বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
সাইবার আসক্তি ও প্রজন্মের হুমকি
ইফতেখার নাজিম
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫, ৬:২১ PM
প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এমন বাস্তবতায় এসেছে, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তথ্য আদান প্রদান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার, মোবাইল ফোনের অপরিহার্যতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত মানুষ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নির্ভর হয়ে পড়ছে। বর্তমানে পড়াশোনা, গবেষণা, ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ, ধর্ম-কর্ম সবই চলছে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বৈশ্বিক করোনার প্রাদুর্ভাবকে কেন্দ্র করে যখন বিশ্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ওই সময়ে লোকজন অনেকটা ভার্চুয়াল জগত নির্ভর হয়ে যায়। দীর্ঘদিন শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল শিক্ষায় অংশ নেয় এবং অধিকাংশ শিক্ষার্থী ডিজিটাল অ্যাক্সেসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই অভ্যস্ততার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে, সেটি এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলছে। বিশেষ করে সাইবার আসক্তি ও প্রজন্মগত হুমকির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম থেকে ক্লাউড স্টোরেজ, অনলাইন গেমিং থেকে রিমোট ওয়ার্ক সব কিছু মিলিয়ে সার্ভারের ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে সাইবার আসক্তির মতো ঝুঁকিও।

সাইবার আসক্তি বৃদ্ধিতে মোটাদাগে কনস্ট্যান্ট কানেক্টিভিটি, তাৎক্ষণিক তৃপ্তি, কাজ ও সামাজিক একীকরণকে দায়ী করা যায়। ইমেইল থেকে ব্যক্তিগত বিনোদন; সবকিছু অ্যাক্সেস করার জন্য আমরা সার্ভার নির্ভর হয়ে পড়ছি, যা আমাদের ডিজিটাল নির্ভরতার অনুভূতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেটিকে আমরা কনস্ট্যান্ট কানেক্টিভিটি বলতে পারি। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের নকশা বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইক, বিজ্ঞপ্তি বা স্ট্রিমিং পরিষষেবাগুলোর উপলব্ধ সামগ্রী তাৎক্ষণিক তৃপ্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, ফলে ব্যবহারকারীরা ক্রমাগত উদ্দীপনা পাওয়ার জন্য এই পরিষেবাগুলির সাথে সংযুক্ত থাকতে বাধ্য বোধ করে। অন্যদিকে পেশাদার বাধ্যবাধকতা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও শিক্ষাসহ জীবনের আরো অনেক দিক ডিজিটাল স্পেসে চলে যাওয়ায় এখন মানুষ নিজেদেরকে ক্লাউড ভিত্তিক সার্ভারের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীল বলে মনে করে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনের এই একীকরণ সিস্টেমগুলোর ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে এবং মানুষ নিজ অজান্তেই সাইবার আসক্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছে।

সাইবার আসক্তি প্রথাগত অর্থে বাধ্যতামূলক আচরণকে বোঝায় না বরং ডিজিটাল ইকোসিস্টেমগুলোতে গভীরভাবে এম্বেড হওয়ার সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিণতিগুলোকে বোঝায়। যদিও সাইবার আসক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ক্লিনিকাল অবস্থা হিসাবে স্বীকৃত নয়, এর লক্ষণগুলি দৈনন্দিন জীবনে লক্ষণীয়। সার্ভার ডাউনটাইম বা সংযোগ সমস্যাগুলির কারণে যখন তারা তাদের ডেটা বা পরিষেবাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে না, তখন অনেক লোক উদ্বিগ্ন বা হতাশাবোধ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি এক ঘণ্টার জন্যও বন্ধ থাকে, তখন প্রায়শই ব্যবহারকারীদের মধ্যে চাপ বা আতঙ্কের একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে। এতে বুঝা যায়-অনলাইন পরিষেবাগুলির সাথে আমাদের জীবন কীভাবে জড়িয়ে গেছে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, টিনএজকালে শিশুরা সাইবার আসক্তিতে জড়ানোর মূল কারণ হলো পর্নোগ্রাফি। এই পর্নোগ্রাফি অন্যান্য মাদকের ন্যায় মানুষকে আসক্তি করে। মাদক আসক্তি মানব মস্তিষ্ককে যেভাবে প্রভাবিত করে পনোগ্রাফিও মস্তিষ্কে অনুরূপ প্রভাব ফেলে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় পনোগ্রাফি আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ানক প্রমাণিত হয়েছে। পনোগ্রাফি আসক্তিকে তুলনা করা হয়েছে ডিজিটাল কোকেন বা হেরোইন আসক্তির সঙ্গে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক ম্যাক্স চ্যাং বলেন, বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এই বয়সে মানুষের ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। এই সময়ে প্রযুক্তি আসক্তি তৈরি হলে মস্তিষ্ক ভিন্ন আচরণ শুরু করে। অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে মানুষের স্নায়বিক পরিবর্তনও হতে পারে। মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক আচরণ ও দৈনন্দিন অভ্যাসে প্রভাব ফেলছে। আরেক গবেষক আইন লি বলেন, তরুণদের ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে মানসিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া বদলে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা কমে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করা যায়-যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোন বন্ধ করা হয়েছে, ওই সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ফলাফল অন্যান্যদের তুলনায় ছয় শতাংশ ভালো। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস রিভিউ সাময়িকীর তথ্যমতে, ২০১০ সালে কর্মক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ তরুণ ম্যানেজার মুঠোফোনে আসক্তি ২০১৪ সালে ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক সময়ে তা ৭৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয় বরং সার্বিকভাবেই উদ্বেগজনক।

সাইবার আসক্তি যতই বাড়ছে, ডিজিটাল নির্ভরতার সাথে যুক্ত প্রজন্মের মাঝে প্রজন্মগত বিভাজন, জ্ঞানীয় বিকাশে বাধা, অর্থনৈতিক অসমতা ও অ্যাক্সেস, সাংস্কৃতিক বিভাজনের হুমকি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল জ্ঞানলব্ধ প্রজন্মের সাথে প্রবীণ প্রজন্মের দূরত্ব বাড়ছে এবং সমাজ রাষ্ট্রে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। যা সামাজিক শৃঙ্খলাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে শিশু ও তরুণ প্রাপ্ত বয়স্ক যারা ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যাপক সময় ব্যয় করে সঙ্গত কারণে তারা নিজেদের মধ্যে সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাতে পারে না। ফলে সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যার সমাধান ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক কারণে বিশ্বের পুরো প্রজন্মের ডিজিটাল সরঞ্জাম ও অবকাঠামোগত সমান অ্যাক্সেস নেই, যা আমাদের সাইবার নির্ভর বিশ্বকে টিকিয়ে রাখে। এই বৈষম্য ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করে, যেখানে কিছু লোক পেছনে পড়ে থাকে, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দেয়। ডিজিটাল বিষয়বস্তু যতো বেশি বিশ্বায়ন হয়ে যায়, ততো বেশি সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবোধ হারিয়ে যায়। যা প্রজন্মকে ভিনদেশীয় অপসংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেয়, যা সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক বিনোদনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

সাইবার আসক্তির নেতিবাচক প্রভাব ও প্রজন্মের হুমকি হ্রাসে একটি সুষম পদ্ধতির প্রয়োজন। যেখানে কিছু কৌশল হিসেবে (১) ডিজিটাল ডিটক্স ডিজিটাল ডিভাইস ও সার্ভার থেকে নিয়মিত বিরতি নেওয়া ব্যক্তিদের অফলাইন বিশ্বের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে, স্বাস্থ্যকর মানসিক অভ্যাস গড়ে তুলতে এবং অবিরাম সংযোগের উপর নির্ভরতা হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে। (২) ডিজিটাল লিটারেসি এডুকেশন ব্যক্তিদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে ডিজিটাল স্পেস বোঝার ও নেভিগেট করার টুল দিয়ে সজ্জিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে গোপনীয়তা, নিরাপত্তা ও ডিজিটাল আসক্তির সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করা। (৩) ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রদত্ত সুযোগগুলিতে ন্যায়সঙ্গত অ্যাক্সেস নিশ্চিত করতে নিরাপদ, টেকসই ও সকলের কাছে অ্যাক্সেসযোগ্য অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। (৪) মানুষকে অফলাইন ক্রিয়াকলাপগুলিতে জড়িত হতে উৎসাহিত করা- যেমন শারীরিক ব্যায়াম, সামাজিক জমায়েত এবং শখগুলি-সাইবার আসক্তির নেতিবাচক প্রভাবগুলি প্রশমিত করতে সহায়তা করতে পারে।

বাংলাদেশের উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের মাঝে যে ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটির পেছনে অবাধ ডিজিটাল অ্যাক্সেসের দায় এড়ানো যায় না। ডিজিটালাইজেশনের নামে যেভাবে তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ ও পনোগ্রাফি সাইটগুলো অ্যাক্সেস করছে, সেটি মূলত তরুণ প্রজন্মকে বিকৃত মানসিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অবাধ ডিজিটাল অ্যাক্সেসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে সাইবার আসক্তিতে জড়ানোর কারণে তাদের পড়াশোনায় অমনোযোগতা ও আচরণগত যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, সেটি বিশ্লেষণ করে তাদেরকে সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ শিক্ষক থাকা প্রয়োজন হলেও সেই ধরনের কোনো শিক্ষক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গভীরভাবে ভাবতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগকে পনোগ্রাফির ন্যায় যে সব বিষয়গুলো তরুণ প্রজন্মকে আসক্তির দিকে নিয়ে যায়, ওই সব সাইট ফিল্টারিং করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাইবার আসক্তি একটি ক্রমবর্ধমান ঘটনা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল অবকাঠামোর ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে প্রতিফলিত করে। যদিও অনলাইন পরিষেবাগুলির সুবিধাগুলি অনস্বীকার্য, তবু এই সিস্টেমগুলির ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করার দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক ও প্রজন্মগত পরিণতিগুলিকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। ঝুঁকিগুলো বোঝার মাধ্যমে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে সার্ভার আসক্তি থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে আগামীতে চরম এক বিশৃঙ্খল জাতিতে আমরা পরিণত হবো। যা আমাদের সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেবে।

লেখক : কলাম লেখক। 

আজকালের খবর/আরইউ 








সর্বশেষ সংবাদ
রেললাইনের পাশে আওয়ামী লীগ নেতার মাথা কাটা লাশ উদ্ধার
বেবিচক চেয়ারম্যানের সঙ্গে জাপানের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
কুয়েটে একাডেমিক কার্যক্রম ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত
অবশেষে মারা গেলেন জবি শিক্ষার্থী আহাদ
সিলেটে বিএনপির গণসমাবেশ : রেজিস্ট্রারি মাঠে জড়ো হচ্ছেন নেতাকর্মীরা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
পূর্বধলায় ডেভিল হান্টের অভিযানে যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার
তিস্তা অঞ্চলগত সমস্যা নয়, এটি একটি জাতিগত সমস্যা: গয়েশ্বর রায়
শেখ হাসিনার সামরিক সচিবকে পুলিশে দিলো ছাত্র-জনতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল-বৈষম্যবিরোধীদের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ
মশাল হাতে তিস্তাপারে ন্যায্য হিস্যা চাইলেন আন্দোলনকারীরা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft