শনিবার ২১ জুন ২০২৫
চেতনায় চির তারুণ্যের লাল-সবুজের বাংলাদেশ
জিল্লুর রহমান
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ৭:২৪ পিএম
যুদ্ধজয়ের আনন্দ অতুলনীয়, বীর সেনাদের বীরত্ব গাঁথায় ভরপুর আর সেই বিজয়ের ভেতর দিয়ে যদি অর্জিত হয় জাতীয় স্বাধীনতা, তবে সেই আনন্দ হয়ে ওঠে আরো অপরিসীম। বাঙালির জীবনে ১৬ ডিসেম্বর সেই আনন্দের দিন। ৫১ বছর আগের এই কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের দিনে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী সম্মুখসমরে পরাজিত হয়ে হেঁট মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল বীর বাঙালির কাছে। মহান বিজয় দিবস চিরগৌরবের সোনালী দিন। চির তারুণ্যের লাল-সবুজের বিজয় উৎসবের দিন।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রাণপুরুষ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জন্ম হয় নতুন লাল-সবুজের বাংলাদেশ। শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, মহান মুক্তিযুদ্ধ। এরপর দীর্ঘ নয় মাস সারা দেশে হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। এক কোটি মানুষ জন্মভূমি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথবাহিনী। 

বিজয়ের এই দিনটি জাতির জীবনে একই সঙ্গে বেদনারও। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে বাঙালিকে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার পলি মাটি, রক্তিম হয়েছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার ধারা। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখ মা-বোন। অগণিত মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন, সহ্য করছেন দুর্বিষহ যন্ত্রণা। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। সম্পদহানি হয়েছে বিপুল। মহান বিজয় দিবসে কৃতজ্ঞ জাতি গভীর বেদনা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে স্বাধীনতার জন্য যে বীর সন্তানেরা আত্মদান করেছেন, যারা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ ধরে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে আর যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, আজকের দিনটি তাদের সকলের কাছে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। বিজয়ের এই দিনটির জন্য কতজনের অপেক্ষা, কত মায়ের অপেক্ষা, পিতার অপেক্ষা, কত ভাইয়ের, বোনের অপেক্ষা। স্বামীর জন্য স্ত্রীর পথ চেয়ে থাকা। পিতার জন্য ছেলেমেয়েদের প্রতীক্ষা। ৫১ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল আজকের দিনটি। এ বিজয় ছিল এক বুক কান্না, এক বুক আনন্দ। আনন্দাশ্রু মেশানো দিনটি বারবার আসে, বারবার আসবে বছরের পর বছর অনন্তকাল। একাত্তর জন্ম দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর, এ ভূখণ্ডে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত ও আত্মসমর্পণে বাধ্য করার ৫১তম বার্ষিকী।

জাতি বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দানকারী ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো তিন লাখ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি একাত্তর দেখেনি। দেখেনি একাত্তরের সেই সাহস, একাত্তরের সেই বীরত্বপূর্ণ ঐক্য। সেই যুদ্ধদিনের সাক্ষী অনেক মানুষ আজ আর বেঁচে নেই। একদিন প্রাকৃতিক নিয়মেই ১৯৭১ দেখা একটি মানুষও বেঁচে থাকবে না। থাকবে আত্মত্যাগে সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ। আর থাকবে চির তরুণেরা। একাত্তর মানে তো তারুণ্যের বিজয়গাথা। তারুণ্য কখনোই থামতে দেয় না। তরুণেরা এগিয়ে চলে, এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তরুণশক্তি। এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সূচকের ঊর্ধ্বমুখী অবস্থানে রয়েছে আজকের বাংলাদেশ। অনেক প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে হেসেখেলে রাশি রাশি সাফাল্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ ছিল সুদীর্ঘ। ২০০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ব্রিটিশদের শাসন-শোষণের অবসান ঘটলেও বাঙালির শোষণ মুক্তি ঘটেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালির ওপর শোষণ, দমন চালাতে থাকে। তারা আঘাত হানে মাতৃভাষার ওপর।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্ব ইতিহাসের প্রচণ্ডতম রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন এক স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে, তথা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে এবং ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানবসভ্যতা ও স্বাধীনতা অর্জনের নিরেখে অমূল্য সম্পদ ও চূড়ান্ত বিজয়গাঁথা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রেরণার অনন্য একটি উৎস। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ চরম ত্যাগের অমরগাথা এবং জাতির গৌরবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আনন্দ-বেদনায় মিশ্রিত এক মুক্তিযুদ্ধ। প্রকৃত নেতা তৈরি করে ইতিহাস। ইতিহাস তৈরি করে মানুষ। ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত হয়ে আছে এক সাগর রক্তের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বীরত্বগাথা এবং বিজয়গাথা। একাত্তরের এই যুদ্ধ ছিল এক জীবন-মরণ জনযুদ্ধ।

একাত্তরে যারা বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিল তাদেরও সিংহভাগ ছিলেন তরুণ। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর। এখন যারা তরুণ তাদেরও অনুভবে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শানিত চেতনা। সেই চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তারপরও আমরা সাম্প্রতিককালে অনেক এগিয়ে গিয়েছি। এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাবই। এজন্যই বারবার বলা হয়, বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে তরুণেরা। সেই এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবেন প্রবীণেরা। এ যুগ প্রতিযোগিতার। প্রতিযোগিতা মানে লড়াই। লড়াইয়ের জন্য চাই সাহস। আর সেই সাহস সঞ্চারিত করতে দরকার একটি সাহসী নেতৃত্ব। ১৯৭১ সালে জাতি পেয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতা আর তার সাহসী নেতৃত্ব। 

আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ও ভালোবাসার দিবসটি হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। কারণ ১৯৭১ সালের এই দিনেই আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলাম। প্রতিবছর এই দিনটি ঘুরে ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয় নতুন রূপে, নতুন সাজে ও নতুন ভাবনায়। নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিজয় দেখেনি; কিন্তু তারা শুনেছে সেই বিজয়ের আত্মকথা। সবাইকে বিজয় দিবসের অর্জনকে হৃদয়ে ধারণ করে নতুনদের কাছে বিজয় দিবসের কথা তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নির্যাতন-নিষ্পেষিত হওয়ার কথা জানাতে হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যে কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, তা জানলে শিউরে উঠবে তরুণপ্রাণ। দেশের প্রতি জাগবে তাদের ভালোবাসা, উজ্জীবিত হবে দেশপ্রেমে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীনতা উপভোগ করছি, বিজয় উল্লাসে মেতে উঠছি। না হলে সারাজীবনই পাকিস্তানি শাসকদের বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এখনো অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আসেনি। স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন, ঠিক তেমনিভাবে স্বাধীনতা রক্ষা করা আরো কঠিন। প্রতিটি নাগরিক যাতে স্বাধীনতার পূর্ণ সাধ উপভোগ ও উপলব্ধি করতে পারে সে ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। 

১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈনিক মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করে যৌথবাহিনীর কাছে। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বাঙালির বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন-সার্বভৌম লাল-সবুজের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সবার। ঘরে ঘরে পথে-প্রান্তরে উড়ছে লালসবুজ পতাকা।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্য সন্তান হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা হাজার বছরের সংগ্রামের পরিণতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী বাঙালি হৃদয়ে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে। তাদের আত্মত্যাগের ফসল নষ্ট হয়নি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব বীর শহীদের বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। চিরতারুণ্যের লাল সবুজের পতাকা সগৌরবে উড়তে থাকবে হাজার বছর, যুগ যুগ ধরে অনন্ত কাল।

জিল্লুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক। 
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নান্দাইল পৌর সদরে এক রাতে তিন বাসায় চুরি
শিক্ষাবিদ নূরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের ইন্তেকাল
নতুন বছরে জঙ্গি মোকাবিলায় প্রস্তুত র‌্যাব: ডিজি
বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন মারা গেছেন
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা গান
এভাবে চলে যেতে নেই
পরীমনির জীবনটা আমার জীবনের মতো: তসলিমা
কেউ আক্রমণ করলে ছাড় দেবো না: কাদের
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft