প্রবীণদের প্রতি সম্মান দেখানো সব সমাজেরই অনুসরণীয় রীতি। আগেকার সমাজে প্রবীণরা বেশ সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রবীণদের ওপর এই শ্রদ্ধা ও সম্মান অক্ষুণ্ন ছিল। বিশেষ করে প্রাচ্য সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য আজও মোটামুটি লক্ষ্য করা যায়। তার পরও কিছু কিছু প্রবীণদের মায়া-মমতায় ঘেরা পরিবারের বাইরে অবস্থান করতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ ক্রমাগত প্রবীণ হচ্ছেন। কার্যত বিশ্বের প্রতিটি দেশ তাদের জনসংখ্যার মধ্যে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা এবং অনুপাত বৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছে। জনসংখ্যার বার্ধক্য একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামাজিক রূপান্তরগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠতে যাচ্ছে, যার প্রভাব শ্রম ও আর্থিক বাজারসহ সমাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রে পড়বে-যেমন আবাসন, পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা, পরিবহন এবং সামাজিক সুরক্ষা। সেইসঙ্গে পারিবারিক কাঠামো এবং আন্তঃপ্রজন্মীয় বন্ধন। প্রবীণ ব্যক্তিদের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে অবদানকারী হিসেবে দেখা হচ্ছে। সুতরাং, তাদের সুরক্ষার জন্য সব স্তরে নীতি ও কর্মসূচি থাকা উচিত মানব জীবনে বার্ধ্যক্য এক চরম বাস্তবতার নাম। ব্যক্তি জীবনে সকলেই পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে বার্ধক্যে উপনিত হয়। জন্ম হলে বাধ্যক্যকে বরণ করে নিতেই হবে। জীবনের একটি সময় এসে কর্মক্ষম মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে, পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে পরিবারের সদস্যের ওপর। কিন্তু সমাজে ও পারিবারিক জীবনে বয়োজ্যেষ্ঠদের কতখানি গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয় সেটিই মূল বিষয়। তবে বাস্তবতা এই যে, যৌবনের বন্দনা গান করা সকল যুগের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
প্রবীণেরা বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ঠিকই কিন্তু অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দ্বারা তারা তাদের পারিপার্শিকতা বিচার করে। শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও তারা অভিজ্ঞতার আলোকে নবীনদের কাছে হতে পারে সঠিক পথে চলার সদুপদেশদানকারী ও সুপরামর্শদাতা। যৌবনদীপ্ত নবীনদের গুরুত্ব দিতে গিয়ে যেন যারা প্রবীণ তাদেরকে অবহেলা না করি। পরিবার, আপনজন ও সমাজের কাছে যেন তারা বোঝাসম না হয়ে পড়ে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যেন তারা নবীনদের দ্বারা উপেক্ষিত না হয়। পরিচিত পৃথিবী ও আপনজনের পরিবর্তে যেন বিষণ্নতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে না হয়। তারা যেন নবীনদের অনুপ্রেরণা হয়ে বৃদ্ধ বয়সেও বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেতে পারে সে চেষ্টাই করতে হবে। মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে, যার ফলে প্রবীণ ব্যক্তিদের বেলায় বেশ কিছু অসুস্থতা প্রায় সবার মধ্যে দেখা দিয়ে থাকে। আর শুধু শারীরিক রোগব্যাধিই নয়, প্রবীণদের সমস্যাটি আসলে বহুমাত্রিক। তারা মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও সমস্যায় জর্জরিত। আসলে একটি মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তার নিজের মধ্যেই কিছু কিছু জিনিস দানা বেধে ওঠে। যেমন- শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, পরনির্ভরশীলতা, অদৃষ্টের ওপর সমর্পণতা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। এগুলোর কারণে মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে নিজেকে অবাঞ্ছিত, পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করেন। অনেক প্রবীণই বিষণ্নতায় ভোগেন। অনেক সময় এমন অযৌক্তিক ও শিশুসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে প্রকাশ পায়, যাকে অনেকেই দ্বিতীয় শৈশব বলে মনে করেন। প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
প্রবীণরা যৌবনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করেছেন। জীবনের এ পর্যায়ে এসে তারা অবহেলিত হবেন, এটি মেনে নেওয়া যায় না। বার্ধক্য মানুষের জীবনে এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যু যেমন অনিবার্য, তেমনি বেঁচে থাকলে প্রত্যেক মানুষকেই বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটির মতো প্রবীণ নাগরিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে আনুমানিক এক থেকে দুই শতাংশ পেনশন সুবিধা ভোগ করে থাকেন। বাকিরা বেঁচে থাকার জন্য হয় নিজস্ব সম্পদ ও সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল নতুবা সন্তানরাই তাদের একমাত্র ভরসা। দেশে খুব কমসংখ্যক প্রবীণই রয়েছেন, যারা নিজের সম্পদ বা সঞ্চয় দিয়ে চলতে পারার মতো সৌভাগ্যবান। বিআইডিএস-এর এক জরিপে দেখা গেছে, গ্রামবাংলায় দুই-তৃতীয়াংশের মতো প্রবীণ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন, যাদের নিজস্ব সহায়-সম্বল বলে তেমন কিছুই নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবারগুলো যৌথ হলেও অভাব ও পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ না থাকার কারণে প্রবীণ বাবা-মায়ের ন্যূনতম ভরণপোষণ করতে না-পারায় প্রবীণ মানুষটি একটি বোঝা হিসেবে প্রতিনিয়ত অবহেলা ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। এমতাবস্থায় অনায়াসে বলা যায়, প্রবীণদের ন্যায্য অধিকার ও বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দারিদ্র্য। পক্ষান্তরে সচ্ছল ও ধনী পরিবারের প্রবীণরা তাদের সন্তানদের সামাজিক উচ্চ পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে বিদেশে পাঠিয়ে একাকী হয়ে পড়েন। জীবনের শেষ সময়ে সন্তানদের কাছে রাখা তো দূরে থাক, পেশাগত জীবনের দোহাই দিয়ে তারা মৃত্যুকালেও প্রবীণ মানুষটির সান্নিধ্য পেতে আগ্রহী হয় না।
শুধু তা-ই নয়, ধনী শ্রেণির অনেক প্রবীণ আছেন, যারা তাদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে পরিবারের মান-সম্মান বজায় রাখতে বাইরে প্রকাশ করতে চান না এবং করেনও না। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই নীরব নির্যাতন থেকে তারা রেহাই পান না। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মও একই ধরনের নেতিবাচক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সৃষ্টি হয় অপসংস্কৃতি আর মূল্যবোধের অবক্ষয়। শেষ বয়সের দেখভালে আমরা সন্তানের আবেগপূর্ণ মমতা আর পারিবারিক সেবা-যত্ন আশা করে চলেছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পরিবার পরিকল্পনার কল্যাণে বর্তমানে আমাদের সন্তানসন্ততির সংখ্যা এক বা দুই-এ নেমে এসেছে। পাশাপাশি, বিশ্বময় অভিবাসন, নারীশিক্ষা ও কর্মসংস্থান ইত্যাদির সুযোগ অবারিত হওয়ার কারণে সন্তানরা এখন মাতাপিতাকে একাকী রেখে দূরে, বহু দূরে চলে যাচ্ছে। আবার, সচ্ছল প্রবীণ বা বয়োবৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে স্বতন্ত্র বাড়িতে একাকী বসবাস করার মতো আয়োজন, নিরাপত্তা ও প্রচলন আমাদের দেশ-সমাজ-সংস্কৃতিতে এখনো গড়ে ওঠেনি। বার্ধক্য স্বস্তিময় করতে হলে প্রবীণ নাগরিকের জন্য প্রয়োজন পেশাদারি চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা, উপযোগী খাদ্য, ওষুধ, পথ্য, শয্যা, বিনোদন, নিরাপত্তা, সমবয়সীদের সরব উপস্থিতি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে উপযুক্ত সবকিছু নিজ বাড়িতে বসে পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ, নিজেদের বাসাবাড়িতে প্রবীণ পিতামাতার দেখভালের জন্য সন্তানসন্ততির সংখ্যা বা উপস্থিতি খুবই কম, সেবাদানকারী মানুষ জোগাড় করাও দুরূহ আর পেশাদার ডাক্তার-নার্স পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে নারী, সংসারহীন, সন্তানহীন, একা, গ্রামীণ ও হতদরিদ্র প্রবীণদের নিরাপদ বসবাস এবং মৌলিক চাহিদার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।
বয়স্ক ভাতার আওতায় বর্তমানে একজন প্রবীণ সরকারিভাবে মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা পেয়ে থাকেন। বাজার মূল্য, স্বাস্থ্যসেবা মূল্য এবং চলমান দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে এই পরিমাণ টাকা একজন সহায়-সম্বলহীন প্রবীণের জীবন ধারণের জন্য কিছুই না। এই অপর্যাপ্ত ভাতাকে অর্থবহ করা যদিও সময়ের দাবি, দুর্যোগকালে ভাতার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় আসলে প্রবীণদের ব্যাপারে আমাদের সমাজ এখনো খুব একটা সংবেদনশীল নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবীণদের নিয়ে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। সে জন্য প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাকে তাদের দোরগোড়ায় নেওয়া উচিত এবং সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যারা নবীন তারা যেন ভুলে না যাই যে, আমাদেরও একদিন এই অবস্থায় উপনীত হতে হবে। আজ যদি আমরা তাদের প্রতি অবহেলা করি, তাহলে আমাদেরও এই রকম অবহেলার শিকার হতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রবীণরা অবহেলিত, উপেক্ষিত, সমাজে ও পরিবারে অনেকের কাছে বোঝাস্বরূপ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সবার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। মনে রাখতে হবে প্রবীণ বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের পরিবারেরই অংশ। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতোই তার সঙ্গে আচরণ করতে হবে। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত সবসময় প্রবীণদের আদর-যত্ন দিয়ে শিশুদের মতো প্রতিপালন করা। তাদের প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। কোনোক্রমেই তাদের মধ্যে যেন এই ধারণা না হয় যে, তারা আমাদের জন্য একটি অতিরিক্ত বোঝা। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধনিবাস বা কেয়ার হোমের ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনে সেরকম ব্যবস্থা আমাদের দেশেও করতে হবে।
তাই বলে অযত্ন অবহেলায়, দায় এড়ানোর জন্য তাদের যেন এসব বৃদ্ধনিবাসে ঠেলে দেওয়া না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। বর্তমান সমাজে বয়স বৈষম্যের শিকার প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষা যেন শুধু মুখে চর্চা নয়, এর কার্যকারীতাও নিশ্চিত করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। প্রবীণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও লব্ধ জ্ঞান ছাড়া নতুন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আধুনিক সমাজে প্রবীণদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রবীণদের সুচিন্তিত পরামর্শ গ্রহণ ও নিরলস পরিশ্রম এবং অবদানকে স্বীকৃতি প্রদানের মধ্য সমাজকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই বার্ধ্যক্যের বিষয়টি হেয় চোখে দেখার মানসিতাও পরিবর্তন করতে হবে। প্রবীণবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের মানসিক, শারীরিক ও পারিপার্শিক বিষয়াবলি তদারকি করাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান প্রবীণদের সুরক্ষা, কল্যাণ ও অধিকার নিশ্চিত করতে বেসরকারি ও সরকারি ও সংশ্লিষ্ট সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরী ভূমিকা পালনও কাম্য। সর্বোপরি, তারা যেন জীবতাবস্থায় মর্যাদার সাথে জীবনধারণে কোনো সমস্যার সম্মুখিন না হয় এটিই সকলের প্রত্যাশা।
রায়হান আহমেদ তপাদার : প্রবাসী, গবেষক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