প্রকাশ: রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:০৮ AM আপডেট: ১২.০১.২০২৫ ১১:২৯ PM
কতিপয় ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলো। এলসির অভাবে কাঁচামালও আমদানি করতে পারছেন না। ব্যাংকের অসহযোগিতার পাশাপাশি চলতি মূলধনের ঘাটতি, ডলারের উচ্চমূল্য, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে চরমভাবে ভুগছে শিল্পকারখানাগুলো। যার কারণে দেশের তেল-চিনিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন, রড-সিমেন্টসহ নির্মাণশিল্পের তৈরি উপকরণ, ওষুধ, সিরামিক ও বস্ত্র খাতের মতো বৃহৎ শিল্পগুলোতে উৎপাদন ব্যাপক হারে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। তারপর দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা। কিন্তু সেটির বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটায় চতুর্মুখী সঙ্কটে পড়েছে দেশের শিল্পখাত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশ কয়েকটি বড় বড় শিল্পগ্রুপ ইতোমধ্যে এলসি খুলতে না পেরে তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক ও ঢাকার কয়েকটি শিল্পগ্রুপ অন্যতম। যারা বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল এনে পণ্য উৎপাদন করে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছে অথচ তাদের অনেক ব্যাংক শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেওয়া সত্ত্বেও এলসি করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। ক্রমেই এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হচ্ছে। বর্তমানে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক ব্যাংকে বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এলসি, বিদেশি ব্যাংক (এডিডি) কনফারমেশন করছে না। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। সামনে রমজান মাস, দেশের ভোগ্যপণ্য চাহিদা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু সেই অনুযায়ী এলসি খোলা এবং তার বিপরীতে মাল শিপমেন্টের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বড় বড় শিল্পগ্রুপের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব। অতি সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্পগ্রুপগুলোর কোনো এলসি না করে শুধু পূর্ববর্তী ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিয়ে আসছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে দেশবন্ধু গ্রুপের কথা। গ্রুপটির অধীনে ২৮টি কোম্পানির প্রায় ১৭টি শিল্প-কারখানা রয়েছে, যেখানে ২৫ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো কিছু দিন থেকে শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেওয়ার পরেও এলসি দিচ্ছে না। এমনকি সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট কন্ট্রাক্টের আওতায় কাঁচামাল আমদানি করতেও সহায়তা করছে না। যদিও এতে ব্যাংকগুলোর কোনো প্রকার দায় সৃষ্টি হয় না।
এসব বিষয় তুলে ধরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে দেশবন্ধু গ্রুপ। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে যথাযত নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়, যার স্মারক নম্বর ০৩০০২৬৯০০৭৩০০০০১২৪-১৫৪। একইভাবে গত ২৮ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও একটি চিঠি দেওয়া হয়, যার স্মারক নম্বর ৫৩২০৪০৩৩৩৮০০১২৪২৯৩। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়, যার স্মারক নম্বর বিআরপিডি(পি)/৬৬১/১৩/আরআর(এম)/২০২৪-১১০০৮। এ প্রেক্ষিতে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার নং ১৬/২০২২ অনুযায়ী গ্রুপটির লোন রিসিডিউল করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যাংককে চিঠি দেয় দেশবন্ধু গ্রুপ। অতি আশ্চর্যের বিষয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি- এ তিনটি ইসলামী ব্যাংক অদ্যাবধি রিসিডিউল না করে বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে ক্লাসিফাইড হিসেবে প্রদর্শন করেছে।
এ অবস্থায় বিষয়টি সুরাহার জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় দেশবন্ধু গ্রুপ। মাননীয় হাইকোর্ট সার্বিক দিক বিবেচনা করে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠির প্রেক্ষিতে দেশবন্ধু গ্রুপের লোনগুলো রিসিডিউল করে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য নির্দেশনা দেন।
এদিকে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখিত তিনটি ইসলামী ব্যাংককে দেশবন্ধু গ্রুপের কোম্পানিগুলোর সুদ মওকুফ করে ব্যাংক হিসাবগুলো নিয়মিত করণ এবং নিয়মিত ব্যাংকিং কার্যক্রম করার জন্য চিঠি দেয়, যার স্মারক নং বিআরপিডি(ডি-১) পি/৬৬১/১৩/আরআরএম/২০২৪-১১৫৫৬। এই চিঠির প্রেক্ষিতে দেশবন্ধু গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের চিঠি দেয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ব্যাংকগুলো তা না করে বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এবং দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। দেশবন্ধু গ্রুপের সঙ্গে উল্লেখিত তিনটি ব্যাংকের লেনদেনের একটি ফিরিস্তি তুলে ধরা হলো-
দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’র সঙ্গে, ২০১৯ সাল থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’র সঙ্গে এবং ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি’র সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ২০১৭ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশবন্ধু প্যাকেজিং লিমিটেড, দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড, দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেড, দেশবন্ধু ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, এম আর ট্রেডিং এবং সাউথইস্ট সুয়েটারস লিমিটেডসহ দেশবন্ধু গ্রুপের এই সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট তিন হাজার ৯৩৪ দশমিক ৪০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। এই ঋণের বিপরীতে দেশবন্ধু গ্রুপ পরিশোধ করেছে তিন হাজার ৬০৫ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ২০১৯ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড, দেশবন্ধু সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, দেশবন্ধু ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, এম আর ট্রেডিং এবং দেশবন্ধু কনজ্যুমার অ্যান্ড এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডসহ দেশবন্ধু গ্রুপের এই পাঁচটি কোম্পানির অনুকূলে মোট এক হাজার ৫৪৯ দশমিক ৮১ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। এই ঋণের বিপরিতে দেশবন্ধু গ্রুপ পরিশোধ করে এক হাজার ১৪৬ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা। একইভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ২০২৩ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেডের অনুকূলে মোট ৭৫৩ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। এই ঋণের বিপরীতে দেশবন্ধু গ্রুপ পরিশোধ করে ৩৮০ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী গ্রুপটি ডলারের বিপরিতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী এই ক্ষতির টাকা গত আট বছরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো এখনো তা দেয়নি।
উপরে উল্লেখিত ফিরিস্তি হতে প্রতীয়মান হয় যে, দেশবন্ধু গ্রুপ পর্যাপ্ত পরিমাণ লোনের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করেছে। এর প্রমাণস্বরূপ ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে দেশবন্ধু গ্রুপকে প্রশংসাপত্রও দেওয়া হয়েছে। যেমন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর গুলশান শাখা এক টিঠিতে দেশবন্ধু সুগার মিলস, দেশবন্ধু ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড ও দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের অনুকূলে ভালো ও আর্থিক সচ্ছল গ্রাহক হিসেবে পৃথক পৃথক তিনটি প্রশংসাপত্র দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই ফরেন এক্সচেঞ্জ করপোরেট শাখা এক চিঠিতে দেশবন্ধু গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেডের অনুকূলে ভালো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে একটি প্রশংসাপত্র দিয়েছে।
ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে সম্পর্ক হয় দীর্ঘমেয়াদি। টাকা লেনদেনের ভিত্তিতেই এ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। গ্রুপটি পর্যাপ্ত পরিমাণে তাদের জামানত, গুডউইল ও ব্যক্তিগত জামানতের প্রেক্ষিতে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছে। একইসঙ্গে সরবরাহ লাইন ঠিক রেখে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রেখেছে। এসব কর্মকাণ্ডকে আমলে নিয়ে বিগত দিনগুলোতে গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশবন্ধু গ্রুপকে বিভিন্ন সময় প্রশংসাপত্রও দিয়েছে। অর্থাৎ এতে প্রমাণিত হয়, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করার পর থেকে এখনো পর্যন্ত গ্রুপটির নিয়মিত লেনদেন অব্যাহত রয়েছে। অতি সম্প্রতি একটি স্বার্থান্বেষী মহল গ্রুপটিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এত করে দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে সরকারকেও বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ব্যাংকার-কাস্টমার সম্পর্ককেও অবনতি ঘটাতে চ্ষ্টো চালাচ্ছে। এজন্য তারা গ্রুপের গোপনীয় তথ্য অনৈতিকভাবে বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিতভাবে বিভিন্ন মহলের কাছে সরবরাহ করছে। তাছাড়া বিষয়টি মহামান্য হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে গ্রুপটি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এতদসত্ত্বেও, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ সম্প্রতি এলসি না দেওয়া সত্ত্বেও দেশবন্ধু গ্রুপ ব্যাংকগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণের টাকা পরিশোধ করেছে। এলসি না দেওয়ার কারণে, কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানাগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যক্তি সম্পদের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। অথচ ব্যাংকগুলো এলসি খোলা নিয়ে তালবাহানা করছে। শুধু এলসি বন্ধ করেই ক্ষান্ত থাকেনি ব্যাংকগুলো, উল্টো ব্যাংক ও কাস্টমার সম্পর্কের গোপনীয় তথ্য ভুলভাবে সরবরাহ করে দেশবন্ধু গ্রুপের ইমেজ সংকট তৈরি করছে। এতে করে পুরো বিষয়টি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের এরকম একটি শিল্পগ্রুপ তৈরি হতে লাগে অনেক মেধা, পরিশ্রম, সময় ও অর্থ; যা দেশের সম্পদ। ব্যাংকগুলো নিজেদের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের অযাচিত সত্য-মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে গ্রুপটিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় বিষয় বলে মনে করছেন সংশিষ্টরা।
এদিকে ঋণপত্র (এলসি) না খোলার কারণে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়া এবং সিআইবি তালিকাসংক্রান্ত হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) পরিচালক বরাবর ৬ জানুয়ারি পৃথক দুটি চিঠি দিয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ। চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশবন্ধু গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প গ্রুপ হিসেবে বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক আমাদের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণপত্র খুলতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। ব্যাংকসমূহের দাবি, দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেডের নাম সিআইবি শ্রেণিকরণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকায় তারা দেশবন্ধু গ্রুপের অধীন বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণপত্র খুলতে পারছে না।
উল্লেখ, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরী মহোদয়ের আদালত ২৬ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে এক মামলায় নিম্নলিখিত আদেশ প্রদান করেছেন:
In the above facts and circumstances, I find prima facie ground in the instant application. Accordingly, respondent-opposite-parties are directed to maintain status-quo in respect of appellant Nos.2-20 companies for further publication of CIB report for a period of 3 months. অর্থাৎ, নিম্নে উল্লিখিত আপিলকারী নং ২-২০ কোম্পানির ক্ষেত্রে সিআইবি রিপোর্টের প্রকাশ, অন্তর্ভুক্তি এবং শ্রেণিকরণ সংক্রান্ত বিষয়ে আগামী তিন (৩) মাসের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে: 1. Deshbandhu Packaging Limited (DPL). 2. Deshbandhu Power Plant Limited. 3. Sahera Auto Rice Mills Limited 4. Deshbandhu Food & Beverage Limited (DFBL). 5. Deshbandhu Fiber Limited (DFL). 6. Deshbandhu Textile Mills Limited (DTML). 7. Deshbandhu Consumer & Agro Limited. 8. Deshbandhu Shipping Limited. 9. Deshbandhu Oil Refinery Limited. 10. Deshbandhu Cement Mills Limited (DCML). 11. Deshbandhu Parcel & Logistics Limited. 12. Deshbandhu Polymer Limited (DPL). 13. Deshbandhu Equity Management Limited. 14. Deshbandhu Media Limited. 15. Deshbandhu Security Service Limited. 16. Deshbandhu Asset Management Compaû Limited. 17. Deshbandhu Energy Limited. 18. Dainik Ajkaler Khabar. & 19. M.R. Trading & Shipping Co. Ltd.
উল্লেখ্য, গত ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে দেশবন্ধু গ্রুপ আদালতের আদেশের প্রত্যয়িত অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকে যথাযথভাবে দাখিল করে। অনতিবিলম্বে আদালতের আদেশ অনুযায়ী ডিএমএসএল-এর কারণে দেশবন্ধু গ্রুপের অধীন কোম্পানিগুলোর নাম সিআইবি তালিকায় সংশোধন/অপসারণ করে দেশবন্ধু গ্রুপের স্বার্থ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহকে দেশবন্ধু গ্রুপের অধীন কোম্পানিগুলোর পক্ষে ঋণপত্র খোলার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এ বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রুপ সিএফও বশির আহমেদ জানান, দেশবন্ধু গ্রুপ দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপের মধ্যে একটি স্বনামধন্য শিল্পগ্রুপ। দেশবন্ধু গ্রুপ ব্যবসা শুরু করে ১৯৮৯ সালে বাল্ক কমোডিটি ট্রেডার হিসেবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ আমদানিযোগ্য পণ্য তখন থেকেই আমদানি করে দেশের বাজারে সরবরাহ করছে। এরপর ২০০২ সালে সুগার মিলের মালিকানাস্বত্ব লাভ করে। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশবন্ধু সুগার মিলটি প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডারের মাধ্যমে মিলটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে ২০০৫ সালে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভালোভাবে ব্যবসা করে আসছিল মিলটি। তখন দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক দেশবন্ধু সুগার মিলের ভালো প্রশংসা করছিল। এ মর্মে কোম্পানিটির কাছে কয়েকটি ব্যাংকের প্রশংসাপত্র রয়েছে। ২০১০ সালের পর ২০১১ সালে তৎকালীন সরকার কোম্পানির কর্মকর্তাদের ডেকে উচ্চমূল্যেও সুগার আমদানি করতে বাধ্য করে। যার ফলে দেশবন্ধু সুগার মিলের ৩৭৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। অর্থাৎ, যখন দেশবন্ধু সুগারের বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা, তখন এক আমদানিতেই কোম্পানির ৩৭৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সব অথরিটির কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, সরকারের কথা অনুযায়ী দেশবন্ধু সুগার মিলসের সুগার আমদানি করে। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো কোম্পানির ক্ষতি হলে বিষয়টি সরকার দেখবে। সরকারের কথা অনুযায়ী তখন কোম্পানির ক্ষতির ৩৭৮ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে আবেদন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অদ্যাবধি ক্ষতির সে টাকাটা ফেরত পাইনি কোম্পানিটি। ফলে ৩৭৮ কোটি টাকা ক্ষতির কারণে এবং এই টাকাটি না দেওয়ার কারণে আমাদের ব্যবসায় চলতি মূলধন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পরক্ষণে ২০১৩-১৪ সাল হতেই ব্যাংকগুলো উচ্চ হারে সুদ চার্জ করতে থাকে। এক সময় ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ হারে সুদ চার্জ করতে থাকে; যা আমাদের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই ৩৭৮ কোটি টাকার উপরে ১৮ শতাংশ হারে সুদ চার্জ হতে হতে এবং সঞ্চিত হতে হতে দেশবন্ধু সুগারের ব্যবসা অনেক কমে যায়। অর্থাৎ কোম্পানিটির যদি ৩৭৮ কোটি টাকা ক্ষতি না হতো এবং দেশের ব্যবসা সফল কোম্পানিটির বর্তমান পরিস্থিতি উদ্ভব হতো না। একই সঙ্গে এ ঋণের বোঝা কাঁধে চাপতো না।
তিনি আরো বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল এটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মিথ্যা তথ্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার অপচেষ্টা করছে। ব্যাংকগুলো দেশবন্ধু গ্রুপের কাছে ঋণের কিছু টাকা পাবে এটি সত্য এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধও করা হচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের এই মহাসংকটময় কালে ঋণ পরিশোধে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। যার কবলে শুধু দেশবন্ধু গ্রুপই পড়েনি, বরং দেশের সব ধরনের কোম্পানি সাফার করছে।
তিনি আরো বলেন, কোম্পানির ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণ হলো, দেশের বর্তমান ব্যাংকিং পরিস্থিতি, কোভিড পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, এবং আমাদের পূর্বের ৩৭৮ কোটি টাকা ক্ষতির ধারাবাহিকতা আমাদেরকে তীব্র সমস্যার সম্মুখীন করেছে। তা ছাড়া কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকারের এজেন্সিগুলো এবং ভোক্তা অধিদপ্তর। কোম্পানির কতো টাকা আমদানি খরচ ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়সহ মোট ব্যয় বিবেচনায় না নিয়ে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রির কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দেশবন্ধু সুগার মিলস।
বশির আহমেদ আরো বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপের মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান একদিনে প্রতিষ্ঠা হয়নি। এটি দেশের অনেক বড় সম্পদ। বিগত দিনে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের অনুকূলে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করেছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে কোনো কোনো শিল্পগ্রুপকে নতুন করে চলতি মূলধন হিসাবে অর্থের জোগানও দিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলো দেশ স্বাধীনের পর থেকে অদ্যাবধি কোটি কোটি টাকা লোকসানের পরও ভর্তুকি দিয়ে কর্মসংস্থান ঠিক রেখেছে। দেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের স্বার্থে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেশে ও বিদেশের মানদণ্ড ঠিক রেখে এই বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তার একটি দিকনির্দেশনা দিতে পারে বলে জানান তিনি।