শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব: জ্বেলছিলেন প্রাণের প্রদীপ
এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩, ৭:৪৩ পিএম
বাঙালি যোগসাধক ও ধর্মগুরু ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামের শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব   মানুষের মাঝে জ্বেলছিলেন প্রাণের প্রদীপ। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের যখন  আবির্ভাব ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই সময়টা ছিল  বড় বিভ্রান্তির। কতিপয় অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি অশিক্ষা এবং সামাজিক বিভেদের সুযোগে তখন হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত ‘ত্রাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ। বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ চর্চা চুলোয় গিয়েছে। ওই সমাজপতিদের দৌড় ছিল পাঁজি পর্যন্ত। পাণ্ডিত্য, পরমতসহিষ্ণুতা, হৃদয়ের ঔদার্য- এই গুণগুলোর কোনোটাই ছিল না তাদের।

চরম অরাজকতা ও নৈরাজ্যের এমন পরিবেশেই হুগলির হদ্দ গাঁয়ের এক যুবক মহানগরী কলকাতায়  এসে কিন্তু বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বাঙালি হৃদয়ে যার নাম শ্রীরামকৃষ্ণ।

১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। তিনি তার পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ এবং শেষ সন্তান ছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জন্মের আগে থেকেই তার মাতা পিতা বিভিন্ন ধরনের অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ দেবের জন্মের কিছুদিন আগেই গদাধর বিষ্ণু রামকৃষ্ণ দেবের পিতাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়েছিলেন এবং এই করণের জন্যই রামকৃষ্ণ দেবের মাতা পিতা তাকে গদাধর নাম দিয়েছিলেন। গ্রাম বাসীরা তাকে ভালোবেসে গদাই বলে ডাকতেন। ছোট বেলা থেকেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব পাঠশালার তথাকথিত পড়াশোনাকে পছন্দ করতেন না। তবে তিনি গান বাজনা, কথকতা ও যাত্রাভিনয়ে পারদর্শি ছিলেন।

দাদাকে কলকাতায় পৌরোহিত্যে সাহায্য করার জন্য রামকৃষ্ণ দেব ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় চলে আসেন। রামকৃষ্ণ দেবের কলকাতায় আসার কয়েক বছর পরেই এক প্রসিদ্ধ জমিদার পত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর একটি কালীমন্দির স্থাপন করেন এবং এই মন্দিরের পৌরোহিত্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় শ্রী রামকৃষ্ণের দাদা রামকুমারকে। দাদা রামকুমারের সঙ্গে শ্রী রামকৃষ্ণ দেবও এই মন্দিরে পৌরোহিত্য শুরু করেন দেন। বছরখানেক পর রামকুমার মারা যান এবং কালীবাড়ির পৌরোহিত্যের দায়িত্ব চলে আসে শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের ওপর। তিনি এই মন্দিরে বেশিরভাগ সময়ই মা কালীর সাধনাতে মেতে থাকতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ছিল তিনটি মূলমন্ত্র। অকপট সত্যানুরাগ, নিপীড়িত মানুষের প্রতি অকৃপণ প্রেম এবং যুক্তিবাদে আস্থা। সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় অসঙ্গতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে  জ্বেলেছিলেন প্রাণের প্রদীপ। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ধর্ম কখনোই আচারসর্বস্ব ছিল না। পরম ঔদার্যে তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন ধর্মে ধর্মে বিভেদের অনাকাক্সিক্ষত দেয়াল। সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তাই তিনিই বলতে পেরেছিলেন ‘যত মত তত পথ’। এ জন্যই বর্তমানের অস্থির প্রহরে দাঁড়িয়েও শ্রীরামকৃষ্ণচর্চায় মেলে মুক্তির পথ। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সর্বস্তরের মানুষের কাছে সে দিন ধর্ম-ধর্মজীবন-ধর্মাচরণের নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। সুস্থিত জীবনের লক্ষ্যে যা হয়ে উঠেছিল উত্তরণের পথ। দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পূজারি ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্ম সাধনায় নিমগ্ন হয়ে গভীর উপলব্ধি নিয়ে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন ধারা-উপধারার ধর্মচর্চায় ডুব দিয়ে একাধারে সমন্বিত ভাবনা থেকেই উচ্চারণ করেছিলেন গড, আল্লাহ্, ভগবান একই সত্যের পারস্পরিক প্রকাশ।

বেদান্ত ধর্মে  শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বভূতে, সর্বজীবে, সর্বস্তরে ‘ভূমা’ অর্থাৎ বৃহৎ  ‘ব্রহ্ম’র উপস্থিতি অনুভব করেছেন। তাই তার কণ্ঠে বিশ্ব শুনেছে, জীবে দয়া নয়, জীবসেবার আহ্বান। ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ এবং সেই সঙ্গে ‘মাটির প্রতিমায় যদি পুজা  হয়, তবে জীবন্ত মানুষে কেন হবে না?’ সকল ক্ষেত্রেই মানুষের অনিবার উপস্থিতিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি উদার মানসিকতা ও সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মকে যুক্ত করেছিলেন কর্মের সঙ্গে। ধর্মকে বর্ম রূপে ব্যবহার করেননি। ধর্মকে সমাজের দায় বহন করতে হয়, বিধবার অশ্রুমোচন করতে হয়, নিরক্ষরকে সাক্ষর করতে হয়, আর্ত-পীড়িতের সেবা করতে হয়। এই অনুভব থেকেই তিনি নিজের হাতে মানুষের সেবা-ত্রাণকাজের সূচনা করেছিলেন, যা সেই শিবজ্ঞানে জীবসেবারই সমতুল। মথুরবাবুর সঙ্গে কাশী যাবার পথে দেওঘরে, রাসমণির জমিদারির অন্তর্গত প্রথমে খুলনা জেলার সাতক্ষীরায়, পরে নদিয়ার কলাইঘাটায় দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের মধ্যে সেই সেবাকাজ প্রত্যক্ষ করা যায়। তার নির্দেশে এই সেবাকাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭-এ প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন। আর ১৮৬৬’তে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক নবজাগরণে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা। অজ্ঞান-অচেতন মানুষের চৈতন্য হোক, পূর্ণমাত্রায় সচেতনা আসুক— এই ছিল তার কাঙ্ক্ষিত।

দীর্ঘ অবহেলিত অত্যাচারিত নারীদের সসম্মানে সমাজে অধিষ্ঠিত করার বিষয়টি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল তার কাছে। প্রাচীন ও নব্য হিন্দু সমাজ নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, গণতান্ত্রিক অধিকারকে সেই সময় প্রবল ভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন; ব্রাহ্মসমাজ নারীর শিক্ষা, নারীর আত্মপ্রকাশ স্বীকার করলেও এ বিষয়ে প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন সাগরপারের সাহেবরাই, এবং অংশত বিদ্যাসাগরমশাই। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী রূপে উপাসনার মধ্য দিয়ে নারীশক্তির উদ্বোধন, অবহেলার বিপ্রতীপে সম্মানজ্ঞাপন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ভৈরবীর কাছ থেকে তান্ত্রিক সাধনায় দীক্ষা, গৌরীমাকে নারীদের সংগঠিত করার প্রয়াস, নারীর অধিকারকেই সুচিহ্নিত করে। সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি তীব্র অসম্মান-অবিচার-অত্যাচার যখন আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে, তখন আমাদের রামকৃষ্ণ প্রদর্শিত পথে মাতৃভাবের সাধনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার মধ্যে কাক্সিক্ষত সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সমাজ পরিবর্তনের ঋত্বিক রূপে তিনি যুবক-যুবতীদের চিহ্নিত করে যান। যুবজীবনের নিরাবৃত সততা-সারল্য-অকৃত্রিমতাকে গুরুত্ব দিয়েই ‘কাঁচা দুধ’-এর বিশুদ্ধতার সঙ্গে তাদের তুলনা টানেন। এদের নিয়েই তো তার পথ চলা শুরু বৃহত্তর লক্ষ্যে।
১৮৮৫ সালে তিনি গলার ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে যান এবং তাকে কাশীপুরের এক বিরাট বাগানবাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। এখানে তার শিষ্যরা তার দেখাশোনা করতেন। বাগানবাড়িতে থাকার কয়েক মাস পর ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট তিনি দেহ ত্যাগ করেন।

এস ডি সুব্রত : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
মার্কিন শ্রমনীতি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করতে পারে: পররাষ্ট্র সচিব
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা-হয়রানি
একদিনে দশটি পথসভা, উঠান বৈঠক ও একটি জনসভা করেন সাজ্জাদুল হাসান এমপি
নতুন বছরে সুদহার বাড়ছে
শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেই আজকের উন্নত বাংলাদেশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রাজপথের আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: মুরাদ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকায় ইসলামী ব্যাংক
হাইকোর্টের ৫২ বেঞ্চ গঠন করলেন প্রধান বিচারপতি
নতুন বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
ইতিহাসের মহানায়ক: একটি অনন্য প্রকাশনা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft