চাটুকারিতা, মোসাহেবী, চামচামি করা আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ব্যধি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তোষামোদি নিয়ে ‘সাহেব ও মোসাহেব’ নামে অসাধারণ এক কবিতা লিখেছেন। এতোদিন পরও আমাদের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক জীবনে এই কাব্যটির প্রতিটি পঙ্ক্তি তেলবাজি আর চাটুকারিতাকে কটাক্ষ করছে।
এখনো মোসাহেবরা সুযোগ সুবিধা এবং ভাগ বাটোয়ারা লাভ করতে তেলবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কেউ পদ-পদবীর আশার আবার কেউবা চাকরিতে সুবিধা লাভের প্রত্যাশায় এমন হীন কর্মে লিপ্ত।
২০২৩ সালের দিকের ঘটনা। রাজধানী ঢাকা-৭ আসনের একজন আলোচিত সংসদ সদস্যের পুত্রবধূ এলাকায় ভোট চাইতে আসলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় উপস্থাপক পুত্রবধূর নাম প্রস্তাব করলেন ঠিক এই ভাবে- ‘এখন সেই কাক্সিক্ষত মহেন্দ্রক্ষণ, যার বক্তব্য শোনার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এ পর্যায়ে বক্তব্য দেবেন মাননীয় সংসদ সদষ্য মা, মাটি ও মানুষের নেতা হাজী ...র বৌমা এবং তার মেজ ছেলে...নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জনাব ...র সহধর্মীনী এবং নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য জনাব ... চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার... চৌধুরী .... লিম’।
আমজনতা এধরনের তেলবাজি দেখতে দেখতে ত্যাক্ত বিরক্ত। এদেও কেই কেউ তেলবাজিটা দারুনভাবে রপ্ত করেছেন। চাটুকারিতা আর মোসাহেবী যেন এদের কারো কারো যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি। ২০১৭ সালে প্রকাশিত লেখকের ‘ছড়াটিম ছড়াটুম’ বইয়ের একটি ছড়া এখানে প্রাসঙ্গিক। ছড়াটি ছিলো- ‘হাতি নেতা পাতি নেতা ভুড়ি ভুড়ি পাড়াতে/সু-সময়ে ব্যস্ত ভীষণ শুধুই তেল মারাতে,/ঝোপ বোঝে কোপ মারে পকেটটা ভরাতে/গলাবাজি অবিরাম চামচামি করাতে,/যখন যেমন ইচ্ছে করে জনতাকে জ্বালাতে/দুঃসময়ে হায় হায় লেজ গুটিয়ে পালাতে।’
দেশের সর্বত্র আনাচে কানাচে বিভিন্ন পোস্টার ফেস্টুন কিংবা ব্যানারে চোখে পড়ে, এধরনের চাটুকারিতার ডিজিটাল প্রিন্টেড ভারসন; যা সচেতন জনতার কাছে হাসির খোরাক জোগায়।
বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরতো চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে মঞ্চ ভেঙে পড়েই গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি ক্ষোভের সুরে তার চারপাশের চাটুকারদেও উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘যেখানেই যাই মঞ্চে কেবল নেতাই নেতা, কর্মী নেই, এমন নেতা আমার দরকার নেই, কর্মীর দরকার।’
মোসাহেবী করে রাজনীতিতে অনেকেই বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। ভৃত্য থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। মাস্তান থেকে জননেতা হয়েছেন। পতিত প্রধানমন্ত্রীর পানি বহনকারী ব্যক্তি হয়েছেন চারশ কোটি টাকার মালিক; যা তৎকালীন সরকার প্রধান নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন।
প্রশাসনেও চাটুকারিতার এমন ধারা বিদ্যমান। অধীনস্তরা তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সর্বদা তোয়াজ করে চলেন। আর তারা যদি মহাপরিচালক, সচিব কিংবা চেয়ারম্যান পদমর্যাদার হন, তবে তো কথাই নেই। তিনি তস্কর হোন আর প্রবঞ্চকই হোন, অধীনস্তরা তাদেরকে তোয়াজ করতে করতে এক প্রকার হয়রান। মহাশয়, মহোদয়, মহামান্য সম্বোধন ছাড়া কথাই নেই। চাটুকাররা তাদেরকে বানিয়ে ফেলেন মহামানব। আর মহামানবরা নিমজ্জিত হন মহা দুর্নীতিতে, চারশ টাকার বালিশ হয়ে যায় চল্লিশ হাজার টাকা।
৮ এপ্রিল ২০২৩ সালে পঞ্চগড়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের উদ্বোধন উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসনে এমন ঘটনা লক্ষ্যণীয়। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালটির উদ্দ্যোক্তা এইচ এম জাহাঙ্গীর আলম রানা এই লেখকের অতি ঘনিষ্ঠ অনুজ বন্ধু।
