প্রিন্ট সংস্করণ
ফের চিন্তা পোশাকে: বৃহৎ ঐক্যের ডাক
# বায়ারদের বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান বাণিজ্যমন্ত্রীর # নতুন প্রণোদনাসহ আগের ঋণ পরিশোধে আরো সময় চান মালিকরা
জাকির হুসাইন
প্রকাশ: রবিবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৩৪ এএম

করোনা সংকটেও সরকার শক্ত হাতে হাল ধরায় চরম বিপর্যয় কাটিয়ে এগিয়ে চললেও ইউরোপ-আমেরিকায় মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে ফের চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কপালে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় মার্কেট ব্রিটেন তথা ইউরোপ ও মার্কিন মুলুক। করোনার দ্বিতীয় আঘাতে রীতিমতো বিধ্বস্ত এই দুই বিশাল বাজারের ক্রেতারা নড়াচড়া না করায় বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা ও মূল্য ব্যাপক কমেছে। নতুন কোনো রপ্তানি আদেশ না আসায় বিশ^ব্যাংকের সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে পোশাক খাতের এই ঝুঁকি বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। এ পরিস্থিতিতে বিশ^ ক্রেতাদের বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। একইসঙ্গে পোশাকের নতুন নতুন বাজার খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন উদ্যোক্তাদের। আর পোশাক মালিকরা সরকারের কাছে নতুন প্রণোদনাসহ আগের ঋণ পরিশোধে আরো সময় চেয়ে খোলা চিঠি দিয়েছেন।
পোশাক খাতের এই সংকট বৈশ্বিক, যা কারো একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংকট মোকাবিলা করে পোশাকখাতের গতি ফেরাতে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, মালিক-সরকার ও শ্রমিক নেতারা। তারা বলেন, এখন বিভেদের সময় নয়। দরকার সব পক্ষের ঐক্য। এই ঐক্যবদ্ধ চেষ্টাই পারবে বৈশ্বিক এই সংকটে পোশাক খাতকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আগামী আগস্টের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা দেখছেন না। তিনি মনে করেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা আগের চেয়েও বেশি উদ্বেগের। তিনি বলেন, ইউকে, জার্মান, ফ্রান্সের অবস্থা খারাপ। আমেরিকার অবস্থাও ভালো নয়। আমাদের যেহেতু ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের জিনিসপত্র, বড়দিনের বিক্রিও খারাপ হয়েছে। বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়েছে ওদের। প্রথম ঢেউয়ে কিন্তু এতটা ছিল না, এখন অবস্থা খুবই খারাপ। সবাই টার্গেট করেছিল, ক্রিসমাসে ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য পোশাক খাতকে রক্ষায় বিদেশি ক্রেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। একইসঙ্গে এই সঙ্কটকালে নতুন বাজার খুঁজতে দেশের পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি আয়োজিত ‘রিকভারি অব দ্য অ্যাপারেল সেক্টর ফ্রম কোভিড-১৯ ক্রাইসিস ; ইস অ্যা ভ্যালু চেইন বেইসড সল্যুশন পসিবল?’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক সঙ্কট সামাল দিলেও এখন মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এই ঢেউয়ে সঙ্কট আরো গভীরে পৌঁছেছে। এর ফলে ক্রেতারা এখন অর্ডারের পরিমাণ ও মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। এতে সঙ্কট আরো বাড়ছে। ক্রেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ক্রেতারা যদি পোশাকের অর্ডার ঠিক রাখার পাশাপাশি মূল্যও কিছুটা বাড়িয়ে দেন, তাহলে এ খাতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের উদ্দেশে টিপু মুনশি বলেন, আমাদের নতুন নতুন বাজারে ঢুকতে হবে। যদি আমরা ঠিকমতো নতুন বাজারে ঢুকতে পারি, তাহলে হয়তো সঙ্কট কিছুটা কমতে পারে। তৈরি পোশাক খাতে সরকারের দেওয়া ঋণ সহযোগিতার সময় আরো বাড়ানো দরকার বলেও স্বীকার করেন তিনি।
নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এইআর হ্যারি ভারওয়েইজ বলেন, ‘করোনা সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বায়াররাও। অনেক চেইন শপ বন্ধ। চাহিদা এবং দাম দুটোই কমেছে। তবে পরিস্থিতি এরকম থাকবে না। নিশ্চয়ই সমস্যা একদিন আমরা কাটিয়ে উঠবো। তাই বায়ারদেরও শ্রমিক স্বার্থে দাম পুনঃমূল্যায়নে মনোযোগী হওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর পোশাকের জোগান দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, নেদারল্যান্ডস সরকার সে দেশের পোশাক আমদানিকারকদের বাংলাদেশের অর্ডার বাতিল না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসে রপ্তানিতে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি। কারণ, দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির অবনতি না হলেও ইউরোপজুড়ে এখন করোনার তাণ্ডব চলছে। এর আঘাত যদি রপ্তানি খাতে লাগে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশের অর্থনীতি। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। করোনা মহামারিকালে বিদায়ী বছরের শেষ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩১ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ছয় দশমিক ১১ শতাংশ কম। এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীর এই খাতে নতুন করে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, করোনায় পোশাকখাতে সাপ্লাই চেইনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে, কমেছে দামও। শ্রমিকদের এতে সমস্যা হচ্ছে। এটা একটা চক্রাকার সমস্যা। যার সমাধান সম্মিলিত উদ্যোগেই সম্ভব। এটা যত দ্রুত হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাতে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের’ জানুয়ারি সংখ্যায় এই ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ ও এশিয়া অঞ্চলে যখন করোনার সংক্রমণ শুরু হয়, তার পরের মাসেই দেশের পোশাক খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। গড় রপ্তানি দুই-তৃতীয়াংশ কমে এক বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। বেতন বকেয়া, আকস্মিক ছাঁটাই ও কর্মহীনতার মুখে পড়ে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জের শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন চালিয়েছিল পোশাক শিল্প মালিকরা। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি বাড়ায় তারা আশাবাদী হলেও নতুন বছরের শুরুতে নেমে এসেছে হতাশা।
গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন, পোশাকের বৈশ্বিক বিক্রির পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধারের কোনো ইঙ্গিত নেই। পশ্চিমের অনেক দেশ এখনো লকডাউন। তারা অর্থনীতি পুনরায় সচল হওয়া নিয়ে লড়াই করছে। এতদিন যেসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে, সেগুলো আগের অর্ডারের। নতুন করে ক্রেতারা অর্ডার দিচ্ছে না। আর দিলেও আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে কী হবে তা আন্দাজ করা মুশকিল বলে উল্লেখ করেন একাধিক গার্মেন্টস মালিক।
এই পরিস্থিতিতে নতুন চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে ঋণের কিস্তি। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় যে ঋণ দিয়েছিল তার কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে চলতি মাস থেকে।
চলতি জানুয়ারি মাস থেকে ওই ঋণ পরিশোধে ২৪ মাসের কিস্তি শুরু হওয়ার কথা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক চিঠিতে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা।
তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় আমরা বিপর্যস্ত। করোনার টিকার প্রাপ্যতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। আমাদের শঙ্কা, পোশাক রপ্তানির নিম্নমুখী প্রবণতা আগামী এপ্রিল পর্যন্ত থাকতে পারে। তিনি বলেন, মহামারির ধাক্কা থেকে শিল্প রক্ষায় সরকার পোশাক কারখানা মালিকদের স্বল্প সুদের যে ঋণ দিয়েছিল, তা পরিশোধে ছাড় চেয়ে ইতোমধ্যে একটি খোলা চিঠি দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকের বেতন বাবদ সরকার পোশাক খাতকে যে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ দিয়েছিল; আট মাসের গ্রেড পিরিয়ড শেষে জানুয়ারি থেকেই তা পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা। চিঠিতে সেই টাকা পরিশোধের সময় আরো ছয় মাস বাড়ানো অথবা প্রণোদনা পরিশোধের মেয়াদ আরো অতিরিক্ত এক বছর সম্প্রসারিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা দামি পোশাক রপ্তানি করে। তারাও সঙ্কটে পড়েছে। বাংলাদেশের ২৩ শতাংশ কারখানা সঙ্কটে রয়েছে, যেখানে শ্রীলঙ্কায় এই হার ৩১ শতাংশ। এ সঙ্কট দীর্ঘায়িত হয়ে আগামী বছর পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে। পোশাক খাতের সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার, মালিক, শ্রমিক ক্রেতাদের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি। এনএমএস।








সর্বশেষ সংবাদ
নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিজ্ঞানী ও কৃষি শ্রমিকদের অবদান রয়েছে: কৃষিমন্ত্রী
ভোটের প্রচারণায় এগিয়ে মনোজ বৈদ্য
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সমতা চায় টিআইবি
স্বাগতম ২০২২, বিদায় ২০২১
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সুবাহর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন
তাদের মাখো মাখো ‘প্রেমের প্রাসাদ’!
‘আমাকে জায়গা দিন, এটা আমার প্রাপ্য’ : লালকেল্লার দাবিদার মোগল সম্রাজ্ঞী
চা দোকানিকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা
আমি অনেকটাই ভেঙে পড়েছি : শামীম ওসমান
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft