ড. মোহাম্মদ আবদুল আজিম শাহ্
আউলিয়ারা আল্লাহর বন্ধু। তারা আল্লাহর বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, স্থান, কাল সর্ববিষয়ের উর্ধ্বে বিচরণ করেন। তাদের ইশারায় পলকেই তকদির পরিবর্তন হয়, মূর্খও মহাজ্ঞানীতে পরিণত হন। তারা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে স্তরবিশেষে গাউস, কুতুব, আবদাল, আকতাবসহ বিভিন্ন পদমর্যাদায় আসীন হয়ে সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ মজজুবেসালেকরূপে বেলায়েতের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়ে সৃষ্টিকুলের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। তারা শ্রেষ্ঠঅলী হিসেবে পরিচিত। আবার শ্রেষ্ঠ অলিদের মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য বিশেষ দান, ফজিলতে রব্বানী ও গাউসুলআজম রূপে কতক অলির আগমন ঘটে। তাদের বলা হয় ‘ফরদুল আফরাদ অলি’। আরবি ফরিদুল অর্থ অনন্য, অতুলনীয়। আফরাদ অর্থ অসাধারণ, শ্রেষ্ঠ৷ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠকে ফরদুল আফরাদ বলা হয়। যুগসংস্কারক হিসেবে প্রকৃতিগতভাবে তাদের আগমন ঘটে। যারা তরিকায় নতুনত্ব আনায়নপূর্বক মানবকে স্রষ্টামুখী করেন; তাদের মধ্যে হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভাণ্ডারী (প্রকাশ-হজরতকেবলা) অন্যতম। এইসব যুগসংস্কারক অলিকে চিনতে এবং তাদের নীতি গ্রহণ করতে হয়।
হাদিস শরিফে আছে, ‘যে কেহ যুগসংস্কারক ইমামকে (নিজ জামানার ইমাম) চিনে না; তার মৃত্যু মূর্খতার মৃত্যু। রসূলেপাক (দ.)-এর ছয়শ বছর পর ঝিমিয়েপড়া ইসলামধর্মকে পুনর্জীবিত করণে খোদার বিশেষ দান হিসেবে পীরানেপীর দস্তগীর (দ্বাদশ শতাব্দীতে) গাউসুলআজম হজরত সৈয়দ আবদুল কাদের (ক.) জিলানী আবির্ভূত হয়ে শৃঙ্খলিত যুগে কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তনসহ ইসলামধর্মের সোনালী অতীতকে ফিরিয়ে আনেন। এজন্য তার উপাধি মহিউদ্দিন (ধর্মের পুনর্জীবনদাতা)। তিনি একজন ফরদুল আফরাদ অলি। তখন জ্ঞানের জগতে মুসলিমউম্মাহ ছিল বিশ্বগুরু। পুরোবিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞানে পুনরায় মুসলিম উম্মাহকে অনুসরণ করতে থাকে। এটি ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগ। একইভাবে গরিবেনেওয়াজ হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতীও ‘চিশতিয়া তরিকায়' সঙ্গীত সংযোজন করে লাখ লাখ মানুষকে খোদাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এজন্য তিনিও ফরদুল অফরাদ অলি হিসেবে খ্যাত। কালের পরিবর্তনে মুসলিমউম্মাহ পুনরায় সোনালী অতীতকে হারিয়ে ধর্মবিবর্জিত জীবনধারাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে পীরানেপীর দস্তগীর (ক.)'র আগমনের পাচঁশ বছর পর (অষ্টাদশ শতাব্দীতে) প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য প্রকৃতির রানি ও বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি নামে খ্যাত চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক লীলানিকেতন ভূমি ফটিকছড়ি মাইজভান্ডার নামক গ্রামে ফজিলতে রব্বানী, যুগসংস্কারক হজরত শাহ্সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভান্ডারী ১ মাঘ ১২৩৩ বাংলা, বুধবার জোহরের সময় পিতা -মৌলভী হজরত শাহ্সুফি সৈয়দ মতিউল্লাহ (রহ.)'র মস্তক, জননী-মোসাম্মত খাইরুননেসা সাহেবানের পবিত্র উদর থেকে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে সুদূর ১২৬৮ হিজরীতে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সহিত শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। হাদিস, তফসীর, ফেকাহ, মন্তেক, হেকমত, বালাগত, উসুল আকায়েদ সহ যাবতীয় শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে ১২৬৯ হিজরীতে যশোর জেলায় (বিচার বিভাগে) তৎকালীন কাজী পদে নিয়োজিত হন। কিন্তু উক্তকাজে তার মন না বসায় ১২৭০ হিজরীতে কাজিপদ থেকে ইস্তফা দেন। শিক্ষকতা পেশায় ইচ্ছা থাকায় পরবর্তীতে কলিকাতায় মুন্সি বু আলি মাদ্রাসায় প্রধান মোদারেস হিসেবে যুক্ত হন। তিনি গাউসুলআজম হজরত পিরানে পীর দস্তগীর হজরত মহিউদ্দিন সৈয়দ আবদুল কাদের (ক.) জিলানীর বংশধর সরদারে আউলিয়া গাউসে কউনাইন হজরত সৈয়দ শাহমা ছালেহ আলকাদেরী লাহুরী থেকে বিলবেরাসত গাউসিয়তের ফয়েজ ও খেলাফত অর্জন করেন। পরবর্তীতে তার বড়ভাই হজরত শাহসুফি সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (তিনি খোদারভাবে চিরকুমার ছিলেন) থেকে ফয়েজএত্তেহাদি তথা কুতবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন। (সেই হিসেবে তিনি, হজরতকেবলার পীরে তফাইয়োজ)। হজরত কেবলা প্রাকৃতিকগতভাবে (বেলায়তে বিল আসালত) মাতৃগর্ভ অলি ছিলেন। আবার পীরমুর্শিদের খেদমত, সোহবত ও খেলাফত অর্জনের মাধ্যমে বেলায়তে বিলবেরাসত, সাধনার মাধ্যমে শিক্ষা দীক্ষা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে বেলায়তে বিদ দারাসত এবং কঠোর সাধনায় প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ করে বেলায়তে বিলমালামত অর্জন করেন। এই চার প্রকার বেলায়েত অর্জন করে সলুকীয়ত ও জজবীয়তের সংমিশ্রণে মজ্জুবেসালেক (বেলায়তের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত) অলি হিসেবে কুতবিয়ত ও গাউছিয়তের মর্যাদা নিয়ে গাউসুলআজমরূপে হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভাণ্ডারীর আবির্ভাব হয়।
হজরত ছোটবেলা থেকেই নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ছিলেন। খুব কম কথা বলতেন। রাত্রে দুই ভাগ তিনি আল্লাহর এবাদত ও ধ্যানে কাটাতেন। মৃদু হাসি তার স্বভাব। কখনো অট্টহাসি পছন্দ করতেন না। সময়ে সময়ে তিনি মুক্তমাঠে নদীর পাড়ে একাকী নীরবে বসে থাকতেন। হজরত সবসময় উদাসীন থাকতেন। আত্মনির্ভরশীল ছিলেন, অর্থ উপার্জনে কোনো চেষ্টাই করতেন না। তার অটল বিশ্বাস আল্লাহই একমাত্র রিজিকদাতা। তিনিই প্রতিপালন করবেন। তিনি সবসময় বলতেন আল্লাহ যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন। তার সকল কাজে সবর ও ধৈর্য দেখা যেত। বেশিরভাগ সময় নির্ঘুম রাত কাটাতেন। রোজা পালনে অভ্যস্ত ছিলেন। সবসময় খোদারভাবে বিভোর থাকতেন।
হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) যুগসংস্কারকরূপে আবির্ভূত হয়ে নিভু নিভু ধর্মে (তরিকায়) সংস্কার আনেন। সংস্কারের পেছনে কোরআন শরিফের নির্দেশনাকেই অনুসরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে আছে, `তোমরা ভালো উপদেশ-কৌশলের মাধ্যমে মানবজাতিকে ধর্মের দিকে আহ্বান করো‘ (সূরা নাহল - ২৫)। তিনি যুগের চাহিদা অনুযায়ী হেকমতের মাধ্যমে বেলায়তে মোহাম্মদী ও আহমদীধারার সমাবেশকারী (অর্থাৎ-দু'ধারার সঙ্গমস্থলরূপে) হিসেবে বিকশিত হয়ে তরিকায় নতুনত্ব আনেন। এটি কোনো তরিকা নয়, সকল তরিকার সমন্বয়, দর্শন নয় বরং দর্শনের মূলতত্ত্ব। যার নাম উন্মুক্ত আধ্যাত্ম্যবাদ।
তার উন্মুক্ত আধ্যাত্মবাদের কয়েকটি বিশেষত্ব তুলে ধরা হল- ১. তিনি ধর্মবিবর্জিত জীবনধারা থেকে নৈতিকতার দিকে ধাবিত এবং চিন্তাশীল মানবসৃষ্টির লক্ষ্যে শৃঙ্খলিত বেলায়তযুগের অবসান ঘটিয়ে উন্মুক্ত বেলায়ত যুগের সূচনা করেন।
২. সকল ধর্মের নৈতিকতায় যে কোনো পার্থক্য নেই সেটি সম্যক অবগত হয়ে ধর্মসাম্য নীতি প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্ম বিরোধ উচ্ছেদই তার মূললক্ষ্য। তিনি সকলধর্মের আচারিকতাকে প্রাধান্য না দিয়ে নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে হজরতের বেলায়তের তাবুতে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেন। এজন্য মাইজভাণ্ডার শরিফ সকল ধর্মের মিলনকেন্দ্র। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই তার গুণমুগ্ধ ছিলেন।
৩. এটি সকল তরিকার সমন্বয়ে খিজিরি তরিকা বিধায় যে কেউ সহজে বুঝে না।শাহাবুদ্দিন নামক জনৈক মওলানা, দরবারের বৈচিত্র্যতা, বিভিন্ন ভাবধারার মানুষ দেখে হজরতকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘মিয়া! যিছ দোকানমে হার চিজ হ্যায়; ওহি আচ্ছা হ্যায়‘। অর্থাৎ যে দোকানে সকল কিছু পাওয়া যায় সেটি উত্তম দোকান।
৪. এ দর্শন সুবুদ্ধির দর্শন। সুবুদ্ধি সম্পর্কে বেলায়তে ওজমার অধিকারী গাউসেভাণ্ডার হজরত শাহ্সুফি মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্ (ক.) ফরহাদাবাদী (নাজিরহাট পূর্ব ফরহাদাবাদ গ্রামে তার মাজার শরীফ অবস্থিত) বলেছেন, ‘সুবুদ্ধিতে খোদা, সুবুদ্ধিতে রসূল (দ.), সুবুদ্ধিতে কোরআন, সুবুদ্ধিতে ইসলাম, সুবুদ্ধিতে ঈমান, সুবুদ্ধিতে মানবতা’। সুবুদ্ধি ব্যতীত স্রষ্টামিলন অসম্ভব। সুবুদ্ধি ব্যতীত সর্বসাধন বৃথা। সুবুদ্ধির মধ্যেই শান্তি নিহিত। মাইজভাণ্ডার শরিফে কু-বুদ্ধির কোনো স্থান নেই। এই বিষয়ে হজরতকেবলা বলেছেন, ‘এখানে হাওয়াকে দাফন করা হয়েছে‘। অর্থাৎ অনর্থ পরিত্যাজ্য করা হয়েছে। অতএব আত্মশুদ্ধিসহ প্রবৃত্তিকে বিনাশের মাধ্যমে ক্ষমা, দয়াপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে মাইজভাণ্ডার শরিফ গেলেই এর শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবণ সম্ভব।
৬. তিনিই মহান; যিনি পরবর্তী প্রজন্মকে তার সমকক্ষ কিংবা তার চেয়েও মহান হওয়ার সুযোগ করে দেন। এক্ষেত্রে হজরত সর্বোচ্চ উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি পরবর্তী প্রজন্মকে মহান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বলেই পদাঙ্ক অনুসরণকারীদের মধ্যে মহানসত্তার আবির্ভাব হয়েছে, যারা বেলায়তের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হয়েছেন এবং তাদের বেলায়তি ক্ষমতার ব্যপ্তি হযরতকেবলা থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাদের মধ্যে ইউসুফেসানী, জামালে মোস্তফা গাউসুলআজম বিলবেরাসত হজরত সৈয়দ গোলাম রহমান শাহ্ মাইজভাণ্ডারী (মতান্তরে গোলামুর রহমান), গাউসেভাণ্ডার হজরত শাহসুফি মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্ (ক.) ফরহাদাবাদী, শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক (ক.) মাইজভাণ্ডারী অন্যতম। তারাও যে বেলায়তের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে সমগ্র সৃষ্টিকুলের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন; এটি বেলায়তি ক্ষমতার প্রয়োগ, অলৌকিকতাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দ্বারা বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। হজরতকেবলা পরবর্তী প্রজন্মকে সুযোগ করে দিয়েছেন বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। যেটি অন্য কোনো তরিকায় লক্ষ করা যায় না। এটি হজরতের অপরিসীম উদারতার বহিঃপ্রকাশ।
৭. তিনি আধ্যাত্মিকতায় নিহিত বিজ্ঞানকে জানার পথকে উন্মুক্ত করেছেন। আউলিয়াদের অলৌকিক ঘটনা, রহস্যপূর্ণ কালাম, ভাবভঙ্গির মধ্যে অসংখ্য হেকমত, বিজ্ঞান নিহিত। তারা এ সকল কর্মকাণ্ড জগৎবাসীর নিকট পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করেন; যাতে ভক্ত-শিষ্যগণ চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত, গবেষণামুখী মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারেন। তরিকতজগতে চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত এবং গবেষণামুখী মানসিকতার সৃষ্টি করতে না পারলে সেই চর্চার কোনো মূল্য নেই। হজরতকেবলা যুগপৎ পরিবর্তনে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আধ্যাত্মিকজ্ঞানে নিহিত বিজ্ঞানকে জেনে বিশ্বমানবতার কল্যাণের তাগিদ দিয়েছেন।
৮. তিনি ধর্ম পরিবর্তন এবং ধর্মের আচারিকতাকে গুরুত্ব না দিয়ে নৈতিকধর্মকে প্রাধান্য দিয়েছেন। একদা বৌদ্ধধর্মানুসারী ধনঞ্জয় বড়ুয়া নামক ভক্ত ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে হজরত বলেছেন, ‘ধনঞ্জয় তুমি তোমার ধর্মে থাকো। আমি তোমাকে মুসলমান করে নিয়েছি‘। অর্থাৎ বেলায়তে মোতলাকার যুগে ধর্ম পরিবর্তনের চেয়ে নৈতিকতা ধারণই মুখ্য। সবধর্মই নৈতিকতার কথা বলে। কোনোধর্মই কখনো অনৈতিকতাকে সমর্থন করে না। নৈতিকতার চর্চা সম্পর্কে সনাতন ধর্মানুসারিকে বলেছেন, ‘আমি বার মাস রোজা রাখি, আপনিও রোজা রাখিয়েন‘। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের স্বরূপ উন্মোচনকারী হজরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) এই মর্মকথার ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘ সারা বছর পাপমুক্ত থাকা‘। অর্থাৎ -ধর্মান্তরিত নয় বরং সারা বছর পাপমুক্ত থাকার অনুশীলনই মুখ্য।
৯. হজরতকেবলা প্রচলিত হাতে হাত রেখে বাইয়াত প্রথাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রেম-ভক্তি সহকারে স্মরণকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। হজরতের স্পষ্ট ঘোষণা, ‘সুদূর ইয়েমেন থেকে আমাকে স্মরণ করলে সে আমার নিকটে। আর আমার নিকটে থেকেও স্মরণ থেকে বিচ্যুতি হলে সে আমার থেকে অনেক দূরে‘। শাহানশাহ্ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক (ক.) মাইজভাণ্ডারীও এই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘দরবারে ভক্তি বিশ্বাস নিয়ে যারা আসে সবাই মুরিদ’। তিনি আরো বলেন, ‘বাইয়াত মানে স্মরণ রাখা। স্মরণ রাখা বড় কষ্ট’। হাতে হাত রেখে বাইয়াত হতে হবে (মাইজভাণ্ডারী দর্শনে) এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ভক্তি, বিশ্বাস, প্রেম দিয়ে স্মরণই বাইয়াত।
১০. তিনি সেমাহ- কাওয়ালী, ঢোল-বাদ্যবাজনা সহ নৃত্যের (রকস) মাধ্যমে খোদাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিছু তরিকায় সেমাহ-মাহফিল থাকলেও এসব মাহফিলে (হাল) ভাববিভোরতা উদয় হইলে তা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে হয়। প্রকাশের রেওয়াজ নেই। কিন্তু হজরতকেবলা সেমাহ- কাওয়ালীতে ভাবের উদয় হলে সেই ভাবকে প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছেন। সেমাহ কাওয়ালী, বাদ্যবাজনার তালে একজন পাপিষ্টও মওলার প্রেমে নৃত্য (রকস) করতে করতে অজান্তেই হুঁশ জ্ঞান হারায়। আর ভাববিভোর ইবাদত আল্লাহর খুবই প্রিয়।
১১. হজরতকেবলার সোহবতে অসংখ্য কামেল অলিসহ এমনকি বেলায়তের সর্বোচ্চ ক্ষমতাপ্রাপ্ত অলিও পয়দা হয়েছেন। তাদের কেন্দ্র করে স্বাধীন, স্বকীয় দরবার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখান থেকেও প্রতিনিয়ত পার্থিব অপরিসীম চাওয়া পাওয়া সহ বেলায়তও প্রাপ্ত হচ্ছেন। তিনি এমনই সূর্যশ্রেয় অলি; যার প্রভাবে অসংখ্য স্বকীয় দরবার প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেখান থেকেও জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিনিয়ত দয়া পাচ্ছেন। এটিও তার শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ হজরত হতে সৃষ্ট সকল দরবার সমূহেও হজরতকেবলার নীতি আদর্শ সমূহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
মাইজভাণ্ডারী দর্শনের গভীরতা মহাসাগরের চেয়েও গভীর। তীরে দাঁড়িয়ে যেমন মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় করা যায় না; তদ্রূপ মাইজভাণ্ডার না গিয়ে এ দর্শনের গভীরতা বোঝা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন অনুভূতি, উপলব্ধি। এসম্পর্কে বেলায়তে ওজমার অধিকারী শাহানশাহ্ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক (ক.) মাইজভাণ্ডারী বলেছেন, ‘Maizbhandar is an Ocean. Don't think otherwise’। এটি আলোকিত মানবসহ আউলিয়া তৈরির কারখানা। এটি এমন পবিত্রময় স্থান, যেখানে আউলিয়াগণ প্রতিনিয়ত নৃত্যেরত থাকেন। এর মর্যাদা সম্পর্কে মতিভাণ্ডার দরবার শরিফের মহানসুফি হজরত মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্ (ক.) ফরহাদাবাদীর আধ্যাত্মিক বাগানের উজ্জ্বল নক্ষত্র (বেলায়েতপ্রাপ্ত) সুফি হজরত মওলানা আবুল ফয়েজ শাহ্ (রহ.) বলেন, ‘মাইজভাণ্ডার শরিফের দিকে তাকিয়ে থাকাটাও ইবাদত‘। হজরত কেবলার এসব শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণের কারণে সমসাময়িক আউলিয়ারা তাকে ‘ফরদুল আফরাদ অলি’ হিসেবে সম্বোধন করতেন।
হজরতের সোহবতে অগণিত ভক্ত জাগতিক মুক্তি যেমন নিশ্চিত করেছেন, তদ্রুপ আধ্যাত্মিক ফয়েজপ্রাপ্ত হয়ে নাকেসবান্দাসহ অসংখ্য ব্যক্তি কামালিয়তও অর্জন করেন। এমনকি বেলায়তের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীও হয়েছেন। বেলায়তের ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ গড়াই ছিল হজরতের লক্ষ্য।
যুগশ্রেষ্ঠ এই মহানসুফি ৭৯ বছর বয়সে ১০ মাঘ ১৩১৩ বাংলা মোতাবেক ২৭ জ্বিলকদ হিজরী ১৩২৩ সন, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ সোমবার দিবাগত রাত ১টার সময় বিশ্ববাসীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে মহান আল্লাহর সঙ্গে মহামিলনে গমন করেন। তার পবিত্র ওফাত বার্ষিকী স্মরণে প্রতিবছর ১০ মাঘ মাইজভাণ্ডার শরিফে লাখ লাখ আশেকসহ অলি-আল্লাহদেরও মিলনমেলা (ধর্মীয় সমাবেশ) ঘটে। হজরতের জীবদ্দশায় যেভাবে বিশ্ববাসী পার্থিব ও অপার্থিব সহ সকল প্রকার দয়াপ্রাপ্ত হয়েছেন; তেমনিভাবে ওফাতপরবর্তীও সমভাবে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক দয়া পেয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে কেউ সাহায্য প্রার্থনা করবে, আমি তাকে উন্মুক্ত সাহায্য করিব‘। এবং হজরতের গাউসিয়তের এ নীতি হাশর পর্যন্ত জারি থাকিবে, এটিও তার স্পষ্ট ঘোষণা। হজরতের ওফাত দিবস আশেকের মিলনমেলা সম্পর্কে মোহাম্মদ আইয়ুব আলী (রহ.) লিখেছেন- ‘হজব্রত নিরাপদ নগরে যেমন, মাঘের দশে তব দ্বারে মহাসম্মিলন’।
হজরতকেবলার পবিত্র চরণে জানাই মস্তক অবনতচিত্তে তাজিম। মহান ১০ মাঘ হজরতকেবলার ১১৯ তম পবিত্র বার্ষিক ওরশ শরিফ উপলক্ষ্যে আগত সকল ভক্তদের জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ ও সালাম। হজরতের ওরশ উপলক্ষ্যে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অসীম রহমত সকলের উপর বর্ষিত হোক। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
আজকালের খবর/আরইউ