রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি : একটি সমাজ নিরীক্ষা
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ১৩ মে, ২০২৩, ৪:২১ পিএম
সাহিত্যের পূর্ণ অংশ বলতে যদি একটি অবয়ব কল্পনা করা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পুরোটাজুড়েই আছেন। তিনি শুধু বাংলা সাহিতের মাঝে সিমাবদ্ধ নন, তিনি আছেন বিশ^সাহিত্যে। তাই তো তিনি কবিগুরু। কবিগুরু হলেও তার গল্প, উপন্যাস সবকিছুতেই গুরুস্থানেই অবস্থান করছেন। বাকি সকলেই যেন তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। সমাজ, সংস্কার, কুসংস্কার, বাস্তবতা, প্রেম-বিরহ, দ্বন্দ্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব, পারিবারিক ঘাত-প্রতিঘাত, হাস্যরস সব উঠে এসেছে তার কলমে। তার কলমে উঠে এসেছে নির্যাতিত এক কৃষকের কথাও। তিনি ছিলেন জমিদার কিন্তু অন্তরে ছিল সকলের জন্য দয়া। তার কবিতা যেন এক একটি সমাজের চিত্র। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি। কবিতাটির মূল কথাগুলো এতটাই বাস্তব যে আজকের সমাজের সাথে অনায়াসেই মিলিয়ে নেওয়া যায়। কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে- ‘শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই/আর সবই গেছে ঋণে।/বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন? এ জমি লইবো কিনে।’

কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন। আর এখানেই সেই ‘উপেন’ চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছে। এখানে উপেন চরিত্রটি আসলে কে? এটি কি কবির দেখা কোনো নিগৃহীত চরিত্র? যদি তা নাও হয়, তাহলেও উপেন পৃথিবীর ক্ষমতার কাছে সব হারানোদের প্রতিকৃতি। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় কবি উপেন নামক একজন হতদরিদ্র এবং যার সব জমিই ধারকর্জ বা ঋণে খোয়া গেছে তার কাতর উক্তি দিয়ে শুরু করেছেন। বিপরীতে সেই সর্বভোগ মানসিকতার বাবু বা মহাজন হলো আজকের সমাজের ধনীক শোষক শ্রেণির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। যারা সর্বদাই অসহায়ের সম্পদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এখানে একজন জমিদার বা মহাজন যার লোভী নজর উপেন নামক সেই হতভাগ্য মানুষের সামান্য জমির ওপর। এই জমিটুকুই তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন। আর কবির কবিতাটি এমন একটি সমাজ বাস্তবতায় সেই তৎকালীন জমিদার বা মহাজন শ্রেণির সমাজ থেকে আজ অবধি বহমান। তৎকালীন সমাজে বিভেদ ছিল আরও প্রবল। যেখানে মহাজন বা জমিদার অথবা ভূস্বামী শ্রেণির শাসন ও শোষণে দরিদ্র অভুক্ত মানুষের জীবনযাপন করতে হতো। তাদের লোভে ঘর ছাড়তে হয়েছে অসহায় বহু মানুষকে। জমিদারের সামনে হাতজোড় করে ভিক্ষা চাওয়াই ছিল এক ধরনের রীতি। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়ানোর সাহস সচরাচর কেউ দেখাতো না। সেখানে উপেনের করুণ আর্তি জমিদারের কানে পৌঁছালেও তাতে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করার কোনো কারণ নেই! কারণ উপেনের মতো মানুষের যে তার বিরুদ্ধে কিছু করার নেই এমনকি জোর করে প্রতিবাদটুকুও করার ক্ষমতা নেই সেটা এই অত্যাচারী ধনীক শ্রেণির ভূস্বামী ভালোই অনুধাবন করতে পারেন। বরং উপেন যে মুখের ওপর ‘না’ বলেছে এটুকুতেই তিনি বেশ বিরক্ত। উপেনের জমি মাত্র দুই বিঘে রয়েছে যা থেকে সে তার পরিবারের ভরনপোষণ যোগায় এবং মাথা গোঁজার ঠাঁই সেই কথা জেনেও সেটুকু নেওয়ার জন্য ভূস্বামী তথা সেই মহাজনের লোভ তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি উপেনের অনুমতির অপেক্ষা করেননি। সে প্রশ্নও আসে না। 

উপেন যখন কাতভাবে জানায় যে- ‘কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই-/চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’

একথা শোনার পর ভূস্বামীর মনে কোনো করুণার উদ্রেক হয় না উপরন্তু তার যে ওই দুই বিঘা জমি না পেলে তার শখের বাগান দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মিলছে না সেকথাই উপেনকে দৃঢ় কণ্ঠে জানায়।

‘শুনি রাজা কহে, বাপু জানো তো হে, করেছি বাগানখানা/পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা।/ওটা দিতে হবে।’

উপেনের একমাত্র সম্বল ওর ওই ভিটেমাটি হারাতে হবে জেনে সে সজল চোখে জমিদারের করুণা ভিক্ষা চায়। কিন্তু তার করুণার উদ্রেক হয় না কোনোভাবেই। এসব অসহায় মানুষের প্রতি করুণার নজিরও খুব বেশি নেই। বরং অসহায়ের সবটুকু দখল করেই যেন তার পৈশাচিক তৃপ্তি। এই চিত্রের সাথে আজকের তথাকথিত আধুনিক সমাজের কি খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেছে? জমিদার প্রথা আর নেই। কিন্তু জমিদারি মানসিকতা কি বিদায় নিয়েছে? উপেনের মতো অসহায়, দরিদ্র মানুষ কি আজও এরকম কিছু মানুষের কবলে পরে ভিটেমাটি ছাড়ছে না? এ হলো কবিতা মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সমাজ বাস্তবতা। ওই সময়ে পুঁজিবাদের ধারণা বিকশিত হয়নি। এখন হচ্ছে। যতই পুঁজিবাদী ধারণা বিকশিত হচ্ছে ততই ফিরে আসছে ধনীক শ্রেণির মানসিকতা। সহায় সম্বলহীনের সাথে অত্যাচার বাড়ছে। মিথ্যে দেনার খাতে যখন উপেনের ভিটে মাটি সব কব্জা করে নেয় সেই লোভী জমিদার তখন উপেনের পথে নামা ছাড়া আর কোনো গতন্ত্যর থাকে না। কারণ সেই ভিটেমাটিটুকুই ছিল তার একমাত্র সম্বল। সেই বিখ্যাত উক্তি যা আজও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে তা এই দুই বিঘা জমি কবিতার। 

‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’

যার সমাজে আজ অর্থের জোরে রাজার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বসে আছেন তাদের অনেকেই সেই ভূস্বামীর ভূমিকাই সমাজে রয়ে গেছেন। একটি কবিতা একটি ঘটনা, সমাজ বাস্তবতা, ব্যক্তিগত নিরীক্ষণ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিকূলতা, ব্যর্থতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম প্রভৃতি কেন্দ্র করে লেখা হয়। সেই লেখা যে কেবল সেই সময়েরই অন্তভূক্ত থাকবে তার কোনো অর্থ নেই। লেখা কালের গণ্ডি উত্তীর্ণ হলেই তা জীবিত। দুই বিঘা জমি কবিতাটি তো শুধু একটি কবিতা নয় বরং আজও অসহায় মানুষের জমি যা উপেনরা রক্ষার প্রচেষ্টা করছে প্রতিদিন। দুই বিঘা জমিতে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা কাল থেকে কালে বহমান স্রোতধারা। দুই বিঘা জমি কবিতায় ভিটেমাটি হারিয়ে দেশান্তরী হওয়ার পর নানা স্থানে ঘুরলেও তার সেই সামান্য জমির কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না। কারণ স্বদেশের মাটির টান যে এরকমই হয়। একদিন সেখানে ফিরে আসার ইচ্ছা জাগে মনে। তাই সেই টানে উপেনও ফিরে আসে একদিন। কিন্তু এখানে বাস্তবতা হলো সময় পরিবর্তনশীল। একদিন যা অন্যায়ের কাছে ছেড়ে গেছে সেই মাটি তার সাথে বিশ^াসঘাতকতা করেনি। একদিন যে ভিটেমাটিটুকু উপেনের আশ্রয় ছিল ততদিনে তা সেই ভূস্বামীর দখলে শোভা বর্ধন করছে। সেদিনের উপেনের ফেলে যাওয়া মাটির চিহ্ন সে কোথাও খুঁজে পায় না। তার থেকেও বড় প্রহসন হলো উপেনের সামনে যখন তারই গাছ থেকে একটি আম পরে এবং উপেন তা হাতে নেয় তখন রাজার মালী এসে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং চোর স্বাব্যস্ত করে। এর থেকে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে! সময় এমনই! সাধুকে চোর আর চোরকে সাধুতে পরিণত করতে পারে! উপেনের মতো অনেক হতভাগ্য মানুষের তাই আজো এমন অপবাদ সহ্য করতে হয়। এমনিভাবে সমাজে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভোগবাদী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তার সাথে এই কবিতার চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের সামনে। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
মার্কিন শ্রমনীতি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করতে পারে: পররাষ্ট্র সচিব
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা-হয়রানি
একদিনে দশটি পথসভা, উঠান বৈঠক ও একটি জনসভা করেন সাজ্জাদুল হাসান এমপি
নতুন বছরে সুদহার বাড়ছে
শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেই আজকের উন্নত বাংলাদেশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রাজপথের আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: মুরাদ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকায় ইসলামী ব্যাংক
হাইকোর্টের ৫২ বেঞ্চ গঠন করলেন প্রধান বিচারপতি
নতুন বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
ইতিহাসের মহানায়ক: একটি অনন্য প্রকাশনা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft