আর্সেনিক থেকে বাঁচতে চাই সচেতনতা ও ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ: বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৫:২২ পিএম
আর্সেনিক মূলত এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখনই এই পানি ব্যবহারকারীর শরীরে নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে সেই উপসর্গগুলিকে রোগব্যাধির মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। ২০০৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশের ১৩৭ মিলিয়ন-এরও বেশি মানুষ, খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। কিন্তু এই বৈশ্বিক বিপর্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে গাঙ্গেয় উপত্যকার ভূমি সেখানে বাংলাদেশের ভূমিকেও আর্সেনিক দূষণ গ্রাস করেছে। মূলত ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় পানিতে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে ক্রমাগত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মান অনুযায়ী ১ লিটার পানিতে ১০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানি দূষিত। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী ১ লিটার পানিতে ৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানিকে নিরাপদ পানি বলা যাবে না।

আর্সেনিক আক্রান্ত  হয়ে অসুস্থতার লক্ষণগুলোর মধ্যে শরীরের চামড়ার উপর ছোট ছোট কালো দাগ এবং হাত ও পায়ের চামড়া শক্ত হয়ে যাওয়া অন্যতম। কিছুদিন এভাবে থাকার পর কোনো কোনো রোগীর চামড়া ও প্রস্রাবের থলি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার কারো কারো লিভার ও ফুসফুসের ব্যাধিও দেখা দিতে পারে। ফুসফুসের অসুখে কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্টের ফলে অনেকে ভালোভাবে কাজকর্ম করতে পারে না। শরীরে দুর্বলতাও দেখা দেয়। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী পানীয় জলে আর্সেনিক মাত্রা প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রামের কম হলে সেটি নিরাপদ। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এটি ১০ মাইক্রোগ্রামের কম হতে হবে (তথ্যসূত্র : বিবিএস)।
 
স্থানীয় একাধিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে অন্তত দুই কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর্সেনিককে  চিহ্নিত করেছে ‘মানব ইতিহাসের সব চাইতে বড় গণ বিষক্রিয়া’ হিসেবে। আগাছা ও কীটনাশক হিসেবে আর্সেনিকের প্রয়োগ আর্সেনিক দূষণের একটি প্রধান উৎস হতে পারে বলেও মত বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার। উচ্চ চাপযুক্ত স্প্রের ব্যবহার শুধু মাটি ও গাছপালার দূষণই ঘটায় না, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাতাস ও ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানিকেও দূষিত করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে আর্সেনিক ছিটানো পরিত্যক্ত তুলা ক্ষেত পোড়ালে  বায়ুদূষণ ঘটে। আর্সেনিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। পৃথিবীর ৫০টি দেশে ভূগর্ভস্থ বা ভূপরিস্থ পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। তাইওয়ানে প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বাধিক দূষণ আক্রান্ত এলাকা হচ্ছে- ল্যাটিন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া); দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার) ও দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তন)। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে বিভিন্ন মাত্রার আর্সেনিক দূষণ রয়েছে। আক্রান্ত বা ঝুঁকিগ্রস্থ জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাধিক দূষণগ্রস্থ দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের আগে থেকে ওষুধ হিসেবে এর প্রচলন ছিল। কীটনাশকের যৌগ হিসেবে আর্সেনিকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্যণীয়।

আর্সেনিক দূষণের জন্য সচরাচর চামড়ায় যে ক্যানসার বা ক্ষত হয়, তা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে অপারেশনের মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। তবে আর্সেনিক রোগীর জন্য সুষম ও সুপ্রাপ্য খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। সীমিত পরিমাণে ভাত ও মুড়ি ছাড়াও অন্তত একবেলা রুটি খাওয়া উচিত। তা ছাড়া প্রতিদিন সম্ভব না হলে সপ্তাহে অন্ততঃ ২-৩ দিন মাছ, ডিম বা দুধ খাওয়া প্রয়োজন। কারণ, আমিষঘটিত প্রোটিনের অভাবে আর্সেনিকোসিস রোগ বেশি প্রকাশ পায়। অঙ্কুরিত ছোলা, বাদাম, সয়াবিন, বিভিন্ন প্রকার ডাল, গাজর, শাকসবজি স্বল্প ব্যয়ে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও প্রেটিন যোগান দেয়। আর্সেনিকোসিস রোগ সম্বন্ধে সাধারণত মানুষের মনে অনেক অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন ভুল ধারণা আছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক দূষণ ধরা পড়ার পর থেকে বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে, বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত জেলাসমূহে আর্সেনিক দূষণের আশঙ্কা দেখা দেয়। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর ১৯৯৩ সালে  নবাবগঞ্জ সদর (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) উপজেলার বড়ঘরিয়া মৌজায় কয়েকটি কূপে পরীক্ষা চালিয়ে সর্বপ্রথম ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্সেনিক হলো ধূসর আভাযুক্ত সাদা রং বিশিষ্ট একটি উপধাতু। প্রকৃতিতে আর্সেনিক প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। দেশে আর্সেনিকোসিসের মূল কারণ ভূগর্ভস্থ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান ও জৈব আর্সেনিকযুক্ত খাদ্যদ্রব্য যেমন- মাংস, দুধ শস্যকণা, শাকসবজি, ইত্যাদি গ্রহণ, যা নীরব ঘাতকের মতো মানবদেহের নানা রকম ক্ষতি সাধন করে থাকে। আর্সেনিক রোগের লক্ষণ হচ্ছে ত্বকে কালো কালো দাগের মাঝে সাদা সাদা দাগ, যা বৃষ্টির ফোঁটার মতো দেখায়, ত্বক কালচে বর্ণ ধারণ করে, হাত ও পায়ের চামড়ার পুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং চামড়া খসখসে হয়ে যায়। তা ছাড়া এ গবেষণায় প্রায় ১৬ শতাংশ রোগীর বিভিন্ন ধরণের চামড়ার ক্যান্সার অথবা ক্যান্সার পূর্ববর্তী লক্ষণ দেখা দেয় আর্সেনিকোসিসের কারণে। সাধারণত ধীরগতিতে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে আর্সেনিকের বিষ। তবে অনেকক্ষেত্রে আর্সেনিক সংক্রমণের ফলে ক্যানসার হয়ে মৃত্যু হলেও চিকিৎসকরা তাকে আর্সেনিকজনিত মৃত্যু বলে চিহ্নিত করতে পারেন না।

আর্সেনিকোসিস নিরাময়ের কোনো সুনির্দিষ্ট ও নিশ্চিত চিকিৎসা এখন পর্যন্ত হয়নি। চিকিৎসার প্রাথমিক ধাপ হলো আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করা। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। এ ছাড়া ভিটামিন এ, সি, ই স্পিরুলিনা ইত্যাদি সম্পূরক হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ প্রশমনের জন্য কাজ করে চলেছে। সরকার বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ‘বাংলাদেশ আর্সেনিক শোধিত জল সরবরাহ প্রকল্প’ গ্রহণ করে, যা ২০০৮ পর্যন্ত চালু ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে এ প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করা হয়। এতে ইতোমধ্যে নলকূপ পরীক্ষা ও রোগী শনাক্তকরণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে।

প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে আর্সেনিক বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির জন্য আপাতত প্রতিরোধক ব্যবস্থাই সবচেয়ে উপযোগী। ব্যক্তি পর্যায়ে করণীয় হচ্ছে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি পান ও রান্নার কাজে ব্যবহার না করা। নিকটে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ পাওয়া না গেলে পুকুর বা নদী হতে ১ কলসি পানিতে আধা চামচ ফিটকিরি মিশিয়ে ২-৩ ঘণ্টা রেখে দিয়ে, পরে উপর থেকে তলানিবিহীন পরিষ্কার পানি পান করতে হবে। বৃষ্টির পানি যেহেতু আর্সেনিকমুক্ত, তাই বৃষ্টি আরম্ভ হবার ৫ মিনিট পর সরাসরি পরিষ্কার পাত্রে পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তা পান করতে হবে। স্থানীয়ভাবে আর্সেনিকমুক্ত পানিকে আর্সেনিক মুক্ত করার সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হচ্ছে ‘তিন কলসি পদ্ধতি’। এজন্য তিনটি কলসি একটির উপর অপরটি রাখতে হয়। সবচেয়ে উপরের কলসিতে রাখতে হয় লোহার কণা ও মোটা দানার বালু; মাঝখানের কলসিতে রাখতে হয় কাঠ কয়লা ও মিহি দানার বালু এবং একেবারে নিচের কলসি থাকে খালি। আর্সেনিকযুক্ত পানি এনে ঢালতে হয় সর্বউপরের পাত্রে, তা ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার, বিশুদ্ধ ও আর্সেনিকমুক্ত হয়ে জমা হয় সবচেয়ে নীচর কলসিতে। এ পদ্ধতিতে আর্সেনিকের মাত্রা অন্ততপক্ষে ৫০ পিপিবি (১ বিলিয়নে ৫০ শতাংশ)-এর নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। অবশ্য বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারি উদ্যোগে আর্সেনিক সমস্যায় কবলিত অঞ্চলে আনুমানিক ১৫০ মিটার গভীর  নলকূপ খনন করে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ করছে। পাশাপাশি ভূউপরিস্থ পানি ব্যবাহারকে উৎসাহিত করছে।
 
তবে ঘনঘন বন্যা, ভূমিধ্বস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পানির উৎস দূষিত হয়। শিল্পবর্জ্য, সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং জমিতে লবণাক্ত পানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশদূষণও বাংলাদেশে পানির গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পাশাপাশি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি গ্রহণ, বাস্তবায়ন এবং এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে পারলে আর্সেনিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ মিলবে। 

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নান্দাইল পৌর সদরে এক রাতে তিন বাসায় চুরি
শিক্ষাবিদ নূরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের ইন্তেকাল
নতুন বছরে জঙ্গি মোকাবিলায় প্রস্তুত র‌্যাব: ডিজি
বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন মারা গেছেন
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা গান
এভাবে চলে যেতে নেই
পরীমনির জীবনটা আমার জীবনের মতো: তসলিমা
কেউ আক্রমণ করলে ছাড় দেবো না: কাদের
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft