দেবেন অফিসে পিওনের কাজ শেষে শহরের প্রাচীনতম সিনেমা হল ‘শাবিস্তান’-এ প্রজেক্টর মেশিনম্যান হিসেবে ছবি চালাত। তার কাছেই শুনেছিলাম, কন্ট্রোল রুম থেকে ছায়াছবি প্রক্ষেপনে যে প্রজেক্টর সেখানে তীব্র আলো জ্বালায় কার্বন রড। সে মাঝে মধ্যে ছোট্ট বক্স ওপেন করে কার্বন রডে সিগারেট জ্বালায়। এই তথ্য অনেক পরে পেয়েছিলাম। দেবেন অফিসে কখনো চা এনে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে কথা। তারপর কিছু না বলে চলে যায়। দৈনিক পত্রিকার অফিস। সেখানে একরকম শখে কাজ করি। আমার কাজ এডিটোরিয়াল পেজ দেখা। সকাল নয়টায় এসে দুপুর পর্যন্ত অথবা কোনোাদিন সন্ধেয় এসে রাত আট-নয়। সকালে লোকজনের তেমন ভিড় হয় না। কখনো দশ বেজে গেলে একে একে দু-চারজন কন্ট্রিবিউটর এসে যান। আমানুল্লাহ আমান, সরদার মতিয়ার রহমান, আহমদ হোসেন, জনাব আলী আরো নতুন নতুন লেখক। বিভিন্ন্ন টপিক নিয়ে আলোচনা-আড্ডা চলে দীর্ঘক্ষণ। দেবেন একসময় এসে মাথা দেখে চা এনে দেয়। চায়ের কাপ বলতে কাচের ছোট সাইজের গ্লাস। সেগুলোর তলানিতে কখনো আদা বা লবঙ্গের দেখা পাওয়া যায়। আমি প্রায় সময় লাল-চা খাই না। দেবেন কখনো তর্জনী উঁচিয়ে সেটি জেনে নিতে চায়। সে অনেক প্রতিভ। সাতাশ-আটাশ বছরের যুবক, কিন্তু জীবনযাপনের অভিজ্ঞতায় অনেক পরিপক্ব। সেদিন সন্ধেয় এডিটোরিয়াল পেজের ম্যাটার রেডি করছি। নিরিবিলি পরিবেশ। আগামীকালের সম্পাদকীয় লেখায় বেশ নিবিষ্ট ছিলাম। আচমকা আলোর বিপরীতে ছায়া ঘিরে ধরলে ফিরে তাকাই, দেখি দেবেন; সে অন্যরকম চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।‘দেবেন কিছু বলবে?’
সে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আনমনা হলো। ফেব্রুয়ারির শেষ সময়ে সন্ধেরাতে কখনো বাতাসে শীত শীত আমেজ থাকে। সারাদিন হালকা তাপের এমন পরিবেশই নাকি বসন্তকাল। মানুষের মন বাউরি বাতাসের মতো উদাস কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে হেসেও ফেলে। কেউ কেউ যেমন বুকের গহিনে কষ্ট নিয়ে হেসে হেসে কথা বলে, বলতে বলতে খুব গোপনে ভয় পায়; এই বুঝি অশ্রু চোখ বেয়ে নেমে এলো। কি যায় আসে! মানুষ তো আনন্দেও কাঁদে নাকি? মাথায় গল্পের প্লট ভেসে বেড়ায়। লিখতে বসা হয় না। পুবে ঘুলঘুলি টাইপের একটি জানালা আছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে রাস্তা দেখা যায়। মানুষের মন দেখা যায় না। সেই ঘুলঘুলি দিয়ে বাতাস এসে হিমেল স্পর্শ দিয়ে যায়। দেবেন মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করেÑ
‘দাদা আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবেন?’
