
‘পয়সার সঙ্গে সঙ্গে রুচি বলে একটি বস্তু নাকি চলে আসে। ডাহা মিথ্যা কথা, এই জিনিসটি সঙ্গে নিয়ে জন্মাতে হয়।’ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এই কথার সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত নন, তবে এই কথার সঙ্গে একমত বা সহমত পোষণ করবেন যারা তারাই সংখ্যায় বেশি হবেন সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কারণ রুচি পয়সা দিয়ে কেনার বস্তু নয়। পয়সা হলেই যে মানুষের রুচির পরিবর্তন হবে তা কিন্তু নয়। কারণ ‘রুচি’ খুবই ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। গরিবেরও রুচি আছে। গরিবের রুচি মানে নিম্নরুচি নয়, সে রুচিতে আছে সরলতা আছে স্নিগ্ধতা। ইদানিং ‘রুচি’ এবং ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দ দুটি নিয়ে আমার চিন্তার জগত কেবলই সরব হচ্ছে। এদেশে এখন খাদ্যের দুর্ভিক্ষ নেই। দুর্ভিক্ষ আছে রুচির। সহজে ভিক্ষা মিলে না যে অবস্থায়, তা যদি হয় দুর্ভিক্ষ তাহলে সে অবস্থা এখন আমাদের দেশে নেই। তবে যে চরম রুচির দুর্ভিক্ষে ভোগছে আমাদের এই সময়, এই প্রজন্ম তা কেবল আমাদের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের পথই প্রসারিত করছে। আমাদের ধর্মীয় কালচার দেশীয় কালচার সবই আজ হুমকির মুখোমুখি।
বাংলা অভিধানে রুচি শব্দের মানে হচ্ছে শোভা, দীপ্তি, পছন্দ, মার্জিত বুদ্ধি বা প্রবৃত্তি, স্পৃহা, ইচ্ছা ইত্যাদি। এখানে অনেকগুলো অর্থ আছে। কিন্তু রুচি নিয়ে প্রথম যেই ভাবনাটি মাথায় আসে তা হচ্ছে সুন্দর কিছু, ভালো কিছু, গ্রহণযোগ্য কিছু অর্থাৎ পজিটিভ কিছু। আজকাল আমরা যে রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি তা কেবল কুৎসিত ভবিষ্যতেরই ইংগিত দেয়। নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ কিছুদিন আগে এই কথা বলে কারো কারো কাছে তুলোধুনো হয়েছেন আবার কেউ কেউ তার সঙ্গে সহমতও পোষণ করেছেন।
আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটি লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান। এই কথাগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না। রুচির দুর্ভিক্ষের প্রতীক হিসেবে হিরো আলমের নাম নেওয়ায় আপনি হয়তো মামুনুর রশীদের মুণ্ডপাত করতে পারেন আবার তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আপনি হিরো আলমের মতো এমন শখানেক ফেসবুক আবর্জনাকে কথার তীর দিয়ে বিদ্ধ করতে পারেন। এটি আপনার রুচির বহিঃপ্রকাশ। হ্যা, আমরা জানি মানুষ হিসেবে সবার ব্যক্তিগত রুচি বা অরুচি আছে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের প্রাত্যহিক সময়ের সঙ্গে সেই অরুচি, কুরুচি মিশে একেবারে খিচুড়ি সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতি হয়ে যায়। হিরো আলম যাদের রুচিতে আছে তাদেরও একটা বিরাট শ্রেণি আছে। তারাই হিরো আলমকে তৈরি করেছেন এবং তারাই বাঁচিয়ে রাখবেন।
এই যে রুচির দুর্ভিক্ষের দুর্গন্ধ আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত চলে আসছে আর আমরা নাকমুখ বন্ধ করেও এই দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পাচ্ছি না তার দায় কার? আমাদের সকলের। পরিবার থেকে রাষ্ট্র আমরা সকলেই এর জন্য দায়ী। সহজ যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু সস্তা সংবাদ মাধ্যম তাদের ভিউ বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আপনি দেখতে, শুনতে না চাইলেও আপনার মুঠোফোন আপনাকে এক মুঠো দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে যাবে। আর এভাবেই ফেসবুক নামের এই জায়গাটি কলুষিত হচ্ছে। আসলে দুর্ভিক্ষ কীসে? রুচির দুর্ভিক্ষ নাকি সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ? ব্যক্তিগত রুচির অধপতনই আমাদের সংস্কৃতির চেহারাটি একটু একটু করে ভয়ংকর রকমের কুৎসিত করে দিচ্ছে। স্কুল গোয়িং বাচ্চারাও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। ঘরে বসে ইউটিউব দিয়ে আয় হয় বলে অনেকেই দেদারসে ঝাপিয়ে পরছে সাত-পাঁচ না ভেবেই।
নাটক সিনেমায় চলছে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। অবলীলায় গালাগালি করে ভাষাকে উলঙ্গ করে ছেড়ে দিচ্ছে বিভিন্ন নাটক সিনেমায়। ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নামে এক নাটকে তরুণ প্রজন্মকে যেভাবে রিপ্রেজেন্ট করা হচ্ছে তা মোটেও কাম্য নয়। শিল্প আমাদের ভালো কিছু দেখাবে শিখাবে সেটিই স্বাভাবিক। তা না করে সেখানে কিছু বখাটেপনা দেখানো হচ্ছে আর তরুণ প্রজন্ম রিসোর্টে মেয়ে নিয়ে রাত কাটানো, কথায় কথায় স্ল্যাং ব্যবহার করাকে সময়ের ফ্যাশন হিসেবে লুফে নিচ্ছে। কী প্রচণ্ড রকম অসুস্থ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আমাদের সামনে। যতটুকু না সিনেমা, নাটক বা শিল্প নিয়ে কথা হয় তার চেয়ে হাজারগুন বেশি কথা হয় তথাকথিত কিছু নায়ক নায়িকার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। ধুমধাম করে কারো বিয়ে হচ্ছে আবার কিছুদিন পর ঢাকঢোল পিটিয়ে ডিভোর্স হচ্ছে। উলঙ্গ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে কেউ কেউ। বিউটি উইথ ব্রেইন বিশ্বাস করতে নারাজ। নারীর দক্ষতা কি কেবল শরীরসর্বস্ব? কি আশ্চর্য রকমের অসুস্থতা! এই অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে রেহায় পায়নি আমাদের প্রাণের বইমেলাও। সেখানেও অপসংস্কৃতির ছড়াছড়ি। ভালো লেখকদের হাইলাইট না করে অখাদ্য-কুখাদ্য নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো ব্যস্ত ছিল ভিউ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। আমাদের সাংস্কৃতিক রুচিবোধকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা?
এই কিছুদিন আগেও দুর্ভিক্ষ বলতে বুঝতাম শুধু খাদ্যাভাব। সাধারণত ফসলহানি, যুদ্ধ, সরকারের নীতিগত ব্যর্থতার এক প্রতিচ্ছবি। দুর্ভিক্ষ বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠতো এক বিধ্বস্ত পৃথিবী, খাদ্যের জন্য হাহাকার, ভিক্ষার অভাব ইত্যাদি। কিন্তু এখন অনুধাবন করতে পারি দুর্ভিক্ষের আসলে অনেক রূপ আছে। রুচির চরম দুর্ভিক্ষে এখন আমাদের অবস্থান। জয়নুল আবেদিন ক্ষুধার দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে গেছেন কিন্তু বলে গেছেন কঠিন সত্য, ‘এখনতো চারদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ। একটি স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।’
কী অদ্ভুত ভবিষ্যৎ বাণী। আর কী প্রচণ্ড রকমভাবে আমরা তা অনুধাবন করছি।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