রেহানা পারভীন। বাংলাদেশের প্রথম নারী ফুটবলার। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এই নারী একই সঙ্গে কাবাডি, হ্যান্ডবল ও ফুটবলে জাতীয় দলে খেলেছেন। কুড়িগ্রামে জন্ম নেওয়া এ ক্রীড়াবিদ ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন বড় খেলোয়াড় হওয়ার। আজ তার স্বপ্ন ডানা মেলতে মেলতে আকাশ ছুঁয়েছে। এখন তিনি ফুটবলের কোচ হয়েছেন।
দেশের কৃতি এই খেলোয়ারের সঙ্গে কথা হয় আজকালের খবরের। তিনি জানান, চলমান বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেম জাতীয় ক্ষেত্রে খেলোয়ার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই গেমস থেকে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে খেলোয়ার বেরিয়ে আসবে, যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। এতে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে বঙ্গবন্ধু গেমস আয়োজন করায় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ক্রীড়ামন্ত্রী বীরেন শিকদার, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী রাসেল আহসানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান।
২০০৬ সালে রেহানার পারভীনের জাতীয় প্রতিযোগিতায় অভিষেক ঘটে। তখন প্রথম আন্তঃজেলা নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন শিপে ঢাকা জেলার পক্ষে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার নৈপুণ্যতায় ঢাকা প্রতিযোগিতা শিরোপা জয় করেছিল। তারপর কাবাডি এবং পরে বাংলাদেশ গেমসে হ্যান্ডবলেও চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল। তিন খেলাতেই তার সমান দক্ষতার খবর ছড়িয়ে পড়ে, তাই জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান সহজেই।
২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ১০ম সাফ গেমসে মহিলা জাতীয় কাবাডি দলে খেলার সুযোগ আসে এবং সেখানে তিনি তার অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। সাফ গেমস থেকে দেশে ফিরেই ডাক পান এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাইপর্ব ফুটবলে। ভারতে উড়িষ্যায় আমন্ত্রণমূলক মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাফুফে একাদশের হয়ে ৭টি প্রদেশে খেলেন তিনি। সেখানেও দুটি ম্যাচে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পান। ২০১২ সালে ভারতের পাটনায় অনুষ্ঠিত প্রথম মহিলা বিশ্বকাপ কাবাডিতে তিনি বাংলাদেশ দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। ফিফা এমএ এলিট রেফারিস কোর্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। এছাড়াও কোচের স্বীকৃতি হিসেবে এএফসি ‘সি’ লাইসেন্স আছে তার। ভলিবল কোচেস কোর্সও করেছেন তিনি।
ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি আনসার সেবাপদক গ্রহণ করেন রেহানা পারভীন।
কৃতি ক্রীড়াবিদের সঙ্গে কথোপকোথন
প্রশ্ন: কেমন আছেন?
রেহানা পারভীন: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তবে এই করোনা সময়ে সবকিছু থেমে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা খারাপলাগা কাজ করছে।
প্রশ্ন: আপনার ফুটবলে আসার শুরুর গল্পটা শুনতে চাই, জানাতে চাই পাঠককে?
রেহানা পারভীন: ছেলেবেলায় আমি ছিলাম ভীষণ দূরন্ত। খেলাধুলার পাশাপাশি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। লুকিয়ে লুকিয়ে বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেলও চালিয়েছি। প্রতিবেশীরা বিষয়টি সহজভাবে নিতো না, তবে আমি এগুলো পাত্তা দিতাম না। স্কুল কলেজে খেলাধুলায় বেশ নামডাক হয়। তারপর আন্তঃজেলা মহিলা ফুটবল দিয়েই শুরু। প্রথম যখন ডাক এলো, তখন মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তোমাদের সঙ্গে কি পুরুষ কোচ যাবে, নাকি মহিলা যাবে, তখন আমি বলেছি পুরুষ এবং মহিলা দুজনই যাবেন। তখন মা একটু আপত্তি জানিয়েছিলেন। আসলে তখনও তো এখনকার মতো এতটা মেয়েদের বাইরে খেলাধুলার ব্যাপারে স্বীকৃতি ছিল না।
প্রশ্ন: দেশের খেলাধুলায় মেয়েরা তেমনভাবে এগুতে পারছেন না কেন?
রেহানা পারভীন: দেখেন, মেয়েরা কোনোদিক দিয়েই পিছিয়ে নেই। এখন কিন্তু দেশের মহিলা ফুটবল এগিয়ে। ভালোমতো যত্ন ও সুযোগ সুবিধা পেলে আরো উন্নয়ন হবে। ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনার জন্য যোগ্য ও দক্ষ লোকের প্রয়োজন রয়েছে, এদিকটায় মনোযোগ দিতে হবে। মেধাবী সংগঠকের অভাবেও আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এগুতে পারছি না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলে আসার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা কি বলে আপনি মনে করেন?
রেহানা পারভীন: নারীরা সুযোগ সুবিধা কম পায়, দেশের মাটিতে মেয়েদের নিয়ে বেশি বেশি টুর্নামেন্ট হলে তারা নিজেদের ঝালিয়ে নিতে পারতেন। মেয়েদের ফুটবলে না আসার কারণ আমি মনে করি তাদেরকে মূল্যায়ন করা হয় কম। যদি তাদের পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিকটা ভালো হতো, তারা বাবা মায়ের হাতে নিজেদের ভালো মানের আয়টা তুলে দিতে পারতো, তখন দেখতেন, অভিভাবকরাও আগ্রহী হতেন তাদের মেয়েদের এখানে পাঠাতে। তবে দিন দিন আমরা আশার আলো দেখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে। তিনি আমাদের প্রতি নজর দিয়েছেন, সামনে দেশের ফুটবলে নারীরা অসামান্য অর্জন দেখাতে সক্ষম।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কেনো আন্তর্জাতিক মানের প্লেয়ার তৈরি হচ্ছে না, এর মূল কারণ কি?
রেহানা পারভীন: আগেও বলেছি, মেধাবী সংগঠক, দক্ষ পরিচালক এবং নারী ফুটবলারদের প্রতি সুনজর দিতে হবে, বেশি বেশি করে টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে হবে, তাহলে আমাদের ফুটবলেও আন্তর্জাতিক মানের প্লেয়ার তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন: কোচ হিসেবে আপনি কি কখনো কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
রেহানা পারভীন: অনেকে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই নানা কথা শোনাতো, আমি পাত্তা দিতাম না, আর এই পাত্তা না দেওয়াটাই আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলের উন্নতির জন্য আমাদের আর কি কি বিষয়ে কাজ করা উচিত?
রেহানা পারভীন: মেয়েদের প্রাকটিসগুলো ঠিকমতো করানো, বেশি বেশি টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ, মানসম্মত ক্রীড়া সংগঠক- এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
প্রশ্ন: রেহানা স্পোর্টস একাডেমি করেছেন আপনার এলাকায়। এই একাডেমি নিয়ে কি ভাবছেন?
রেহানা পারভীন: থানা ও জেলা পর্যায়ে ছেলে মেয়েদের প্র্যাকটিস চলছে। আমার নিজস্ব অর্থায়নে রেহানা স্পোর্টস একাডেমির কার্যক্রম চলছে। আসলে পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে কোনো কিছুতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বা সহযোগিতা পেলে হত-দরিদ্র এলাকা থেকে খেলোয়াড় তুলে আনা সম্ভব।
প্রশ্ন: আপনার প্লেয়ার জীবনে এমন একটা স্মরণীয় ঘটনা যা মনে হলে আপনি ইমোশনাল হয়ে যান?
রেহানা পারভীন: ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আনসার সেবাপদক গ্রহণ। এটা সত্যি আমার জীবনের একটা বিশাল পাওয়া। আরেকবার দিল্লিতে খেলতে যাবার সময় বিমানে উঠেই মায়ের কথা মনে পড়ায় কেঁদেছিলাম ,কারণ মা ছোটবেলায় প্রায়ই বলতেন, ‘এত যে খেলা খেলা করিস, তুই কি দিল্লি যাবি?’ সত্যি যখন দিল্লি যাচ্ছি, তখন আর মা বেঁচে নেই। মা বেঁচে থাকলে কতই খুশি হতেন!
প্রশ্ন: বর্তমান সময়ের মহিলা ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে কিছু বলেন।
রেহানা পারভীন: এখন মহিলা ফুটবলাররা এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা ভালো করছে। আমরা হয়তো কিছু পাইনি, কিন্তু নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু পাচ্ছে যেমন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মান এবং সম্মানী পাচ্ছে, এতে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। সামনে আমাদের নারী ফুটবলাররা আরো এগিয়ে যাবে আমার বিশ্বাস এবং আস্থাও আছে। আমাদেরসময় অনেক বাঁধা ছিল মেয়েদের, তাই মেয়েরা খেলাধুলায় আসবে এটা ছিল অনেকটাই যুদ্ধের মতো। এখন সময় বদলে গেছে, এখন অনেকেই আসছে সামনে আসছে.. মন দিয়ে খেললে তোমরাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করবে ইনশাআল্লাহ। এনএমএস।