আমার গল্প লেখার শখ আছে। বেশিরভাগ বিষাদ কাহিনী। পত্রিকায় কখনো প্রকাশ পায়। কখনো দেখি বেশ মনোযোগের সঙ্গে গল্প পড়ছে দেবেন। তার মুখে হাসি নেই। তাকে কখনো হাসতে দেখি নাই। জীবনের সরল অঙ্কে সবকিছু বুঝি জটিল হিসাবনিকাশ। কখনো সেটি চেহারায় প্রতিভাস হয়। আমরা কারো চেহারা দেখে বলতে পারি না, কার বুকে কী ঝড় চলছে কিংবা কোনো কৌতুক। দেবেন হাসিঠাট্টা করে না। তার চেহারা নিশ্চুপ অভিব্যক্তিহীন পাথরের মূর্তি। আমি একপলক তাকিয়ে জবাব দিলাম।
‘আচ্ছা লিখব।’
সে গল্প আর লেখা হয়নি। দেবেন নিজের বাবা-মা তো বটেই এক বিধবার সঙ্গে ভালো স¤পর্ক গড়ে তুলেছিল। সেই গল্প কমবেশি সকলের জানা। দেবেনের বউ কারো হাত ধরে পালিয়ে যায়। একটি সন্তান। তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। দেবেনের বুকে জেগে থাকা নিশ্চুপ কষ্ট-অপমান আর অভিমান আচমকা চোখে ঝিলমিল করে। কলেজে পা রেখে প্রেমে পড়েছিল সে। একই পাড়ায় তিন-চার বাড়ি পেরিয়ে যে ঘর, সেখানে থাকত তাপসী রানি পুষ্প। সে তখন ক্লাস নাইনে। চোখের দেখা দেখতে দেখতে মনের সংযোগ। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে হয়েছিল। অভিভাবকেরাও কয়েকমাস পর মেনে নেয়। সাবিত্রি-সত্যবানের মতো একজন আরেকজনকে টেনে রাখে। মানুষের মন জুড়োয়। মানুষের চোখ টাটায়। মানুষের ঈর্ষা জ্বলে রাতের সিঁথানে। এমন মিল দু-জনের।
একসময় দেবেনকে পৃথক করে দিল বাবা। সে শহরে এলো। শিকদার হাটের এককোণায় ঘর ভাড়া নিল। সারাদিন রিকশা চালায়। দিনশেষে দু-জনে পরস্পকের জড়িয়ে ঘুমোয়। স্বপ্ন দেখে। তাদের পড়াশোনার অধ্যায় শেষ। এভাবেই জীবন চলতে চলতে জীবনের চক্রে সন্তান এলো। এক-দুই বছর। তারপর তাপসী কোথায় হারিয়ে গেল, তার সামনে-পেছনের পটভূমির কোনো হদিশ জানল না দেবেন। সে খোঁজ পেল না। দিশেহারার মতো এখানে-ওখানে খুঁজে শেষে একেবারে চুপ হয়ে গেল। মানুষ চলে যায়, মানুষ হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে খুঁজে পায় আর সে যখন আর ফিরে আসে না বা আসতে চায় না; তখন আর কী করার থাকে! এই নিয়ে গ্রামের এ-পাড়া ও-পাড়া হাজারও কুৎসা আর গুজব ভেসে বেড়ায়। সে-সব হলো শুকিয়ে যাওয়া গু-এর মতো, শুধু দুর্গন্ধ ছড়ায়; তারপর শুনতে শুনতে সবকিছু থিতো হয়ে আসে। দেবেন বলে-
‘দাদা, আমার ছেলেটা কত বড় হলো কে জানে। পুষ্প যদি রেখে যেত, এত কষ্ট পেতাম না।’
আমি কথা বলতে পারতাম না। কী বলব? সব মানুষ তো কাবুলিওয়ালার মতো কঠিন হৃদয় নয়। রবি ঠাকুর তবু কঠিন হৃদয়ের মধ্যে জলধারা এনেছিলেন। দেবেনের মনে যে কান্নার জলস্রোত। সেখানে বাঁধ দেয় কে? দেবেন পুনরায় অফিস রুমের বাইরে গেটে গিয়ে বসে। তার হাতদুটো কোলের উপর ঝুলে থাকে যেন শুকনো শরীরের বাতিল অংশ। আমি এডিটোরিয়াল পেজের ম্যাটার সম্পাদনা করতে করতে নিশ্চুপ হয়ে দেখে যাই। ঈশ্বর মানুষের মনে এত প্রেম এত ভালোবাসা আর মায়া কেন দিয়েছেন? কুকুরের চোখে। গরুর দৃষ্টিতে। সবকিছুই মায়ার খেলা। আবেগ আর ভালোবাসা। একদিন রাতের শিফটে মন্তব্য করলাম।
‘দেবেন তুমি নাকি বিধবা মহিলার সঙ্গে অ্যাফেয়ারে জড়িয়েছ? এখন তো অসবর্ণ বিবাহ হয়, বিয়ে করে নাও না কেন?’
‘ছি ছি দাদা! কোথায় কী শুনেছেন দাদা কে জানে। রমা বউদিকে বড়দিদির মতো শ্রদ্ধা করি। আমি তার ছোটভাই।’
‘মানুষজন কিন্তু ভিন্ন ভাবে। নোংরা কথা বলে। তাদের মুখ বন্ধ করে দাও।’
‘আমি ওই বাবাই-এর জন্য যাই দাদা। তা ছাড়া রমাদির কেউ নাই। শাশুড়ির বয়স হয়েছে। নিজের খেয়াল ঠিকমতো রাখতে পারে না, আর ছেলে বউয়ের! বাবাই বড় হচ্ছে। সামনের বছর স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে।’
‘তুমি খরচ চালাও?’
‘এ ছাড়া কে আছে! বাবাই আমার ছেলে।’
‘তোমার বউয়ের খবর পাও না? ছেলেকে দেখতে যাও না?’
‘সে মন্মথপুর থাকে। তাকে বললাম, পুষ্প যা করেছিস করেছিস, এবার চল। সে আসবে না। তার স্বামী রাগ করে। পুষ্পকে মারে? ছেলেটাকে যদি মারধর করে?’
‘তাই যাও না। আচ্ছা সেই লোক নাকি মুসলমান?’
‘হ্যাঁ দাদা। মুসলমান কি আর হিন্দু, মানুষের জন্ম তো নারীর জরায়ু থেকেই হয়। কেউ ভগবান ডাকে কেউ আল্লাহ। পুষ্প সুখে থাক দাদা। আমার কোনো অভিযোগ নাই। সুনিলকে চাইলাম। সে দিল না।’
‘কেন দিল না? সে তোমার সন্তান।’
‘দেখতেই দেয় না দাদা। আমি কি তার জন্মদাতা বাপ নই দাদা?’
দেবেনের চোখে কান্না আসে। কোনো শব্দ নেই, ডুকরে ওঠার ধ্বনি নেই; নিশ্চুপ কান্না। প্রত্যেক মানুষের বুকে কিছু কান্না থাকে। সেটি নিরিবিলি ফোঁপানোর মতো একান্ত তার। গোপনীয়। দেবেনের গল্প গোপন। অফিসের কেউ জানত? জানি না। আমাকে কেন যে সব কথা বলেছিল রহস্য জানা নেই। সম্ভবত গল্প লেখার আবদারে।
দেবেন কখনো সকাল সাড়ে সাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে। কখনো বিকাল পাঁচ বা সন্ধে। তারপর প্রজেক্টর মেশিনের কাজ। অন্যান্য সময় কী করে কোথায় কাটায় কে জানে। আমার অফিস শিফট সকাল থেকে দুপুর। কোনো মাসে সন্ধে থেকে লাস্ট লিড পর্যন্ত। যদিও নিউজের দায়িত্ব নুরুল ইসলাম ভাইয়ের হাতে। কখনো অ্যাডভান্স এডিটোরিয়াল লেখা হয়। ব্যাক পেজ ফিচার লিখি। জাকারিয়া সাহিত্য পাতা দেখে। আমাকে বলেÑ
‘ভাই, আপনি গল্প লেখেন, সাহিত্যপাতার দায়িত্ব নিন। মজা পাবেন কাজ করে।’
‘তাই? আচ্ছা একটু ফ্রি হয়ে নেব।’
আমি যে কাগজে কাজ করি, সেখানে নিজের লেখা দিই না। লেখা যে তেমন খুব বহমান তেমনও নয়। অলস মানুষের যা হয়। কখনো কখনো লিখতে বসি মাত্র। দেবেনের কাহিনি লিখব। অথচ কী লিখব কীভাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। একজন পিতা, তার সন্তানকে এক-দেড় বছর প্রায় কোলেপিঠে মানুষ করল। আদর সোহাগে প্রাণ জুড়োল। তারপর সেই সন্তানকে নিয়ে চলে গেল মা। পিতার বুকে কেমন অনুভুতি বা উপলব্ধি? যেখানে আবেগ সেখানে ভাষা থাকে না। দেবেনের আবেগময় কথায় তাই ভাষা খুঁজে পাই না। এত নির্মোহভাবে রবি ঠাকুর কাবুলিওয়ালার দৃশ্য আঁকলেন কীভাবে? তিনি নমস্য বলেই পেরেছেন। আমি একদিন-দুদিন রাইটিং প্যাড আর বলপয়েন্ট নিয়ে জেগে থাকলাম। রাত গভীর থেকে আরও অন্ধকার হলো, অন্ধকার থেকে ভোরের আলো জেগে উঠল; লেখার ভোর হলো না। এলোমেলো কিছু আঁকিবুকি ছাড়া আর কিছু নয়।
কয়েকদিন পর সকালে খবর পেলাম। দেবেন বাড়ির কাছে জঙ্গলের এক গাছে ঝুলে পড়েছে। অফিসের পিওন দেবেন। সিনেমা হলের প্রজেক্টর মেশিনম্যান। সে সিনেমা দেখে। নায়ক-নায়িকা হাজারো বিরুদ্ধ পরিবেশের মোকাবেলা করে পরিশেষে জিতে যায়। তারা প্রেম করে। কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। তারা গান গায়। চমৎকার সব কথা বলে। দেবেনের বুকে ক্ষত। মনের মধ্যে প্রেমের গান। ছায়াছবির জীবন কত সুন্দর। কত মসৃণ। সেই মন মরে গেছে। দেবেন কি জানত জীবন ছায়াছবি নয়? দেবেন খুব সকালে আধভাঙা সাইকেলে এসে অফিস ঝাড়ু দিয়ে মেইন গেটে টুলের উপর বসে থাকত। সেদিনের কাগজে ঝুঁকে খবর পড়ত। তার বুকের খবর কে পড়ে? সে নিজেও কি পড়েছে?
দেবেন চা এনে দিত। সেই চায়ের কাপে ডুবে থাকত কাচা আদার ঝাঁজ। আমি চায়ে চুমুক দিতাম। একজন পিতার বুকে আগুন দেখতাম। সেই আগুনের প্রক্ষেপনে আলো ছড়াত। সিনেমা হলের পরদায় দেখা যেত গল্পের দৃশ্য। ছায়াছবি। দেবেন মরে গেল। এই মৃত্যুতে কারো জীবন কি কার্বন রডের তীব্র আলোর মতো আলোকিত হলো? তাকে নিয়ে গল্প লেখা হলো না। দেবেন এখন সন্ধের অনুরাগে আগুনে জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে। পুনর্ভবার পূর্ব তীরে জ্বলছে চিতা। একটি ছায়াছবির সমাপ্তি। আকাশের দূর নীলিমায় ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে ছায়াছবির হাজারও দৃশ্য তৈরি হতে হতে মিশে যায়। দেবেনের আবদার ছিল।
‘দাদা আমার কাহিনী নিয়ে একটি গল্প লিখবেন?’
আমি সেই আবেগ নির্মোহ কূশলতায় লিখতে পারি নাই। এখন আকাশের বুকে সেই ধোঁয়া মিশে যেতে যেতে কেন জানি বারবার শেষ কথা বেজে ওঠে। জীবন ছায়াছবি নয়।
আজকালের খবর/আরইউ