মে দিবসের ইতিহাস এবং বাংলাদেশ
মাহবুব আলী
প্রকাশ: বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২২, ৬:২০ পিএম
শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মাঝে আত্মসচেতনতার যে দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছে, তার পেছনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ভূমিকা ও অবদান অনেক। মে মাসের এক তারিখ হলো আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবস। বিশ্বের অনেক দেশে এ দিবস বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক আনন্দ-বেদনার যুগপৎ সম্মিলনের দিন। এ দিনে স্বীকৃতি পেয়েছে শ্রমজীবি মানুষের ন্যায্য অধিকারের দিকটি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনবদ্য শ্রেণিচেতনা ও ইতিহাস। কয়েকজন শ্রমিকের আত্মত্যাগে রচিত হয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য মানবিকাধিকার ও সংগ্রামের এক হিরন্ময় মাইলফলক। শ্রমজীবি মানুষ শুধু তাদের কার্যসময় সম্পর্কিত অধিকার পাননি; পেয়েছেন মানুষ হিসেবে মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং উপলব্ধি। নতুনকে চ্যালেঞ্জ রূপে গ্রহণের অনুপ্রেরণা। এই দিবস এলে তারা আবার নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন। এ দিবস উদযাপনের গণজোয়ার আর কোরাসধ্বনিতে তাদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিধ্বনিত হয়ে দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে যায়। শ্রমজীবি মানুষের কর্মপ্রেরণা ও বেঁচে থাকার ন্যায্যহিস্যা নিয়ে তারা কথা বলেন। তাদের প্ররিশ্রমের সময় কতটুকু হবে, মজুরির পরিমাণ কত, অবসর, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। দিকনির্দেশনার পথ খুঁজে পায়। বিগত দিনের সকল শোষণ বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং তার প্রেক্ষিতে কী করা যায় ইত্যাদি পরস্পরের মধ্যে শেয়ারিং হয়। সিদ্ধান্ত হয় নতুনের। শপথ ধ্বনিত হয় একাত্মতার।

মে দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি ও গুরুত্ব অনেক যেমনভাবে এর কাহিনী বেদনাবিঁধুর। সে কাহিনী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী দিনগুলোতেও এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। মানুষের পৃথিবীতে যেকোনো ইতিহাস নানা শাসন-শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশে দেশে প্রায় একইরকম ঘটনাক্রম বা ইতিহাস থাকলেও মে দিবসের ইতিহাস আমেরিকার পটভূমিতে সৃষ্টি হয়। আর তা অনেক আগে থেকে। দেশটিতে শ্রমজীবি মানুষের সর্বপ্রথম সংঘ বা সমাজ গঠিত হতে শুরু করে ১৬৪০ সালে। ১৬৪৮ সালে বোস্টনে জুতা ও পিপা তৈরি শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হন। ১৭০০ সাল ও তৎপরবর্তী সময়ে অন্যান্য পেশাজীবি শ্রমিকেরা বিভিন্ন সমাজ ও সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। ১৭৭৬ সালে কার্পেন্টার হলে স্বাধীনতার ঘোষণা ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৭৯০ সালে রোহড দ্বীপের পোওটাকেট এলাকায় প্রথম বস্ত্র মিল প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে নিয়োজিত হয় ১২ বছরের কম বয়স্ক শিশু শ্রমিকেরা। ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সাল শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে নানা বিষয়ে বিভিন্ন মতানৈক্যের ইতিহাস। এই দাবিদাওয়া, প্রতিবাদ এবং কাজ বন্ধ করে দেওয়ার আন্দোলন ব্যাপৃত থাকে জুতা প্রস্তুতকারি শ্রমিক, ছুতার ও মুদ্রণ শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মাঝে।

অধিকাংশ শিল্প মিল কারখানায় কাজের পরিবেশ ও পরিস্থিতি ছিল অস্বাস্থ্যকর, ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়াবহ। স্বাস্থ্য ও জীবন মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল নিত্যসঙ্গী। কাজ করতে হতো ১০ থেকে ১৬ ঘণ্টা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮ ঘণ্টার অধিক। ১৮২০ সাল ও তৎপরবর্তী সময়ে শিল্প কারখানার শ্রমিকেরা সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেন, যার সূত্রপাত হয় নারী শ্রমিকের সংগঠনের মধ্য দিয়ে। এর ঠিক সাত বছরের মাথায় ফিলাডেলফিয়ায় শহরে শ্রমিক পরিষদ গঠিত হয়। ১৮৪৫ সালে সারা বাগ্লের নেতৃত্বে বিভিন্ন তুলা শিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ, স্যানিটেশন ও কার্যসময় নিয়ে ম্যাচাচুসেস্ট’এ দি ফিমেল লেবার রিফর্ম এসোসিয়েশন গঠিত হয়ে কার্যক্রম শুরু করে। তখন কার্যসময় ছিল ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা এবং অন্যান্য বক্তব্যের সঙ্গে সংগঠনটির দাবি ছিল কার্যসময় ১০ ঘণ্টায় নির্ধারণ করা।
 
১৮৬০ সালে নিউ ইংল্যান্ডে জুতা তৈরি শিল্পে নিয়োজিত ২০ সহস্রাধিক শ্রমিক দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে খুব সফলভাবে ধর্মঘট করেন। ১৮৬৮ সালে আমেরিকার আইনসভায় শ্রমিকদের কার্যসময় আট ঘণ্টা নির্ধারনের আইন পাশ হয় যা শুধুমাত্র সরকারি শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য হয়। বেসরকারি শিল্প-মিল-কারখানার ক্ষেত্রে অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ১৮৮১ সালে জর্জিয়া-আটলান্টায় ৩ সহস্রাধিক কৃষ্ণাঙ্গ নারী শ্রমিক, যারা লন্ড্রি শিল্পের কাজে নিয়োজিত এক বৃহৎ এবং সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরের বছর নিউ ইয়র্কে প্রথমবারের মতো শ্রমিক দিবস উদযাপিত হয়। 

সংগঠিত হওয়ার ক্রম ইতিহাস ও দীর্ঘ আন্দোলনের পর্যায় অতিক্রম করেও শ্রমিকদের মানুষের মতো কাজ করার পরিবেশ, নিরাপত্তা, উপযুক্ত কার্যসময় ও মজুরি যথার্থভাবে অর্জিত হয়নি। সেই বিষয় ও তার কাহিনী লেখক Upton Sinclair তার The Jungle-এ এবং Jack London তার Iron Hill বইয়ে তুলে ধরেছেন। এদের সেই লেখা থেকে শ্রমিকের দিনযাপন, জীবন ও আত্মত্যাগের বিষয় জানা যায়। ন্যায্য অধিকার ও মানুষের মতো বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এই কাহিনী শ্রমিকদের মানসিকভাবেও উদ্দীপ্ত করেছে। শ্রমিকদের এই ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো শিল্প মালিক দ্বারা বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। আন্দোলন পদদলিত হয়েছে। নিষ্পেষনের যাঁতাকলে পড়ে অনেক শ্রমিকের বলিদান হয়েছে। এ সময়ে শ্রম অধিকার ও মালিকানা চেতনার বিষয়টি রাজনৈতিক দর্শন ও মতবাদে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আবার বলা যায়, নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শ শ্রমিক আন্দোলনের বিষয়টিকে একটি পরিবর্তন ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে অপরিহার্যভাবে উৎসাহিত করে। সমাজ কাঠামো, সম্পত্তি চেতনা, মালিক বা পুঁজিপতি শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণি এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন ও সংঘাত থেকে মুক্তি এবং সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থার অগ্রসরমানতার লক্ষে বঞ্চিত শ্রেণি নতুন কিছু পরিবর্তনের জন্য আকাক্সক্ষা করছিলেন। কেননা সমাজতন্ত্র নতুন ও আকর্ষণীয় মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শ্রমজীবী মানুষের মনে মানুষের মতো বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও প্রত্যাশার বীজ বপন করেছে। তাদের মধ্যে এই উপলব্ধি হতে শুরু করে, পুঁজিবাদ সম্পত্তি ও কলকারখানার মালিকানার কারণে মালিকগণকে আরাম-আয়েস ও বিলাসি জীবনযাপনের পথ করে দিয়েছে ঠিকই তবে সেসবের পেছনে রয়েছে শ্রমিকের অমানুষিক পরিশ্রম। কেননা মালিকরা শ্রমিকের দ্বারা উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বিনিময়ে যে লভ্যাংশ তার দ্বারা লালিত হচ্ছে। এটি অন্যায় এবং শোষণ-বঞ্চনার শুভংকরের হিসাব। এ এক অদ্ভুত চক্রজাল যা শ্রমিকের জীবন ও অস্তিত্বকে বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত করে চলেছে। এ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতি বছর হাজার হাজার শ্রমিক তাদের স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে অমানষিক শ্রম দিয়ে নিজেদের আয়ু কমিয়ে ফেলছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। বৃদ্ধ বয়সে তার কোনো কাজ করার ক্ষমতা থাকে না, সেক্ষেত্রে তার কোনো সামাজিক নিরাপত্তাও নেই। সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এ্যঙ্গেল’স তাই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই মতবাদের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার কথা শিল্পসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোতে সংঘটিত হবে বলেছিলেন। কিন্তু চিহ্নিত রাষ্ট্রগুলোতে তেমনভাবে পরিবর্তনের চমক দেখা না দিয়ে তা বিকশিত হয় কৃষিভিত্তিক রাশিয়াতে। পরবর্তী সময়ে সমাজতন্ত্র মতবাদ সেখানে আর চলমান থাকেনি। সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র মতবাদ অনেকখানি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বলে প্রমুখ দার্শনিকেরা বলে থাকেন। অন্যদিকে শ্রমিকদের আন্দোলনকে পুজিবাদী সমাজব্যস্থার কর্ণধারেরা দু®কৃতকারী ও নৈরাজ্যবাদী বলে গালাগাল দিয়ে গেছেন। কঠোর হাতে দমন করার চেষ্টা করেছেন। যখন শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন তখন তা দমন করার জন্য শুরু হয় সুকঠিন সুকৌশল ষড়যন্ত্র জাল।

১৮৮৬ সালে মার্চে জেয় গ্লোউড মালিকানাধীন ইউনিয়ন প্যাসিফিক অ্যান্ড মিশৌরি প্যাসিফিকের প্রায় দুই লক্ষাধিক শ্রমিক ধর্মঘটে চলে গেলেন। অন্যান্য শিল্প-কলকারখানার শ্রমিকেরাও আন্দোলনে গেছেন। মে মাসে এক তারিখ। আমেরিকার প্রায় ১৩ হাজার মিল-কারখানার তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজের সময় আট ঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরি বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদি দাবিতে নানান ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে একত্রিত হয়েছেন। ধর্মঘট চলছে। কাজ বন্ধ। তাদের হাতে হাতে নানান ব্যানারে লেখা- বিলাসী অলস জীবন নিপাত যাক, প্রাসাদে চির অশান্তি, কুঁড়েঘরেই শান্তি, কার্যসময় আট ঘণ্টা মানতে হবে, শুকনো ব্যালটের চেয়ে এক পাউন্ড ডায়নামাইট শ্রেয়, ইত্যাদি। তারা প্যারেড করছেন, বাদ্য বাজছে। প্রায় দশ হাজার শ্রমিক তাদের কাজের মধ্যে যে নানান বঞ্চনা তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করছেন। দৃশ্যাবলী তুলে ধরছেন যাতে সকলে আরো উজ্জীবিত হয়ে চলেছেন। তাদের মধ্যে একতা আরো দৃঢ় হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকা ও শিল্পমালিক অবস্থা সাংঘর্ষিক হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যা তখনও সত্য হয়নি। অথচ শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমন করা হয় বর্বর পন্থায়। 

শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের নাম ঘরে ঘরে আলোচিত হতে শুরু করেছে। তারা হলেন এ্যলবার্ট পারসন, যোহান ম্যোস্ট, অগাস্ট স্পাইস এবং ল্যুইস লিং¹। আরো অনেক শ্রমিক কাজে যোগদান বন্ধ করে আন্দোলনে অংশ নিতে থাকেন। পরবর্তী দুই দিন পরিবেশ শান্ত ও থমথমে। তিন তারিখে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কস শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই শিল্প কারখানাটিতে বিগত ছয় মাস ধরে গোলমাল চলছিল। মালিক কর্তৃপক্ষের সশস্ত্র এজেন্ট ও পুলিশেরা শ্রমিকদের নানাভাবে উত্যক্ত করে আসছিল। তাদের পিটুনি দেওয়া হচ্ছিল। শ্রমিকরা এর প্রতিবাদে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কস শিল্প এলাকা চত্বরের কাছাকাছি জায়গায় যখন সভা-সমাবেশ থেকে বক্তৃতা করছেন তখন মালিক কর্তৃপক্ষের এজেন্ট ও পুলিশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করে। শ্রমিকেরা তার প্রতিবাদ করেন ও তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার জানান। অবশেষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। শ্রমিকেরা পাথরের টুকরো দিয়ে পিকেটিং করেন যেখানে পুলিশ তার জবাব দেয় গুলি করে। ফলে দুজন শ্রমিক মারা যান ও অসংখ্য আহত হন। 

পরের দিন খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে হে মার্কেট স্কোয়ারে একটি প্রতিবাদ সভা আহ্বান করা হয়। সেদিন আবহাওয়া তেমন ভালো ছিল না। তবু আগের দিন যেখানে তিন হাজারের মতো শ্রমিক জমায়েত হয়েছিল সেখানে দশ হাজারের উপর শ্রমিক যোগদান করেন। এ সভায় শুধুমাত্র শ্রমিক নন, তাদের পরিবারবর্গ ও সন্তানেরা যোগ দেন। এমনকি শিকাগো শহরের মেয়র নিজে উপস্থিত থাকেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সাক্ষ্য দেন যে, পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত ছিল এবং সহনীয় আলোচনা বক্তৃতা চলছিল। আলোচনা চলছে। এমনসময় শ্রমিকদের মধ্যে থাকা দুজন গোয়েন্দা পুলিশের দিকে এগিয়ে যায় এবং বক্তৃতা উস্কানিমূলক বলে রিপোর্ট করেন। ফলে পুলিশ সভা পণ্ড করার জন্য শক্তি প্রয়োগ শুরু করে। এসময় শ্রমিকদের মাঝখানে কোত্থেকে বোমা এসে বিস্ফোরিত হয়। প্রাণভয়ে আতঙ্কিত লোকজন পালাতে থাকে। পুলিশ শ্রমিকের উপর সরাসরি গুলি ছোড়া শুরু করে। এতে কত নিরিহ লোকের মৃত্যু হয় তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে, শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে সাত কিংবা আট জন নিহত এবং চল্লিশ জনেরও অধিক আহত হয়েছেন। অন্যদিকে একজন পুলিশ ঘটনাস্থলে ও সাতজন পরবর্তী সপ্তাহে মধ্যে মারা যায় বলে দাবী করা হয়। পরবর্তীতে বোমা বিস্ফোরণে একজন পুলিশের মৃত্যু ও অন্যান্য পুলিশের আহতের অবস্থা প্রমাণীত হয়। যে সকল পুলিশ আহত হন তা তাদের নিজেদের ভুল গুলি চালনার ফলে হয়েছেন বলে নির্দেশিত হয়। বোমা নিক্ষেপকারীকে সনাক্ত করা যায়নি। তবে এই ঘটনার জন্য শ্রমিক নেতাদের মধ্য থেকে অ্যালবার্ট পারসন, অগাস্ট স্পাইস, স্যামুয়েল ফিলডেন, অস্কার নিব্, মাইকেল শোয়াব, জর্জ ইগেল, এডলফ ফিশার এবং ল্যুইস লিং¹কে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। কেননা বিচারক বা জুরিবোর্ডের সদস্যরা ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। এই মামলায় মাত্র তিনজন ব্যক্তি ওই ঘটনার সময়ে এইসব নেতাদের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়। ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সকল আপিল আবেদন ব্যর্থ হয়। এ্যলবার্ট পারসন, অগাস্ট স্পাইস, জর্জ ইগেল এবং এডলফ ফিশারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ল্যুইস লিং¹ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগের দিন বিচার কর্তৃপক্ষ ও এই প্রক্রিয়া ন্যায়সঙ্গত নয় প্রতিবাদে মুখের ভেতর বিস্ফোরক রেখে আত্মহত্যা করেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর স্যামুয়েল ফিলডেন, অস্কার নিব্ এবং মাইকেল শোয়াব-এর ক্ষমা প্রার্থনা মঞ্জুর হয়।

শ্রমিকদের জীবন ও মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে মে মাসের এক তারিখ পৃথিবীর ৬৬টি দেশে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয়। বিশেষ করে শ্রমিক স্বার্থরক্ষাকারী সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এর গুরুত্ব অত্যধিক বলে জানা যায়। সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশেও ছুটি থাকে। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় এই, যে আমেরিকাতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের জন্ম সেখানে এ দিবসে কোনো ছুটি নেই।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনায় এনে জাতিসংঘ তার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। এটি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষা ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে অনেক নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছে। এই সংস্থায় স্বাক্ষরকারী সকল রাষ্ট্রেই মে দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের অন্যতম একটি। অথচ দুঃখের বিষয়, এ সমাজে শ্রমিকেরা নানাভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। মালিক ও শ্রমিক সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে এর সত্যতা প্রতিভাত হয়। বিশ্লেষণ করলে এক নিদারুণ পরিহাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। বিশেষ করে পোশাক শিল্প, বিড়ি কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বেকারি, মোটর পরিবহন, ইটভাটা ইত্যাদিতে অসহায় দরিদ্র শ্রমিক খুব স্বল্প মজুরিতে দিনরাত কাজ করে চলেছেন। পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিক যথার্থ মজুরি পান না। উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলোতে নানা কৌশলে কর্মচারীদের অতিরিক্ত পরিশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে এক মানবেতর জীবনযাপনে। চাকরি নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত। সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া নেই। শুধু তাই নয়, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রমিক-কর্মচারিদের জন্য দু-ধরনের নিয়ম প্রবর্তিত আছে। সরকারি কর্মচারিদের জন্য দুদিন ছুটি আর বেসরকারি কর্মচারিদের জন্য একদিন ছুটি। এ শুধু হাস্যকর নয়, লজ্জাষ্করও বটে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। 
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নান্দাইল পৌর সদরে এক রাতে তিন বাসায় চুরি
শিক্ষাবিদ নূরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের ইন্তেকাল
নতুন বছরে জঙ্গি মোকাবিলায় প্রস্তুত র‌্যাব: ডিজি
বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন মারা গেছেন
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা গান
এভাবে চলে যেতে নেই
পরীমনির জীবনটা আমার জীবনের মতো: তসলিমা
কেউ আক্রমণ করলে ছাড় দেবো না: কাদের
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft