বাংলা ছোটগল্পের আধুনিকায়নের অন্যতম কারিগর বনফুল
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২২, ২:৫৪ পিএম
আপাতদৃষ্টিতে একটি সাধারণ ঘটনা, অনুভূতি, বোধ, বাস্তব অভিজ্ঞতা, কোনো দৃশ্যমান পটভূমি অথবা কোনো সহজ জীবনকাহিনী নিয়েই ছোটগল্পের শব্দমালা সাজানো হয়। সেখানে অলংকার যোগ হয় এবং পাঠককে আকর্ষণ করে। ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উইলিয়াম হেনরি হাডসন তার An introduction to the study of literature গ্রন্থে বলেছেন, A short story must contain one and only to its logical conclusion with absolute singleness of method. যে যতো সহজে গল্পের কথা ফুটিয়ে তুলতে পারে পাঠক তার গল্প প্রাণে ধারণ করে বেশি। কোনো গল্পকারের গল্প গভীর থেকে গভীরে ছোটে আবার কারও লেখায় থাকে সহজবোধ্যতার ভেতর অসাধারণ অনুভূতির ঝর্ণাধারা। যার প্রতিটি বিন্দুতেই তৃপ্তি থাকে। ছোট গল্প কেমন হবে তার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই দেওয়া সম্ভব। তবে এর কিছু গ্রহণযোগ্য ধারণা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এই উক্তিটি। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখকথা/নিতান্তই সহজ সরল/সহস্র বিস্মৃতিরাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/তারি দু-চারটি অশ্রুজল/নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা/নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ/অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে/শেষ হইয়াও যেন হইলো না শেষ’- ছোটগল্প কেমন হবে তা নিয়ে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ হলো যথার্থ উক্তি। যদিও সময়ের আবক্ষ গতিধারায় সাহিত্যের অন্যসব শাখায় যেমন পরিবর্তন এসেছে, ছোটগল্পের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। সেসব ছোটগল্প আজ খুব ছোট। নাম অণুগল্প। এইসব অণুগল্পের মধ্যে আবার শব্দভেদ রয়েছে। একশ শব্দের গল্পও অণুগল্প আবার পাঁচশর ভেতরে থাকা শব্দও অণুগল্প। মোট কথা গল্পের ধারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। গল্পের বিষয়বস্তু, গতি এবং পারিপার্শ্বিকতা তুলে আনার ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে।

ছোটগল্পের উদ্ভব ঊনবিংশ শতাব্দীতে, ইউরোপে। এই শতাব্দীতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে এ উপমহাদেশেও ছোট গল্প উদ্ভব ও বিকশিত হয়। এই পরিবর্তনের ধারা যার হাত ধরে আজকের সময়ে এসেছে তিনি হলেন বনফুল। যার প্রকৃত নাম বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়। একজন স্বার্থক গল্পকার বলতে যে ধাঁচের লেখনীকে বুঝিয়ে থাকেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় সেই ধাঁচের অথবা তার থেকেও আধুনিক ধাঁচের গল্প লিখেছেন। 

গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসম্ভব মায়াময় উপলদ্ধি, বাস্তব জীবনের নানাবিধ উপকরণ এবং একটি চমৎকার পরিসমাপ্তি যেখানে তৃপ্তির শ্বাস ছাড়ে পাঠককুল। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারপুর গ্রামে। তার পিতা সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। তিনি পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ১৯১৮ সালে ম্যাট্রিক এবং হাজারিবাগ সেন্ট কলাম্বাস কলেজ থেকে ১৯২০ সালে আইএসসি পাশ করেন। এরপর ১৯২৭ সালে পাটনার প্রিন্স অব ওয়েলস মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি এমবি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। মানব সেবাকেই তিনি পরম ব্রত করেছিলেন। তবে ছোটবেলা থেকেই তার সাহিত্যের প্রতি বিশেষ ঝোক লক্ষ্য করা যায়। স্কুলে পড়ার সময় তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে কবিতা রচনা করেন। ১৯১৫ সালে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মালঞ্চ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ছদ্মনামের উদ্দেশ্য হলো শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকানো। বিকাশ নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। বনফুলের কবিতার খাতার নাম ছিল বনফুল। যদিও তিনি কবিতা লিখেছেন প্রচুর, এরমধ্যে আলোচিত কবিতাও রয়েছে তবু তার পরিচয় বা দক্ষতা হলো কথাসাহিত্যে। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়েই বনফুল নামে কবিতা ও গল্প লিখতে শুরু করেন। তার বিশেষত্ব হলো যে তিনি একসাথে কবিতা এবং গল্প লিখে গেছেন একাধারে। তার প্রথম উপন্যাস তৃণখণ্ড এবং কাব্যগ্রন্থ বনফুলের কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। তার সৃষ্টির ঝর্ণাধারার প্রতিটি বিন্দুতেই যেন নিজস্বতা রয়েছে। একটি ধারতেই তার অধিকাংশ সাহিত্য রচনা। 

বনফুল জীবনের ধারাগুলো বর্ণনা করেছেন একেবারে নিজস্ব ঢঙে। গল্প এগিয়ে গেছে সাধারণ গতিতেই তবে এমন হয়েছে যে শেষে এসে শুরুতে গল্পের কাহিনী যা আন্দাজ করেছিলাম তা হয়নি হয়েছে অন্যরকম। সেখানে রয়েছে রসাত্বক বা ব্যঙ্গাত্বক কোনো সুর আবার সেখানে সমাজকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। আমাদের চোখে যা একদম সাদামাটা ধরনের বনফুলের গল্পগুলো তাই নিয়েই উঠে এসেছে। লেখকের পাঠকের মৃত্যু নামক গল্পে দশ বছর সময়ের ব্যবধানে একজন পাঠকের মনের ভেতর যে পরিবর্তন ঘটে এবং সেই পরিবর্তনের হেতু পাঠকেরও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। দশ বছর আগে যে বই লেখক অন্যের কাছ থেকে নিয়ে গোগ্রাসে পড়েছেন এবং শেষ করতে না পারায় কিছুটা বিরক্তও হয়েছেন, সেই পাঠকই মানে লেখক স্বয়ং দশ বছর পর হাতের কাছে সেই কাক্সিক্ষত বই পেয়েও পড়তে ইচ্ছে হয়নি। অর্থাৎ পাঠকের মৃত্যু ঘটেছে! কি আশ্চর্য সহজ সত্যি বচন একটি গল্পে তুলে ধরেছেন। বনফুলের লেখায় মানব জীবনের বিভিন্ন দিকের তীব্র উদ্ভাবনী শক্তি আবিষ্কারের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। আরো আশ্চর্য হলো যে কিছু অল্প আলোচনাতেই তার গল্পের সমাপ্তিতে পৌঁছানোর দক্ষতা। সমাজের সাধারণ কথা, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, শ্রমজীবী মানুষের জীবন তার গল্পে উঠে এসেছে। তার লেখায় অসাধারণ সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে; যা বাংলা ছোটগল্পকে এক নতুন কাঠামোতে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ একটি মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন বাংলা সাহিত্য ধারায়। 

গল্পের যে ধারা আজ অণুগল্প নামে পাঠকের হৃদয় তৃপ্তিতে ব্যস্ত তা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই পরিপোক্ত হয়েছে। একটি গল্প যেভাবে শুরু হয়েই কাহিনীর ভেতরে ঢুকে পরে এবং আচমকাই গল্পের শেষও হয়ে যায় তা অণুগল্প হিসেবে সমাদৃত। লেখকের লেখায় যে চরম বাস্তবতা উঠে আসবে এটাই সত্যি। এখানে কাউকেই ছাড় নেই। আমরা যা ভাবছি সেটাই হয়তো লেখকের গল্পের উপজীব্য হয়ে গেছে। বনফুলের বিধাতা গল্পে দেখা যায়, মানুষের কত ধরনের চাহিদা ভগবানের কাছে। কেউ পরীক্ষায় ভালো ফল, কেউ সন্তানের মঙ্গল, কেউ মামলায় জয় লাভ আবার কেউ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ। কতশত আবদার। সেই আবদার শুনে ক্লান্ত ঈশ^র নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমালেন। এই যে সমাজের কঠিন এক বাস্তবতা তিনি হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে এনেছেন। আমরা তো আমাদের মনের সুপ্ত ইচ্ছা পূরণ না হলেই সৃষ্টিকর্তাকে নানা বাক্যবানে বিদ্ধ করতে উদ্যত হই। সেরকমই উদাহরণে গল্প হয়ে উঠে এসেছে। মানুষের চিন্তা ভাবনাগুলোকে খুব সহজে গল্পে  রূপ দেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা বনফুলের সহজাত ছিল। আমরা যা মূল্যায়ন করি না বা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না বনফুল সেগুলোকে খুব সহজেই আপন দক্ষতায় গল্পে তুলে এনেছেন। একজন স্বার্থক গল্পকারের স্বার্থকতা এখানেই। বনফুল বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের চোখে যেন গল্পের কোনো উপকরণই বাদ যায়নি। প্রতিটি দৃষ্টিকোণকেই তিনি আপন দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন। কবিগুরুর সাথে বনফুলের বেশ একটা চমৎকার সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ বহুবার বনফুলের লেখার মূল্যায়ন করেছেন। বনফুলের গল্পের রেশ যেন সহজে কাটে না। বনফুলের শতাব্দীর ব্যবধান গল্পে তুলে আনা হয়েছে এক রোগীর চিকিৎসককে ডাকতে আসার করুণ আর্তি এবং জবাবে বিলেত ফেরত ডাক্তার যে সাত দিনের আগে সময় দিতে পারবেন না এমনকি যখন তাকে বলা হলো রোগী মৃতপ্রায় অবস্থার। গল্পটার সারমর্ম হলো এই বিদেশফেরত ডাক্তারের ঠাকুরদার সাথে তাদের পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিল তবে বিদেশ থেকে বড় ডাক্তারি পাস করে সেই সম্পর্কের ইতি ঘটে। এভাবে সহজ সাধারণ সামাজিক অসামঞ্জস্যতাগুলোকে বনফুল গল্পে রূপ দিয়েছিলেন এবং গল্প যে আসলে আকারে নয় কাহিনীতে নির্ভর করে ছোট বড় নির্ধারণ করতে হয় সে পথ দেখিয়েছিলেন। লেখকের দুধের দাম গল্পে এক অসহায় বৃদ্ধা মহিলার ট্রেনে পায়ে ব্যাথা পাওয়া এবং সব তথাকথিত উচ্চ শ্রেণির মানুষের কাছে অবহেলার স্বীকার হওয়ার ঘটনা নিয়ে লেখা। পরিশেষে এক কুলি সেই বৃদ্ধাকে নিজ সন্তানের মতো বুকে আগলে ট্রেন থেকে নামিয়ে অন্য ট্রেনে তুলে দেয়। এ রকম বহু ঘটনা তার গল্পে উঠে এসেছে। 

লেখক হিসেবে বনফুল হাজারেরও বেশি কবিতা, পাঁচ শতাধিক ছোট গল্প, অর্ধশতাধিক উপন্যাস, নাটক, জীবনী এবং অসংখ্য প্রবন্ধ আলোচনা করেছেন। বলাই বাহুল্য এসবের মধ্যে তিনি কথাসাহিত্যের ধারায় সর্বাধিক পুষ্ট করেছেন। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বনফুলের কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, চতুর্দশী, করকমলেষু ইত্যাদি। তার তার উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে পুনর্জন্ম, কৃষ্ণপক্ষ, সন্ধিপুজা, হাটেবাজারে, কন্যাসু, অধিকলাল, কষ্টিপাথর, দুই পথিক, রাত্রি, পিতামহ, তৃণখণ্ড-১৯৩৫, বৈতরণীর তীরে-১৯৩৬, নিরঞ্জনা-১৯৫৫, ভুবন সোম-১৯৫৭, মহারাণী-১৯৫৮, অগ্নীশ^র-১৯৫৮, উদয়অস্ত ১৯৭৪, গন্ধরাজ, পীতাম্বরের জলতরঙ্গসহ আরো অসংখ্য জনপ্রিয় উপন্যাস তিনি রচনা করেছেন। তার ছোট গল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে, বনফুলের গল্প, বনফুলের আরো গল্প, বাহুল্য, বিন্দু বিসর্গ, অনুগামিনী, বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প, বনফুলের গল্প সংগ্রহ-১, বনফুলের গল্প সংগ্রহ-২ ইত্যাদি। তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি  শরৎ স্মৃতি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, জগত্তারিণী পুরস্কার এবং পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নান্দাইল পৌর সদরে এক রাতে তিন বাসায় চুরি
শিক্ষাবিদ নূরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের ইন্তেকাল
নতুন বছরে জঙ্গি মোকাবিলায় প্রস্তুত র‌্যাব: ডিজি
বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন মারা গেছেন
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা গান
এভাবে চলে যেতে নেই
পরীমনির জীবনটা আমার জীবনের মতো: তসলিমা
কেউ আক্রমণ করলে ছাড় দেবো না: কাদের
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft