অনেক আগে থেকেই মুখে মুখে ছন্দময় কথামালায় ছড়া রচনা করে আসছে মানুষ। গ্রামের মায়েদের নিজ সন্তানদের ঘুমপাড়ানিতে ছিল ছড়ার অবস্থান। তখনকার সময়ে গ্রামে কবিদের পালা হতো। দুইপক্ষ মুখে মুখে রচনা করতেন ছন্দোময় কথার পাল্টাপাল্টি উত্তর এবং তা দিয়েই চলতো যুক্তি তর্ক, একে অপরকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতা। মা দাদিরা শিশুকে ঘুমপাড়ানোর জন্য বলে যেতেন ছন্দোময় পঙ্ক্তি, যা কালক্রমে স্থান পায় ছড়া হিসেবে।
ছড়ার প্রকারভেদ : শিশুরা তাদের খেলার ছলে ছন্দকারে মনের কথা বলার ভাষাকেই ছড়া বলে। কেবল শিশুদের জন্যই নয়, বড়দের ছড়া সমাজ ও রাষ্ট্রকে পথনির্দেশ দিতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে ছড়া দুই ধরনের হয়- ১. সমাজ সচেতনতামূলক ও ২. হাস্যরস্যাত্মক।
সমাজ সচেতনতামূলক ছড়া : সমাজের কোনো প্রকার অসঙ্গতি দেখে ছড়াকারগণ হাতে কলম তোলে নেন তার সুক্ষ্ম প্রতিবাদ হিসেবে। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় সুকুমার রায় ও অন্নদাশঙ্কর রায় তাদের লেখনীর মাধ্যমে নাড়া দিয়ে ছিলেন জনগণের বিবেককে। যেমন-
‘তেলের শিশি ভাংলো বলে/খোকার উপর রাগ কর,/তোমরা যে সব বড় খোকা/দেশটাকে ভাঙ্গলে/তার বেলা?’
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে ভাগ হওয়ায় আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা নিপীড়িত, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, বৈষম্যমূলক আচরণ স্বাধীনতাকামী করে দেয়। তৎকালীন কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মহল তাদের লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবরণের পর তাকে নিয়ে লেখা, সভা সেমিনার বন্ধ ছিলো। তখনো কবি ছড়াকারগণ বসে থাকেননি, তারা গোপনে বের করেছিলেন, ‘এ লাশ রাখবো কোথায়’। পত্রিকাটি বইমেলায় তড়িৎ বিতরণ করে গা ঢাকা দেন লেখকগণ।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় কবি-সাহিত্যিকগণ জনতার মঞ্চ থেকে ছড়া কবিতার মাধ্যমে নাড়া দিয়ে ছিলেন জাতির বিবেককে।
হাস্যরস্যাত্মক ছড়া : পূর্বে রাজারা রাজদরবারে কবি নিয়োগ দিতেন। উনারা দরবার পরিষদবর্গের অন্তর্ভুক্ত থেকে হাসিরস সমন্বিত ছন্দোময় কথামালা দিয়ে দরবার মাতিয়ে রাখতেন।
ছন্দ, তাল মিলে ছড়ার মাঝে একটা মোহ কাজ করে। যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না ছড়াকারগণ। ছড়ায় আছে আদি রস।
ছড়ার বৈশিষ্ট্য : ১. ঘুম পাড়ানোর সময় মায়ের মুখ থেকে ছড়া শোনেনি এমন সন্তান কেউ নেই। শিশুকে ভুলিয়ে রাখা, ঘুমানো, গোসল সহ সব শিশুসঙ্গ জায়গায় গুণ গুণ করে বেরিয়ে আসতো ছন্দোময় ছড়া। এইসব ছড়া হলো শিশুতোষ রচনা। ২. ছড়ায় ঘটনার ধারাবাহিকতা, কাহিনী থাকে না। এতে ছন্দের গুরুত্ব বেশি, অর্থের চেয়ে। ৩. শিশুদের চঞ্চল মনের মতো ছড়ার পংক্তিমালাও এলোমেলা হতে পারে। ছড়া হলো ধ্বনি প্রধান। ৪. ছড়া মুখে মুখে আবৃত্তির মাধ্যমে রচিত হয় বলে এর ভাষা সহজ হয়। ৫. ছড়ায় কোন উপদেশ থাকে না। ৬. ছড়ায় আবেগ বেশি থাকে। ৭. ছড়া তবলার তালে আবৃত্তি করা যায়।
ছড়া লেখার নিয়ম : সব বয়সী মানুষের ভালোলাগা হলো ছড়া। ছড়া লিখতে হলে আগে জানতে হবে ‘ছন্দ’ কি? একটা লেখনীকে শ্রুতিমধুর করতে পঙ্ক্তিতে সুশৃংখল স্বরবিন্যাস করার নামই ছন্দ। ছড়া তবলার সাথে তাল দিয়ে পড়া যায়। ছন্দের কিছু উপকরণ আছে। যেমন- পর্ব, অন্ত্যমিল ও স্বর।
পর্ব : ছড়াতে প্রতিটি পংক্তির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমন- কলার পাতা (এক পর্ব), কেটে এনে (এক পর্ব), মুড়িয়ে বানাই (এক পর্ব), ঘড়ি (অন্ত্যমিল পর্ব-এক পর্ব), মোট- চারপর্ব।
অন্ত্যমিল : ছড়ার একটি পঙ্ক্তির শেষ পর্বের সাথে আরেকটি পংক্তির শেষ পর্বের যে মিল থাকে, তাকেই অন্ত্যমিল বলে। আরে বিশদভাবে বললে অন্ত মানে শেষ, মিল মানে সাদৃশ্য। প্রতিটি লাইনের শেষে মিল রাখার জন্য যে শব্দ প্রয়োগ করা হয়। যেমন- যুক্ত... মুক্ত (সঠিক অন্ত্যমিল)। যুক্ত...অক্ত (অন্ত্যমিল দুর্বল)
তাহলে দাঁড়ালো, যেখানে শেষের শব্দ আগের পংক্তির শব্দের সাথে ছন্দে মিলে, এটাই অন্ত্যমিল।
কবিতা : কবিতা হলো শব্দের মালা। নানা রকমের ভাবনা ঢেলে দিয়ে সাজাতে হয় কবিতার ঢালি। মনের কল্পনা ভাবনা যখন শব্দযোগে সুষমা মণ্ডিত, সুন্দরতম হয়ে ছন্দোময় রূপ লাভ করে, তখন তাকে কবিতা বলে। কবিতা হলো শব্দের বিন্যাস, যার দ্বারা মনের ভাব ও ধারণা সহজে প্রকাশ করা যায়।
কবিতার ভাবকে ঠিক রেখে ছন্দ ছাড়াও লেখা যায়। কিন্তু কবিতার ভাবনার ধারাবাহিকতা ঠিক থাকতে হবে।
কবিতা মানুষের ভেতরের সত্তাকে টেনে বের করে আনে। চলার স্পন্দন জোগায়। তার কল্পনার বহিঃপ্রকাশ মানুষ উজ্জীবিত হয়, নতুনত্বের হাতছানীতে। কবিতা হবে বহুমাত্রিক, ব্যাখ্যাভিত্তিক। কবিতা হলো শব্দের বিন্যাস। কবিতায় থাকবে আবেগ, ব্যাক্তি, স্থান, সত্য, কল্পনা, উদ্দেশ্য ও ভাষা। কবিতায় ধ্যান, চর্চা, আত্মসচেতনা ও নির্দিষ্ট কাঠামো থাকবে।
কবিতার উপাদান : কবিতার উপাদান চারটি। ১. ছন্দ, ২. ভাব বা রস, ৩. উপমা ও ৪. অলংকার।
কবিতার রূপ : ১. পদ্য কবিতা ও ২. গদ্য কবিতা।
কবিতায় ছন্দ : ১. স্বরবৃত্ত ছন্দ, ২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, ৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।
কবিতার বৈশিষ্ট্য : ১. কেবল অন্ত্যমিল থাকলেই কবিতা হয় না। ২. রস, ভাব, ঠিক রেখে ছন্দ ছাড়াও কবিতা লেখা যায়। ২. কবিদের সংবেদনশীল হতে হয়। ৩. কবিতার বাক্যে থাকবে আকাক্সক্ষা, আসক্তি, যোগ্যতা, কল্পনা। ৪. কবিতা লিখতে গিয়ে কবির ভেতরে একটা শব্দের জন্য রক্তক্ষরণ হতে হবে। ৫. কখন সুন্দর, প্রাঞ্জল, গ্রহণীয় একটা কবিতা কবির কলম থেকে বেরিয়ে আসবে, কবি তা জানে না। তাই ধৈর্যশীল হতে হবে।
কবিতার প্রকারভেদ : ১. সাধারণ, ২. ধারা অনুযায়ী, ৩. ছন্দ অনুযায়ী ও ৪. বিষয় অনুযায়ী।
কবিতা লেখার নিয়ম : ছন্দ নিয়ে আলোচনা করলে পাই- ১. অক্ষরবৃত্ত : ক, লম-২ অক্ষর, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতা মূলপর্ব ৮ বা ১০ হয়। ধ, ন, ব, তী- ৪ অক্ষর।
মাত্রাবৃত্ত : কবিতাগুলো মূলপর্ব ৪, ৫, ৬, ৭ মাত্রার হতে পারে।
ছন্দ : শোনতে ভালো লাগে, ধ্বনি বিন্যাস সুশৃংখল, ফলে কাব্যের যে সুন্দরতা প্রকাশ পায়, তাকেই ছন্দ বলে। ছন্দ সবসময় উচ্চারণের সাথে সম্পর্কিত, বানানের সাথে নয়।
মাত্রা : অক্ষর উচ্চারণে প্রয়োজনীয় সময়কে মাত্রা বলে।
যতি ও ছন্দ যতি : যতি মানে বিরতি নেওয়া। যতি দুই রকম : ১. হ্রস্ব যতি, ২. দীর্ঘ যতি।
পর্ব : এক হ্রস্ব যতি থেকে আরেকটা হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলে।
ছড়া ও কবিতার পার্থক্য : ১. কবিতা হৃদয় দিয়ে বুঝে নিতে হয়। ২. ছড়া কোন বিষয়কেন্দ্রীক বা অনেক বিষয়কে নিয়ে তাল মিল করা শব্দের সমাহার। ৩. কবিতা মানুষের মনকে চাঙ্গা করতে হবে। ৪. কবিতা লিখতে লাগবে ছন্দ, অলংকার, অনুভব ও অভিজ্ঞতা। ৫. কবি একজন ভাস্কর। তিনি প্রতিমা নয়, অক্ষরের পাথর ভেঙে ভেঙে কবিতার ভাস্কর্য গড়েন। ৬. গদ্য কবিতার ছন্দ হতে হবে মানুষের পথচলার ছন্দ। সর্বোপরী একজন মহৎ কবিই হলেন একজন স্বপ্ন দ্রষ্টা।
সাহিত্য হলো একটি জাতির দর্পণ। হোক ছড়া কিংবা কবিতা, গল্প, উপন্যাস। সাহিত্যে লুকিয়ে থাকে সমাজ, সময়, কাল, আচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। ছড়া ও কবিতা জেগে থাকবে বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায় হয়ে।
আজকালের খবর/আরইউ