তার আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানের দুই দিন আগে লেখক সেখানে যান। দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ে এর আগে এমন আয়োজন হয়নি। সরকারের মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসবেন। তাই স্থানীয় প্রশাসন খুবই তৎপর। জেলা প্রশাসন অনুষ্ঠানের খোঁজ-খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও তৎপর হয়ে ওঠেন। সরকারের মন্ত্রী ও বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ পঞ্চগড়ে আসবেন বলে স্থানীয় প্রশাসনের দৌড়-ঝাপ শুরু হয়ে যায়। তবে পঞ্চগড়ের মতো স্থানে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক একটি হাসপাতাল হতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। যতটা না চোখে পড়েছে ভিআইপিদের আগমনকে কেন্দ্র করে। উদ্বোধনের আগের দিন পঞ্চগড় সদর উপজেলার ইউএনও সাহেব উদ্দ্যোক্তা রানার সঙ্গে বসলেন। উদ্বোধনী দিনের অনুষ্ঠানসূচী নিয়ে জেলা প্রশাসনের মতামত রানাকে অবহিত করলেন। জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার মঞ্চে কোথায় বসবেন। কখন বক্তব্য রাখবেন এসব বিষয়াদি রানাকে জানালেন।
এক পর্যায়ে ইউএনও সাহেব সামাজিক মাধ্যমের একটি সংবাদ দেখিয়ে রানাকে বললেন, এই ব্যাপারটি ম্যানেজ করেন। ব্যাপারটি ছিলো স্থানীয় হাসপাতালের কিছু জমি নিয়ে তাদের আপত্তির কথা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন ভালো করেই জানেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জন্য ক্রয়কৃত ৩২ একর জমি পুরোটাই যথাযথভাবে ক্রয় করা। তাই সংবাদ সম্মেলনকারী কতিপয় ব্যক্তির অভিযোগ ভিত্তিহীন। ওই অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসনের উচিত উদ্দ্যোক্তা রানাকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করা। তাই এক পর্যায়ে ইউএনও সাহেবকে বলা হলো ব্যাপারটি আপনাদের সমাধান করা উচিৎ। স্থানীয় প্রশাসনের মনোভাব এমন ছিলো যে এসব ব্যাপারে তাদের কোনো দ্বায়িত্ব নেই। উদ্দ্যোক্তা রানাকেই সকল বিষয় সমাধান করতে হবে। তাদের কাজ কেবল আমন্ত্রিত মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য পর্যায়ের ব্যক্তিদের খোঁজ-খবর নেওয়া. তাদের সন্তুষ্টি সাধন করা। উদ্যোক্তা রানা যেন এমন বিশাল উদ্দ্যোগ নিয়ে ঠেকায় পড়েছেন। রমজান মাসে অনুষ্ঠিত ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের খাবার-দাবার আয়োজন নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের সন্তুষ্টি সাধনই যেনো জেলা প্রশাসনের একমাত্র ব্রত।
ওই দিনের অনুষ্ঠানে নিজের প্রটোকল নিয়ে সর্বাধিক সোচ্চার ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার। মঞ্চে তার বসার স্থান এবং বক্তব্য দেওয়ার ক্রম নিয়ে ছাড় দিতে তিনি মোটেই রাজী নন। প্রয়োজনে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত একজন অতিরিক্ত আইজিকে হেয় করতেও তার দ্বিধা হয়নি। এর অবশ্য কারণ ছিলো আমন্ত্রিত অতিরিক্ত আইজি তার রেঞ্জের উপরস্থ কোনো কর্তা ছিলেন না। অন্য রেঞ্জের কর্মকর্তা হওয়ায় একজন পুলিশ সুপার অতিরিক্ত আইজিকে সম্মান জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। বক্তৃতাকালে পুলিশ সুপার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দ্যোগ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। তিনি তৎকালীন সরকারের গুনগান গেয়ে বক্তব্য শেষ করেছেন। তার বক্তব্য ছিলো জেলা পর্যায়ের শাসক দলের নেতাদের চেয়েও বেশী দলীয় আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ। বরং সেখানে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সম্রাট তার বক্তৃতায় পঞ্চগড়ে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এমন ঘটনা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে হর হামেশাই দেখা যায়।
গত ১৫ বছর ধরে লেখক থাকেন রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকায়। সেখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের আবাস। একটি থানা, দুটি মসজিদ এবং কল্যাণ সমিতির কার্যালয় এলাকাটিতে রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সেখানে বসবাস করেন। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবি যেমন রয়েছে তেমনি বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পুলিশ, শিক্ষক ইত্যাদি পেশার লোকজনত্ত সেখানে বসবাস করেন।
বাসিন্দারা যে পেশারই হোন না কেন স্থানীয় কল্যাণ সমিতিরি কর্তাদের কাছে স্থানীয় এমপি, কাউন্সিলর, থানার ওসি পর্যায়ের ব্যক্তিরা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে তোয়াজ করা ছিলো সমিতির মূখ্য বিষয়। ২০১৯ সালের কোনো এক জুমার দিনের ঘটনা। রূপনগর থানায় বদলী হয়ে নতুন ওসি এসেছেন। তাই জুমার নামাজের সময় তিনি এলাকাবাসীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা পোষন করেছেন। খুৎবা পাঠের পূর্ব মুহূর্তে সমিতির প্রধান কর্তা সকল মুসল্লীকে ডিঙ্গিয়ে ওসি সাহেবকে একেবারে সামনের কাতারে ইমাম সাহেবের পেছনে এনে বসালেন। কিছুক্ষণ পর ওসি সাহেব লক্ষ্য করলেন সামনের কাতারে পুলিশের একজন বড় কর্তা (যিনি ডিআইজি পদমর্যাদার) বসে আছেন। যাই হোক সুন্নাত আদায়ের পর মুসুল্লীরা খুৎবা শোনার জন্য প্রস্তুত। তখন সমিতির ওই কর্তা মাইকে ঘোষণা দিলেনÑ এখন থানার ওসি মহোদয় আপনাদের সামনে বয়ান দিবেন। উপস্থিত মুসল্লীরা এধরনের ঘোষণায় বিরক্ত হলেও মুখ বুঝে সহ্য করতেন। ওসি সাহেব বক্তব্য দিতে ওঠে পরিস্থিতি খানিকটা আঁচ করতে পেরেছেন তার ওপর তার নাকের ডগায় ডিআইজি সাহেব বসে আছেন। এহেন পরিস্থিতিতে ওসি সাহেব বললেন, ‘আমার সামনে ডিআইজি স্যার আছেন, তিনি এই এলাকার বাসিন্দা, তাই এখানে আমার বলার তেমন কিছু নেই ডিআইজি স্যার আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দিবেন আমি সে মোতাবেক কাজ করবো।’ ওসি সাহেব তার অবস্থান ও পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেও স্থানীয় সমিতির কর্তাব্যক্তি কার কী অবস্থান, তা উপলব্ধি করতে অক্ষম। তার কাছে কাউন্সিলর, ওসিরাই বাপ-মা। আসলে আমাদের সমাজের চিত্র কর্মবেশী এমনই। চামচামি, মোসাহেবী কিছু লোকের মজ্জাগত সমস্যা।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শত বছর পূর্বেই চাটুকারিতা ও মোসাহেবগিরি যেমন দেখেছেন ঠিক তেমনি শত বছর পরও ‘জেন জি’ প্রজন্মও চামচামি আর তেলবাজির চূড়ান্ত নমুনা দেখেছে। তাই ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তারা এঁকেছে হাজারো গ্রাফিতি। কাঁচা হাতে আঁকা গ্রাফিতিগুলোতে ফুটে ওঠেছে তাদের মনের একান্ত কথামালা। তাদের আনন্দ, বেদনা, ক্ষোভ, আক্ষেপ দিয়ে এঁকেছে অসংখ্য গ্রাফিতি। তারা লিখেছে ‘খেটে বড় হও, চেটে নয়’। শত বছর পূর্বে কবি নজরুলের ‘সাহেব ও মোসাহেব’ কবিতায় মর্মকথার সঙ্গে যা পুরোই মিলে যায়। রাজধানীর রোকেয়া সরণির মেট্রেরেলের ৩৩১ নাম্বার পিলারে এমন উক্তি সম্বলিত গ্রাফিতি দেখা গেছে। মোদ্দা কথা, চাটুকারদের ব্যক্তিত্ব নেই। তারা পরগাছার মতো জীবন যাপন করে। আর মোসাহেবরা এই সুযোগে লুটে পুটে খায়। অর্থনীতির বারোটা বাজায়। বাংলাদেশ স্কাউটের মতো সংগঠনগুলো তাদের সদস্যদের খাটতে শেখায়, আত্মনির্ভরশীল হতে শেখায়, পরিশ্রম করে বড় হতে শেখায়।
মোসাহেবী ও চাটুকারিতা পরিহার কওে জেনারেশন ‘জেন জি’, তাদের উত্তরসূরী জেনারেশন ‘জেন আলফা’ এবং সদ্যজাত জেনারেশন ‘জেন বেটা’ আগামী দিনগুলোতে আত্মনির্ভরশীল হবে, আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা।
আজকালের খবর/আরইউ