। নিজের সন্তান খবর নেয় না। পরের ছেলে জামাই মানুষ এতো চিন্তা করে আমাদের জন্য। কতো শখ ছিল মাসুদ এভাবে বাজার করে আনবে। আর ছেলেকে এভাবে সামনে বসিয়ে খাওয়াবেন। সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ছেলের প্রতি মায়ের মন বেশি নরম থাকে। রুবিনা হাসিবের মন মতোই সবকিছু রান্না করলেন রুনার কাছে থেকে শুনে।
হাসিব সবাইকে জোর করে এক সাথে নিয়ে খেতে বসলো। কিন্তু রুবিনা কিছুতেই বসলো না। হাসিবকে এনা ওটা বেড়ে খাওয়াছেন। মনে হচ্ছে সামনে মাসুদ বসে খাচ্ছে। আত্মতৃপ্তি নিয়ে খাওয়াচ্ছেন এক মা তার সন্তানদের। এটা এক মায়ের কাছে পরম তৃপ্তির দৃশ্য।
তিন বছর হয় মাসুদ বাড়িতে ইদ করে না। কিছু টাকা দিয়ে দেয়। আর কোরবানি ঢাকায় দেয়। ইকবাল সাহেবকে ইদের পরে পিঠা আর মাংস রান্না করে রুবিনা ঢাকায় পাঠান। ইকবাল সাহেব যেতে না চাইলে রুবিনা কান্নাকাটি করেন। তখন মাসুদ ইকবাল সাহেবের কাছে কোরবানির মাংস দিয়ে দেয়। সেটা আনতে অনেক লজ্জা লাগে ইকাবাল সাহেবের। ছেলে কষ্ট পাবে বলে নিষেধ করতে পারেন না।
একবার এমন মাংস দেওয়া দেখে মাসুদের বাসার কাজের মেয়েটা বলেছিল, আমাগোই তো এরচেয়ে বেশি মাংস দেয় আফা।
সেদিন ঐ মাংস আনতে ইকবাল সাহেবের মনে হচ্ছিল বুকের উপর পাথর টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। একবার ভেবেছিলেন, রাস্তায় গরিব মানুষকে দিয়ে যাবেন। পরে রুবিনার কথা ভেবে বাড়ি নিয়ে যান। কারণ রুবিনা জানে মাসুদ তাদের জন্য মাংস আলাদা করে রেখে দেয়। অথচ হাসিব প্রতি ইদে ইদের দিনই নিজে এসে মাংস দিয়ে যায়।
একবার ইকবাল সাহেব শীতের নানা রকম পিঠা নিয়ে মাসুদের বাসায় যায়। শীত এলেই রুবিনা মাসুদ আর রুনার শশুর বাড়িতে পিঠা আর খেজুরের রস পাঠান। সে বারও ইকবাল সাহেব ছেলের জন্য পিঠা আর রস নিয়ে যান। পাশের ঘর থেকে টিনা আর মাসুদের কথা শুনতে পান। টিনা মাসুদকে বলছিলÑ তোমার বাবা এসব দিতে আসেন নামে মাত্র। আসল কথা তো মুখে বলতে লজ্জা পান।আসলে কিছু টাকা পান। টাকার জন্য আসে।আর কিছু না। টান থাকলে তোমার কথা তারা ভাবতো।
সে বার আর মাসুদের জোরাজোরি করাতেও ইকবাল সাহেব টাকা নেননি। কারণ তার কলিজা ছিঁড়ে গেছে। সন্তানেরা টাকা দিয়ে বাবা মায়ের ভালোবাসা মাপে। এট সহ্য করা যায় না।
আজ হাসিবের ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ। মনে হচ্ছে জামাই না ছেলে সে এ বাড়ির। হাসিব রুনাকে রেখে যাচ্ছে। কারণ তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। হাসিব রুনার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললÑ এটা দিয়ে যখন যা লাগে আনবে। কিছু খেতে মন চাইলে বাজারে যাবে আব্বার সাথে। আর আম্মার বয়স হয়েছে। যে কয়দিন থাকো তুমি আর রানু রান্না সহ বাকি কাজে আম্মাকে সাহায্য করবে। বাবা মায়ের দোয়া আমাদের জন্য অনেক দরকার। তাদের দোয়া পাওয়া যায় একটুতেই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা। বাবা মা না থাকলে তখন আপসোস করি। আমার বাবাকে খুব মনে পড়ে। কতকিছু করার ইচ্ছা ছিল। সময় পেলাম না।
রুনার ঐ মুহূর্তে হাসিবকে ফেরেশতা মনে হচ্ছিল। তাই হাসিবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফোললো। হাসিব বুঝতে পারলো রুনার আবেগ অনুভূতি। তাই রুনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, পাগল কাঁদছো কেন? তোমার বাবা মা মানে আমারও বাবা মা। বাবা মায়ের জন্য করার সৌভাগ্য সবার হয় না। যাদের হয় তারা বুঝতে পারে না অনেকেই। একটা সময় বুঝতে পারে। কিন্তু তখন কিছুই করার থাকে না।
তখন রুনা মনে মনে ভাবছিল, তোমার মতো স্বামী পাওয়াও যে কোনো মেয়ের জন্য সৌভাগ্যের। রুনা ঠিক করলো সে একটা চাকরির জন্য এখন থেকেই চেষ্টা করবে। সত্যি তো বাবার অনেক সমস্যা। মাস্টার্স শেষ হলে ভালো একটা চাকরি হলে বাবা মায়ের কষ্ট থাকবে না। বাবা মা জীবিত অবস্থায় কিছু করতে পারা সন্তানের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। আর ছোট বোনের দায়িত্বও পালন করবে। রানু এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে। এখন থেকে বাবার চিন্তা করে যাবে তাহলে। বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে। বাবার ইচ্ছা ছিল সব সন্তানেরা শিক্ষিত হবে। সেই স্বপ্ন পূরণ করবে রুনা। রুনা একটা ধূসর গোধূলির পরে রাতের অন্ধকার শেষে নতুন দিনের অপেক্ষায় আছে।
আজকালের খবর/আরইউ